পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
ঋণদাতা ব্যাঙ্কের কর্তব্য ঋণগ্রহীতার অ্যাকাউন্টের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা। ব্যাঙ্কের হিসেব রাখা দরকার: প্রদত্ত ঋণের উপর গ্রহীতা নিয়ম মেনে সুদ মেটাচ্ছেন তো? মূল ঋণ অঙ্কের কিস্তি তিনি নির্দিষ্ট দিনে পরিশোধ করছেন তো? ব্যালান্সশিট এবং লাভ ও ক্ষতির হিসাবের (প্রফিট অ্যান্ড লস স্টেটমেন্ট) অডিট নিয়মমতো করা হচ্ছে তো? এই যে অডিটের কথা বলা হল তাতে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা বা খাতকের প্রকৃত আর্থিক চিত্রটির প্রতিফলন থাকছে তো?
বহু স্তরীয় নজরদারি
ব্যাঙ্কগুলির উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলি স্তর রয়েছে। প্রথমটি ব্যাঙ্কের ফিনান্স কমিটি। দ্বিতীয়টি হল বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স। তিন নম্বরে রয়েছে ইন্টারনাল অডিটর। চতুর্থ হল এক্সটার্নাল কনকারেন্ট অডিটর। পাঁচে আসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমোদিত স্ট্যাটুটরি অডিটরের কথা। ষষ্ঠ ধাপে রয়েছে শেয়ারহোল্ডারদের বার্ষিক সাধারণ সভা। সাত নম্বরটি হল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভিতরে ডিপার্টমেন্ট অফ ব্যাঙ্কিং অপারেশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ডিবিওডি)। শেষধাপে থাকেন তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষকরা। আর এই সবকিছুর উপরে রয়েছে অদৃশ্য বাজার, যে পুরস্কৃত করে অথবা শাস্তির বন্দোবস্ত করে, যখন ব্যাঙ্কও একটি তালিকাবদ্ধ কোম্পানি হয়। অর্থমন্ত্রকের অধীনে ডিপার্টমেন্ট অফ ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (ডিএফএস) নামেও একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে, যারা নির্দিষ্ট আয়তনের তফসিলভুক্ত প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের উপর নজর রাখে। তাদের নজরে থাকে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও।
বহুস্তরীয় নজরদারি সত্ত্বেও প্রদত্ত ঋণের কিছুটা অনুৎপাদক (নন-পারফর্মিং) হয়ে যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সত্যিকার লোকসানের কারণে। কোন ধরনের ঋণকে নন-পারফমিং অ্যাসেট (এনপিএ) বা অনুৎপাদক সম্পদের শ্রেণীতে ফেলা হবে সেটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম ও নির্দেশের ভিত্তিতে স্থির করা হয়। একবার এনপিএ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ হয়ে গেলে, সেই সম্পদের দরুন অনুমিত মুনাফার অঙ্কটা বাদ দিয়ে হিসেব প্রস্তুতের একটি ‘ব্যবস্থা’ সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কটিকেই করে নিতে হয়। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সংস্থার ডিভিডেন্ড ঘোষণা অথবা আয়ের পুনর্বিনিয়োগের উপর। মোট অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকলে অ্যালার্ম বেল বাজিয়েই দেওয়া উচিত।
ইয়েস ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে যেটা মনে হয়, তারা নজরদারির সবক’টি স্তর কোনও কৌশলে পেরিয়ে গিয়েছে এবং প্রতিটি ত্রৈমাসিকে মুনাফাও ঘোষণা করেছে। ব্যাঙ্কটি প্রথমবার তাদের ত্রৈমাসিক ক্ষতির অঙ্ক ঘোষণা করেছিল ২০১৯-এর জানুয়ারি-মার্চে। এমনকী তখনও ডিবিওডি এবং ডিএফএস-এর তরফে হুঁশিয়ার করা হয়নি।
ঋণের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে
২০১৪-র এপ্রিল থেকে ইয়েস ব্যাঙ্ক ঋণদান উপভোগ করে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের ব্যালান্সশিট থেকে নীচের হিসেবটা দেওয়া গেল:
২০১৪-র মার্চ থেকে ২০১৯-এর মার্চের ভিতরে ঋণের অঙ্কটা কী দ্রুত বেড়েছে সেই হিসেবটির দিকে চোখ রাখুন: ঋণের হিসেবটা বছরে ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে! বিমুদ্রাকরণের ঠিক পরবর্তী দু’বছরে (অর্থাৎ অর্থবর্ষ ২০১৬-১৭ ও অর্থবর্ষ ২০১৭-১৮) ঋণদান কী পরিমাণ বেড়েছিল খেয়াল করুন।
কিছু সংগত প্রশ্ন ওঠে: ২০১৪-র মার্চের পর কোন কমিটি অথবা কে ঋণমঞ্জুরিতে সিলমোহর দিয়েছিলেন? ইয়েস ব্যাঙ্ক যে যথেচ্ছ ঋণদান উপভোগ করছিল সেটি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সরকার অবগত ছিল না? প্রতি বছরের শেষে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সরকারের একজনও কি এই ব্যাঙ্কের ব্যালান্সশিট পড়ে দেখেননি? সিইও পরিবর্তন করার পর এবং ২০১৯-এর জানুয়ারিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নতুন সিইও নিয়োগ করার পর এই অব্যবস্থার কিছুই বদল হয়নি কেন? ২০১৯-এর মে মাসে ইয়েস ব্যাঙ্কের বোর্ডে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একজন প্রাক্তন গভর্নরকে নিয়োগ করা হয়েছিল। তার পরেও কেন কোনও কিছু পাল্টাল না? জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ ত্রৈমাসিকে ইয়েস ব্যাঙ্ক তাদের সর্বপ্রথম লোকসানের দুঃসংবাদ জানাল, তখনও কেন অ্যালার্ম বেলটা বাজানো হল না?
