পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি রিপোর্ট বলছে, করোনা ভাইরাসের জন্য অর্থনীতির ধাক্কা খাওয়া প্রথম ১৫টি দেশের মধ্যে থাকছে ভারত। ব্যবসায়িক ক্ষতি হতে চলেছে অন্তত ৩৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশের অর্থনীতি গোঁত্তা খেতে খেতে যেখানে এসে পৌঁছেছে, তাতে এই অঙ্ক পথে বসিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় আঘাত আসছে রাসায়নিক বা কেমিক্যাল সেক্টরে। তারপর একে একে টেক্সটাইল, গাড়ি শিল্প, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি, ধাতু ও ধাতব জিনিস, চামড়া শিল্প..। প্রভাবের অভিঘাত আমাদের দেশে বসে কিন্তু এখনই সেভাবে বোঝা যাচ্ছে না। অথচ, শুরুটা হয়ে গিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে। চীনে। উহান থেকে দুনিয়াভর ছড়িয়েছে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। তাই ঝড়টাও প্রথম আছড়ে পড়েছে চীনেই। উৎপাদন ক্ষেত্র বিপুল ধাক্কা খেয়েছে তাদের। আর আজকের বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। কেন? প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতির সিংহভাগ এখন নিয়ন্ত্রণ করে চীন। বহু উন্নয়নশীল দেশ মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে বেজিংয়ের। কখনও আর্থিক সাহায্য, কখনও আবার উৎপাদিত পণ্য দিয়ে সেই দেশগুলিকে সমর্থন দেয় চীনা সরকার। সেই সহায়তা ক্ষেত্রটা কার্যত বন্ধ। দ্বিতীয়ত, চীনের উৎপাদিত পণ্যের উপর ভিত্তি করে বাণিজ্য-বিশ্বের একটা বড় অংশ এখন পরিচালিত হয়। অনেক দেশ আছে, যারা শিল্পের কাঁচামাল সবটাই আমদানি করে চীন থেকে। জি জিনপিংয়ের দেশের পুরো ফোকাস এখন করোনায়। আক্রান্ত হাজার হাজার। নজরদারি বা আইসোলেশনে বহু। অফিস, কারখানা বন্ধ। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই উৎপাদন তলানিতে। বার্ষিক গড় উৎপাদনের হার ২ শতাংশ কমে গিয়েছে। ঠিক এই কারণে যে দেশগুলি শিল্পক্ষেত্রে চীনা পণ্যের উপর নির্ভরশীল, তাদের উপরও আঁচটা এসে পড়ছে। সরাসরি। পুরোটাই চেইন সিস্টেম। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই আমদানি-রপ্তানি খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর প্রাথমিক হিসেব বলছে, করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতির ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। কয়েকটা ক্ষেত্র ধরে নেওয়া যাক।
পর্যটন ও হোটেল ব্যবসা। উৎপাদন শিল্পের পরই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে এই ক্ষেত্রটি। এবং সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কোথাও কোথাও আরও দ্রুত। এর কারণ পরিষ্কার... একজন যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলেই রোগটা ১০ জনে ছড়িয়ে যাওয়া কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। আর সেই রোগী বিষয়টি লুকিয়ে রাখলে তো কথাই নেই! আপনি-আমি জানি না, কোন মানুষটি পরীক্ষা না করিয়ে, রোগ লুকিয়ে বাসে পাশের সিটে বসে আছেন। পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে যা আরও বেশি সম্ভব। রাজস্থান বা কেরলের মতো রাজ্যে বহু বিদেশি পর্যটক আসেন। তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হলে স্বেচ্ছায় সেই রোগ ভারতীয়দের দান করে যেতেই পারেন। সেটা হয়েওছে। আর তারপরই কঠোর হয়েছে প্রশাসন। সব দেশেই। এই পদক্ষেপে প্রথমেই বন্ধ হয়েছে ট্যুরিস্ট আসা। বিদেশি মুদ্রায় আয় তো বন্ধই, পাশাপাশি দেশের মধ্যেও বেড়িয়ে আসার আনন্দ আপাতত সিন্দুকে তোলা। আগে যেখানে একটা গড়পড়তা হোটেলের ৭৫ শতাংশের বেশি ঘর পর্যটন মরশুমে ভর্তি থাকত, সেটা এখন ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। রেস্তরাঁগুলির বিক্রিও অন্তত ৩০ শতাংশ কমেছে।
আর পর্যটনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে বিমান ও ট্রেনযাত্রা। সোমবার বিকেলেও দেখা গেল, আজকের হাওড়া-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসের এসি থ্রি টিয়ারের টিকিট রয়েছে ১৭টি। এই পরিসংখ্যান খুব সুলভ নয়! হাওড়া-এনজেপি শতাব্দীর এসি চেয়ারকারের টিকিট রয়েছে ১০৯টি। আর বিমান? আগামী সপ্তাহের দিল্লির টিকিট হাজার পাঁচেক দর চলছে। আর আজ গেলে ৬ হাজারের আশপাশে। আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা অফার দিচ্ছে... টিকিট কেটে রাখুন ডিসকাউন্টে। ছাড় তো মিলবেই। ক্যানসেল করার চার্জও লাগবে না...। কারণ একটাই। যাত্রী পরিবহণ ব্যবসা ধুঁকছে। ৬ মার্চ পর্যন্ত ৫৮৫টি আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল হয়েছে। সাধারণত রোজ যে পরিমাণে ফ্লাইট বুকিং হয়, তা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে গিয়েছে। বিমানবন্দর ফাঁকা। আতঙ্ক...।
