বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
বলতে কী, শেষপর্যন্ত কী হবে কেউ জানেন না। বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারছেন না, এ যাত্রায় করোনার প্রাণঘাতী দৌড় কোথায় গিয়ে থামবে। এই ভাইরাসের থাবায় স্পেনের তরুণ প্রতিভাবান ফুটবল কোচ ফ্রান্সিসকো গার্সিয়ার মতো আরও কত প্রাণ বলি হবে! কত ঘর-পরিবার হারাবে তাদের প্রিয়জন? কেউ জানেন না। কারণ, এখনও পর্যন্ত এই কালান্তক করোনার কোনও জুতসই প্রতিষেধক নেই গোটা পৃথিবীতে। শোনা যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা নাকি একটা প্রতিষেধকের সন্ধান পেয়েছেন এবং সেই সন্ধানীদলে আছেন এক ভারতীয়ও। কিন্তু সে প্রতিষেধক এখনও চূড়ান্ত পরীক্ষিত নয়। আমেরিকার সিয়াটেলও মানবদেহের ওপর কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রতিষেধকের পরীক্ষা হয়েছে। ফল নাকি মন্দ নয়। অবশ্য এইসব অ্যান্টিডোট যদি বা পরীক্ষায় শেষ অবধি পাশও করে তবেও তা মহাজনী কারবারের স্রোত বেয়ে জনসাধারণের নাগালে আসতে বছর ঘুরে যাবে বলেই মনে করছেন তথ্যভিজ্ঞজন!
অতএব, আপাতত আমরা বিশ্বমানুষ বর্মহীন, শস্ত্রহীন নিধিরাম হয়েই করোনার আক্রমণের মুখে। প্লেগ, ম্যালেরিয়া, সার্স, ক্যান্সার, ইবোলা, টিবির মতো মারণরোগের মুখে একটা সময় অবধি আমরা যেমন অসহায় ছিলাম, তাদের নিষ্ঠুর আক্রমণে হারিয়েছি অজস্র প্রিয়জন-স্বজন-বান্ধব—আজ করোনার আগ্রাসনের মুখে ঠিক তেমনই অবস্থা আমাদের, তেমনই মর্মান্তিক। অথচ, আজ একুশ শতকীয় বিজ্ঞান আমাদের করায়ত্ত, চাঁদ-মঙ্গলে বসতির চিন্তা এখন আর রূপকথা বলে মনে হয় না, সর্বাধুনিক গবেষণাগার প্রগাঢ়মেধা বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম—সব আমাদের হাতে—অজস্র অঢেল। তবু, কী আশ্চর্য দেখুন এক অদৃশ্য আণুবীক্ষণিক শত্রুর আতঙ্কে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রনেতা থেকে মহাপ্রভাবশালী মহাপণ্ডিত, হাজার হাজার কোটির শাহেনশা বাদশাহ থেকে হতদরিদ্র জীবনসম্বল—সকলে বিকলবিহ্বল বিপন্নতার শিকার! করোনার ভয়াবহতা, প্রাণঘাতী আক্রমণের মোকাবিলায় রাজনীতি, অর্থনীতি দম্ভ-দ্বেষ সব ভুলে এক সারিতে, একমত। সেলুনকর্মী সুভাষদার ভাবনা মতো চীন আমেরিকার যুদ্ধ লাগুক না লাগুক আমরা কিন্তু ইতিমধ্যেই এক অসম যুদ্ধে নেমে পড়েছি, পড়তে বাধ্য হয়েছি। এবং সে যুদ্ধপরিস্থিতি যে আজ রীতিমতো উদ্বেগজনক—তাতেই বা সন্দেহ কী?
এই উদ্বেগ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, পুণ্যভূমি দেবস্থান পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে! বন্ধ হয়েছে বিনোদন কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ইউরো কাপের মতো আনন্দযজ্ঞ। এমনকী আসন্ন টোকিও ওলিম্পিকের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্নচিহ্ন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে! সৌজন্যে সেই করোনা! কেবল হাসপাতালে হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডগুলো এখন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দিনরাত সেবায় মগ্ন থেকে প্রমাণ করে চলেছে—ঈশ্বর বিশ্বাসীর এই পৃথিবীতেও ঈশ্বরের প্রতিনিধি ডাক্তারেরা ছাড়া এখন মানুষ জনতার আর কোনও পরিত্রাতা নেই। কৌশলী যুদ্ধবাজ করোনার সঙ্গে প্রাণ বিপন্ন করে আত্মজন ভুলে আসল লড়াইটা লড়ছেন তাঁরাই। এবং সে লড়াইয়ের ভয়াবহতা কত সেটা চীন, ইতালি, ফ্রান্স, ইরাক, ইরান, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর সমেত গোটা বিশ্বের ভুক্তভোগী মাত্রেই এখন হাড়ে হাড়ে অনুভব করছেন। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এর মধ্যেই মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকের মতো বেশ কিছু জায়গায় মারণ ভাইরাসের হামলার খবর মিলেছে। কর্ণাটকের কালবুর্গি জেলায় করোনার প্রথম বলি হয়েছেন এক বৃদ্ধ। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের কলকাতাতেও এসে পড়েছে কালান্তক করোনা-সেনা, তাদের আক্রমণে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে আপাতত বন্দি একজনা। আর সেই সংবাদনিহিত বিপদশঙ্কা
রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে মহানগরবাসীর। জেলা মফস্সল গ্রামগ্রামান্তের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে দুশ্চিন্তা উদ্বেগ।