দায়বদ্ধ কে?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সরকারের কাছে এইসব প্রশ্নের জবাব চাওয়া হল গত ৭ মার্চ। কিন্তু সেই থেকে তাদের তরফে কেউই কোনও জবাব দিলেন না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সরকারের ইচ্ছে এই যে ইয়েস ব্যাঙ্ক কাহিনী মানুষের মন থেকে উবে যাবে। কিন্তু সেটা কোনও ভাবেই হবে না। এর জন্য আমি সোশ্যাল মিডিয়াকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন মাধ্যমের একাংশের অসৎ গপ্পো বিতরণ ছাড়া উপায় নেই।
জরুরি হল ইয়েস ব্যাঙ্ক এবং ডিবিওডি কর্তৃপক্ষের ভিতরে ব্যক্তিবিশেষের দায়বদ্ধতা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে চিহ্নিত করা। তার আগে সিবিআই এবং ইডি এই হইচইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়লে আমি মোটেই খুশি হব না। ‘তদন্ত’ শেষ হওয়ার আগে ব্যক্তিবিশেষের দায়বদ্ধতা চিহ্নিত না-হওয়ার আশঙ্কাই আমি করছি। আশঙ্কা করছি যে কিছু ছেলেভোলানো তথ্য ফাঁস এবং মুখরোচক গপ্পো পরিবেশনে ব্যস্ত থাকবে সংবাদ মাধ্যম এবং দায়বদ্ধতা চিহ্নিতকরণের কাজটিকে অনিশ্চিত করে তোলা হবে।
যাদের জন্য ইয়েস ব্যাঙ্কের এই হাল হল সেই খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের নাম প্রকাশের দাবিতে দেশের মানুষ এবং সংসদ নিশ্চয় সরব হবে। বিশেষভাবে জানার আগ্রহ থাকবে রাঘব বোয়ালদের নাম। যেসব ব্যক্তি এবং কমিটি এই সমস্ত ঋণের অনুমোদন দিয়েছেন তাঁদের কাছেও এই কাণ্ডের ব্যাখ্যা দাবি করা হবে। পাশাপাশি ডিবিওডি এবং ডিএফএস-এর ভিতরে যেসব ব্যক্তির নজরদারির সরাসরি দায়িত্ব ছিল, তাঁদেরও চিহ্নিত করার দাবি জানানো উচিত আমাদের। এই ঘটনার ব্যাখ্যা তাঁদেরও দিতে হবে। আমার সন্দেহ, আমরা কেবলমাত্র অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিই খুঁজে পাব না, বরং শাস্তিযোগ্য গাফিলতিও বেরিয়ে আসবে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সরকার একটি ‘রেসকিউ প্ল্যান’ রূপায়ণের চেষ্টা করছে যেটাকে শুধু উদ্ভটই বলা চলে। গত ১২ মার্চ ঘোষিত পরিকল্পনা অনুসারে, এসবিআই ৭,২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে, অন্যদের সঙ্গে, ইয়েস ব্যাঙ্কের পুনর্গঠিত মূলধনের ৪৯ শতাংশের মালিকানা গ্রহণের জন্য, ন্যূনতম ১০ টাকা দরের শেয়ারে—এমন একটি সময়ে যখন এই ব্যাঙ্কটির নিট মূল্য সম্ভবত শূন্য এবং শেয়ারগুলির কানাকড়িও মূল্য নেই! ‘ভালো টাকাগুলি’ ‘খারাপ টাকার’ পিছনে ছোড়ার আগে অন্য সম্ভাবনাগুলিও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। ইয়েস ব্যাঙ্ক কাহিনীর এটাই শেষ নয়।