জামাকাপড়, ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র... প্রভাব সর্বত্র। ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ জামাকাপড় প্রত্যেক বছর রপ্তানি হয়। করোনার জন্য ইতিমধ্যেই টেক্সটাইল শিল্প হোঁচট খাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অর্ডার আসা। আরও বেশি আঘাত ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি উৎপাদনে। টিভির প্যানেল হোক বা এসি মেশিনের কমপ্রেশার... চীনেই সবচেয়ে সস্তায় তৈরি হয়। যা আপাতত বন্ধ। মোবাইল ফোনও আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছে।
সঙ্গে রয়েছে পোলট্রি শিল্প। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ছড়াল, মুরগির মাংস খেলে নাকি করোনা ধরতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার মেসেজ তো আজকাল আবার আগুনের থেকে দ্রুত ছড়ায়। কমল বিক্রি। দাম নামতে নামতে কলকাতার বাজারে গড়ে ১০০ টাকার আশপাশে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল খাসির মাংসের দাম। দোলের দিন কোনও কোনও বাজারে ৮০০ টাকা ছুঁয়েছে খাসি। এই প্রবণতা কিন্তু শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে নয়! গোটা বিশ্বে।
উৎপাদন নেই, পণ্যের চাহিদা নেই, সরবরাহ নেই... বাজার মুখ থুবড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই হচ্ছে। আর এই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও দিশা নেই। করোনা আক্রান্তদের অন্যতম প্রধান উপসর্গ হল শ্বাসকষ্ট। অভিঘাত বাড়লে যা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। সেক্ষেত্রে ভেন্টিলেশন ছাড়া গতি নেই। একটা শহরে সব হাসপাতাল মিলিয়ে কটা ভেন্টিলেটর থাকতে পারে? গুণোত্তর প্রগতিতে আক্রান্ত বাড়লে সেই সংখ্যাটা কিন্তু মরুভূমিতে একফোঁটা জলের মতো হয়ে দাঁড়াবে। এখন পর্যন্ত গোটা বিশ্বে আক্রান্তের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে পরিসংখ্যানটা উল্টে যাবে। তাই এখন আতঙ্কে সবাই।
লন্ডনে ভয় পাচ্ছেন অমিতাভ, প্যারিসে শমীক চক্রবর্তী, বার্লিনে সৌম্য দাশগুপ্ত। ফ্রান্সে সোমবার থেকে স্কুল, কলেজ, ক্রেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলিকেও জানানো হয়েছে, খুব দরকার না হলে কর্মীদের অফিসে আসতে বাধ্য করবেন না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম করান। তাই শমীক খানিক স্বস্তিতে। তাও আতঙ্কমুক্ত নন...।
শতবর্ষ আগে... ১৯১৮ সালে এমনই এক ফ্লু মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, আর্জেন্তিনা... সর্বত্র থাবা দিয়েছিল এই ফ্লু। প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৫ কোটি মানুষ। মৃতদের বেশিরভাগের বয়স ছিল ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। খাবার, জল, ওষুধ... সবেরই আকাল। সেই সময় ছিল না ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। ভাইরাসের উপস্থিতি বিজ্ঞানীরা জানতেন, কিন্তু তাকে পর্যবেক্ষণ করে ভ্যাকসিন তৈরি করা ছিল অসম্ভব। সেবারও কিন্তু প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল অর্থনীতি। তার উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ... পরবর্তী সময় শুরু হয়েছিল প্রায় শূন্য থেকে। সে যুগ বিশ্বায়নের ছিল না। বাজার অর্থনীতি এতটা উন্মুক্ত হয়নি। উন্নয়নশীল দেশের সংখ্যা বেশি। প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবের দিন আসেনি...। ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব। আজ কী হবে? আপাতত বিজ্ঞানী, চিকিৎসকরা করোনাকে ঠেকিয়ে রাখতে বেশি তৎপর। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে না ছড়ায়...। তারপর প্রতিষেধক। তাই সচেতনতার থেকে কার্যকরী ওষুধ কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য কিছু নেই। কিন্তু আজ কী হবে? শুধু কোয়ারেন্টাইন করে কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে এই মহামারী?
প্রতিষেধক কিন্তু এখনও নাগালের অনেক দূর!