উদ্বেগের কারণ, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আগামী দু’সপ্তাহ ভারতের পক্ষে অতীব বিপজ্জনক। এই সময়ের মধ্যে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে করোনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার হামলা পরিসংখ্যান থেকেই এই আশঙ্কা উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রথম দু’সপ্তাহ ধীরে চলো নীতি নিলেও পরবর্তী সপ্তাহগুলিতে বিদ্যুৎবেগে ছড়ায় এই ভাইরাস। একেবারে মহামারীর মতো। সে পরিসংখ্যান সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন সকলের জানা, তাই পুনরুল্লেখের প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু, যেটা আবিশ্ব মানুষকে ভাবাচ্ছে তা হল—এই সংক্রমণ রোধের উপযুক্ত প্রতিষেধকের অভাব। কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়া আপাতত বিশ্বের মানুষের হাতে করোনা ঠেকাবার আর কোনও অস্ত্রও নেই।
ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের মতো এই পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অ্যাডভাইসারি মেনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক মাসের জন্য স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সমেত প্রায় সব কর্মস্থান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, মানুষজনকে খুব প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বেরতে বা হোটেল-রেস্তোরাঁ ক্লাব জমায়েতে যেতেও বারণ করেছেন। ১৮৯৭ সালের মহামারী আইনও লাগু করেছেন। সেই সঙ্গে বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার, মুখে-চোখে হাত না দেওয়ার মতো কিছু অবশ্যকর্তব্যের কথাও জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে সময়োচিত যথার্থ সিদ্ধান্ত। তার চেয়েও বড় কথা, দেখে স্বস্তি লাগছে যে, মমতার কট্টর বিরোধীরাও অন্তত এক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে পাশে দাঁড়িয়েছেন। পুরভোট পিছনোর ব্যাপারেও তার অন্যথা হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা তো ঠিকই বলেছেন, আগে মানুষের প্রাণ তারপর ভোট ইত্যাদি সবকিছু।
কিন্তু কথা হল—মানব বিশ্বকে এতো বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিল কোন দুষ্টচক্র? কেউ কেউ বলছেন, টিবি ক্যান্সার কি সার্স ইবোলাতে এর চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষের মৃত্যু ঘটে প্রতি বছর। সেই পরিসংখ্যানকে ঢাল করে করোনা বিপদকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টাও চলছে! কিন্তু, প্রতিষেধক প্রতিপক্ষহীন করোনা যে এই মুহূর্তে পৃথিবীর মানুষের সামনে যমরাজের দোসর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা অস্বীকার করবেন কে? বেশ কিছুদিন যাবৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর চর্চা চলছে এই মারণ ভাইরাসের উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে। তাতে যে সব ‘থিওরি’ ঘুরেফিরে আসছে—তার মধ্যে অন্যতম হল জৈবঅস্ত্র তত্ত্ব। মার্কিন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য সামনে রেখে বলা হচ্ছে, জৈবঅস্ত্র হিসেবে চীন উহানের গবেষণাগারে এই করোনা তৈরি করেছিল এবং সেটি কোনওভাবে লিক হয়ে যায় এবং সংক্রমণ ঘটায়। প্রথমে তারা সংক্রমণের ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল। আর পরবর্তীতে তাতেই যত বিপত্তি বিশ্বজুড়ে! চীন সঙ্গত কারণেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তা নিয়ে দুই মহাদেশে ঠান্ডা লড়াইও জারি হয়ে গেছে।
তবে, মহাশক্তিধরদের এইসব বাদবিসংবাদে আমাদের কী কাম? আমরা ভাবছি, কাল কী হবে? আমাদের সরকার প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থা নিয়েছেন, গত রবিবার তার জেরে দেখলাম মহানগরীর রাস্তাঘাট, শপিংমল, পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্ট পাড়া বনধের কলকাতার মতো শুনশান, গাড়ি-ঘোড়া মানুষজনে জমজমাট সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনের শহরটা যেন কোনও অজানা সন্ত্রাসের আশঙ্কায় দুয়ার এঁটে লুকিয়ে পড়েছে! নিত্যদিনের ট্রেনেও ভিড় নেই, বেশ কিছু মেল এক্সপ্রেস ট্রেন যাত্রীর অভাবে আপাতত বন্ধ! দোকান-বাজারেও সেই হুড়োহুড়ি হইহল্লা যেন অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। কেবল সুভাষচন্দ্রদের মতো যাদের দিন আনি দিন খাই—রুটি-রুজির তাগিদ তাঁদের দেখা মিলছে পথে। তাঁদের চোখেমুখে কথায় আচরণে বিশ্বাস-অবিশ্বাসে মেশা সেই কী হয় কী হয় ভাবটাও নজর এড়ায় না। সর্বত্র একটাই শঙ্কা একটাই আলোচনা উড়ে বেড়াচ্ছে—করোনা! সব মিলিয়ে প্রকৃত অর্থেই যুদ্ধপরিস্থিতি। আর সঙ্গত কারণেই তাতে উদ্বেগের মাত্রাও ক্রমবর্ধমান। তবে আমাদের বিশ্বাস, মানুষের প্রবল মেধাশক্তি ও বিজ্ঞানচেতনার সঙ্গে লড়াইতে করোনা-সেনা শেষপর্যন্ত পরাস্ত হবে, হবেই। এবং সেটা নিছকই সময়ের অপেক্ষা। তাই নয় কি?