প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লোহা ও ... বিশদ
এই দুনিয়া বিশ্বায়িত হওয়ার বহু আগেও লাখ লাখ মানুষ মহামারীতে মারা গিয়েছে। আসলে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে বিশ্বে জনসংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনই বাড়ে রোগ বালাইয়ের প্রকোপ। মানুষ পশুপাখিকে যখন গৃহপালিত করতে শেখে, তখন সেই গৃহপালিত পশু পাখি থেকেও মানুষ সহজে সংক্রমিত হয়েছে। অন্যদিকে, বিশুদ্ধ জলের অভাবে গ্রামকে গ্রাম উজার হয়েছে। নগরসভ্যতা হারিয়ে গিয়েছে মহামারীতে। ওল্ড টেস্টামেন্টে যেমন ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে মহামারীর নিদর্শন আমরা পাই, তেমনই প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসবিদ থুসিসাইডিসের রচনাতেও মহামারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। থুসিসাইডিসের রচনা থেকে আমরা জানিতে পারি, পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের সময় টাইফাস মহামারীতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়। যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিস্টাব্দে রোমে স্মল পক্স মহামারীতে বহু মানুষ মারা যায়, রাজপরিবারের সদস্যরাও এর প্রকোপ থেকে বাঁচেনি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুইসিয়াস ভেরাসের মারা গিয়েছিলেন। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ মহামারী রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়। এরপর, পঞ্চম শতাব্দীতে একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে এই মহামারী শক্তিশালী পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যকেই শেষ করে দেয়।
১৪ শতকে যখন কোনও বিমান কিংবা প্রমোদতরী কিছুই ছিল না, তখনও ব্ল্যাক ডেথ নামে মহামারী এক যুগের কিছুটা বেশি সময়ের মধ্যেই প্রাচ্য এশিয়া থেকে পাশ্চাত্য ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এটি ইউরো-এশিয়া অঞ্চলটির সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মেরে ফেলেছিল। যা ইউরো-এশিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। ইংল্যান্ডে প্রতি দশজনে চারজন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ফ্লোরেন্স শহরে এক লাখ নাগরিকের মধ্যে ৫০ হাজার নাগরিক প্রাণ হারায়। সময়টা ১৫২০ সালের মার্চ মাস। গুটিবসন্তের (স্মল পক্স) একজন মাত্র বাহক ফ্রান্সিকো ডি অ্যাগুইয়া মেক্সিকোতে পা রাখেন। সেই সময় মধ্য আমেরিকায় কোনও ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না কোনও বাস পরিবহন। তা সত্ত্বেও ডিসেম্বরের মধ্যে গুটি বসন্ত মহামারি আকারে পুরো মধ্য আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা মধ্য আমেরিকার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই শেষ নয়! ১৯১৮ সালে একটি বিশেষ ধরনের ফ্লু ভাইরাস কয়েকমাসের মধ্যেই পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষকে আক্রান্ত করে, যা তখনকার মানব প্রজাতির এক চতুর্থাংশেরও বেশি। এই ভাইরাসে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের মৃত্যু হয়। ওই মহামারীতে এক বছরেরও কম সময়ে ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। চার বছর ধরে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যার চেয়েও তা বেশি ছিল। মহামারীর এরকম বহু নিদর্শন পাওয়া যায় ইতিহাসে, যা শুধু মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে এমন নয়, গোটা সমাজ-রাজনীতির সমীকরণকেই বদলে দিয়েছে। মহামারী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ডেমোগ্রাফিকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহেও ফেলেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
তাহলে কি করোনা ভাইরাসের প্রকোপেও আধুনিক বিশ্ব পাল্টে যাবে?
জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেল গত ১৮ মার্চ দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে প্রথম করোনা সংক্রমণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলেছেন। ২০১৯–এর ডিসেম্বরের পরের পৃথিবী আগের মতো নেই। পরিবর্তনটা হবে অস্বাভাবিকভাবে ভিন্ন এবং মৌলিক। নতুন অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে মানবজাতিকে। কিছু কিছু পরিবর্তন স্থায়ী হয়ে উঠবে। মনে রাখবেন, ১৯৪৫ সালের মে মাসের আগের ও পরের বিশ্ব আলাদা হয়ে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মাত্রায় চেনাজানা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। সেই অর্থে করোনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক ঘটনা’।
এই প্রজন্ম এ রকম সর্বগ্রাসী দুর্যোগ আর দেখেনি। প্রতিদিনই কোভিড-১৯ ক্ষয়ক্ষতির চমক দেখাচ্ছে। এর শেষ কোথায়, আমরা কেউই জানি না। ঝড়ের বেগে ধাবমান মানব সভ্যতা অতর্কিতে থেমে গিয়েছে। শিল্প-বাণিজ্য-বিশ্বায়ন, পরিবেশ দূষণের উদ্দাম গতি, সব কিছু থমকে দাঁড়িয়েছে এক মাসের মধ্যে। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে মানুষ কবে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে ফিরবে, তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়নি, চীন এত দ্রুত ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এও মনে হয়নি, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বিপর্যয় এত ব্যাপক হবে।
তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল ওই সব অঞ্চল। অথচ সেখানেই অস্তিত্বের সঙ্কট তীব্র চেহারা নিয়েছে। ইরানে সংক্রমণের ব্যাপকতারও কোনও উত্তর মেলেনি আজও। এটুকুই শুধু বোঝা যাচ্ছে, যেসব দেশ ও সরকার আগেভাগে সমস্যার রূঢ়তা চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ সক্রিয় হয়েছে, তারা ভাইরাসের আগ্রাসন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এনেছে। অন্যত্র ঘটেছে উল্টো। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় আমেরিকা, ব্রিটেনসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর নেতারা ব্যর্থ। নিজেদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তাঁদের তরফ থেকে এখনও এমন একটি বাক্যও পাওয়া যায়নি, যা বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করতে পারে। যা বিশ্বে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের ইঙ্গিত। অতীতে মহামারীর ইতিহাসে শুধুমাত্র সঠিক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে বহু রাজত্ব নুয়ে পড়েছিল। তবে সব মহামারির শিক্ষা এক রকম নয়।
ইউরোপ যুগের পর যুগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে শরিক হয়েছে আমেরিকার। অথচ, ভাইরাস হানা দেওয়ামাত্র ওয়াশিংটন কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়াই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাকি বিশ্বের দায় এড়িয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এই পরিস্থিতি যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘স্প্যানিশ-ফ্লু’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই দুর্যোগে অস্ট্রিয়া আর জার্মানি শক্তি হারিয়ে উত্থান ঘটেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের। তবে মহামারী শুধু রাজনীতিতে নয়, নাটকীয় পরিবর্তন আনে অর্থনীতিতেও। ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে পণ্য না পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক নাগরিকের জীবনে এই প্রথম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ এবং জরুরি অবস্থার মতো ঘটনা।
আপাতত গোটা পৃথিবী জুড়ে বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ, পর্যটন স্তব্ধ, হোটেল, খাবার দোকান সবেতেই তালা ঝুলছে। এমন চললে মে মাসের শেষের মধ্যে প্রায় সব বিমান সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। পর্যটন-শিল্পেও একই কালো মেঘ। শিল্পের যে ক্ষেত্রগুলো কাজ তৈরি করে, তার মধ্যে প্রধানই হল ভ্রমণ ও পর্যটন— পৃথিবীব্যাপী আনুমানিক ২০ শতাংশ মানুষের জীবিকার কেন্দ্র। ফলে যে সংখ্যায় মানুষ কাজ হারাতে চলেছে আগামী এক-দুই মাসে, তার হিসেব আন্দাজ করা যায় না। বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই চেন ভেঙে পড়েছে। বড় ধরনের মন্দার মুখে গোটা বিশ্ব। সব দেশেই ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার জন্য মরিয়া। কেউ চাইছেন নগদ সহায়তা, কেউ কর ছাড়। পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। কিন্তু অধিকাংশ অর্থমন্ত্রী হতবিহ্বল। রাষ্ট্রগুলো সাহায্য চাইছে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, এডিবির কাছে।
চীনকে বাদ দিলে ভারতসহ পৃথিবীর সব শেয়ার মার্কেটে অবিরাম রক্তক্ষরণ চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৮ সালের আর্থিক ‘মন্দা’র পরিস্থিতি আবার ফিরে এসেছে। মাসখানেকের মধ্যে পরিস্থিতির মোড় না ঘুরলে হয়তো আমরা ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ এর সঙ্গে তুলনীয় জায়গায় পৌঁছে যাব। ভাইরাস–ঝড় থামার পরই পুঁজি তার পুনরুত্থানের জন্য অটোমেশনের উপর জোর দেবে। কারখানা ও সাপ্লাই চেন দুটোর অটোমেশন করা গেলে পরের ভাইরাস যুদ্ধগুলোকে এড়ানো সহজ হতে পারে। আর এই অটোমেশন যুগের ব্যাপকতা শ্রমজীবীনির্ভর দেশগুলোর জন্য খারাপ খবর। অসংগঠিত শ্রমিকের হারও কমে আসবে।
প্রতিটি সংকটই কিছু সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দেয়। অর্গানিক ফুডের বাজার চাঙা হয়ে উঠবে। বিশেষ করে যেসব খাবার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সেগুলোর দিকে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। মাস্ক পরার চেয়েও শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকা যে অধিক জরুরি ছিল, সেটা করোনা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। ফলে ভোগের ধরন পাল্টাবে। জীবনযাপনের ধরনও। ‘লাইফস্টাইল’ জগতে তাই পরিবর্তন হবে বিস্ময়কর। করোনা ভাইরাস শুধু বিশ্বায়নের ধরনই নয়, হয়তো অনেক সামাজিক মূল্যবোধই আমূল পাল্টে দিতে পারে। গোলার্ধজুড়ে বইতে পারে স্বাস্থ্যসচেতনতার নতুন তরঙ্গ। মানুষ টের পাচ্ছে, একটা মিসাইল বানানোর চেয়ে একজন ডাক্তার তৈরি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। করোনা–আতঙ্ক সেই শিক্ষাই দিচ্ছে!