দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
অথচ, ২০২০-২১ সাল হওয়ার কথা ছিল চীনের ইতিহাসের স্বর্ণালি বছর। পরিকল্পনা ছিল, এই বছর ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দারিদ্র্য বিদায়ের কথা ঘোষণা করা হবে। পরের বছর হবে দেশের শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তি উৎসব। আর ২০২২-এ হওয়ার কথা দলের নেতা হিসেবে জি জিনপিং জমানার ১০ বছর পূর্তি। কিন্তু একটা ভাইরাসের ছোবল বদলে দিয়েছে গোটা পরিস্থিতি। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে চীন। বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অন্যতম মডেল চীন। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়ার জন্য চীনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হতো। বিশ্বের যে শাসকদের এতদিন ‘আঙ্কেল জি’ হওয়ার বাসনা ছিল, তারাও এখন চীনের থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখতে ব্যস্ত। রাশিয়া, হংকং, উত্তর কোরিয়াও তাদের সীমান্তের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে চীন বিশ্বে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছে। অসন্তোষ বাড়ছে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র বিরুদ্ধেও।
প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংও জনসমক্ষে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। সিপিসির ৭০ বছরের শক্ত মেরুদণ্ডে ক্ষীণ এক আতঙ্কবোধ বইতে শুরু করেছে। যে পার্টি এত দিন ২০৪৯-এ চীনের বিপ্লবের শত বছর পূর্তির আয়োজন নিয়ে ভাবছিল, তারা এখন আগামী দিনগুলো নিয়ে ভাবতে বসেছে। ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক শিল্প-কারখানার। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যে চীনের বহু শহরে তাদের দোকানপাট ও কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার যেসব দেশে চীনের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে, সেখানে কাজের গতি থমকে গিয়েছে। করোনা যেখান থেকে ছড়িয়েছে, সেই উহান চীনের শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ৮৩টি বড় বড় কারিগরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। শহরটি অবস্থা আপাতত মৃত্যুপুরী। এর চারপাশের শহরগুলোও স্তব্ধ। এই মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটন ক্ষেত্র। হোটেল-রেস্টুরেন্টের বিপন্ন দশা। গত বছর চীনের জিডিপি ছিল ৬ শতাংশ। যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি বছর তা আরও কমে যাবে। এখন কল্পনা করাও কঠিন যে ঠিক এক দশক আগে ২০১০-এ চীনের জিডিপি ছিল ১০ শতাংশ।
গোটা বিশ্বের মতো ভারতের বাজারও হারাচ্ছে চীন। তথ্য বলছে, চীন ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল। বর্তমানে ভারতের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশের বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়েছে ৮ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলার। একই সময় চীনের সঙ্গে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ডলার। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে। অন্যদিকে ওই সময়ে ৬ হাজার ৪৯৬ কোটি ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয় ভারত ও চীনের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের এই ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। চীন ক্রমশ পিছিয়ে পড়বে। করোনা ভাইরাসের মহামারী নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকলে চীনের পক্ষে ভারতের মাটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো মুশকিল হবে।
মারণ ভাইরাস চোখ রাঙাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালির মতো দেশে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে ইরানে এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা ৬১ ছাড়িয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং দেশের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রীও। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ইতালি আর দক্ষিণ কোরিয়াতেও। ইতালিতে এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫। দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৯০০। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীন সম্পর্কে বৈরী মনোভাব বেড়ে গিয়েছে। অনেক সময় তা বাস্তবিক উদ্বেগের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জাপানে ট্যুইটার ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে ‘চীনারা জাপানে এসো না’ হ্যাশট্যাগ। সিঙ্গাপুরে কয়েক হাজার মানুষ চীনা নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে একটি আবেদন করেছেন সরকারের কাছে। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা একটি প্রতীক তুলে ধরছেন। যাতে বলা হচ্ছে, চীনা ক্রেতাদের স্বাগত জানানো হবে না। ফ্রান্সে একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় ‘হলুদ সংকেত’ প্রকাশ করে সতর্কতা জারি করেছে। কানাডার টরেন্টোর উপকূলে একটি স্কুলের অভিভাবকরা দাবি করেছেন, সম্প্রতি চীন থেকে ফেরা একটি পরিবারের শিশুদের ১৭ দিনের জন্য ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ভিয়েতনামের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা হোই অ্যান-এ ব্রেড বক্স নামে একটি রেস্তরাঁর মালিক এই মাসের শুরুতে একটি সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। তাতে লেখা রয়েছে, ‘আমরা চীনাদের পরিষেবা দিতে পারছি না, দুঃখিত’। ডানাং রিভারসাইট হোটেল ঘোষণা করে দিয়েছে, ভাইরাসের কারণে তারা কোনও চীনা অতিথিকে গ্রহণ করবে না। জাপানে ট্যুইটারে চীনের পর্যটকদের ‘নোংরা’ এবং ‘রাসায়নিক সন্ত্রাসবাদী’ বলে প্রচার করা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের এশিয়ান স্টাডিসের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টি গোভেলার কথায়, এরকম চীনবিরোধী মনোভাবের নেপথ্যে অর্থনৈতিক উত্তেজনার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনা আতঙ্কের বাজ পড়েছে বিশ্ব বাজারে। বিশ্বজুড়ে প্রতিটি শেয়ার বাজারে পতন শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারও (আইএমএফ) সতর্ক করে বলেছে, করোনার জেরে বিশ্ব অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো আরও কঠিন হতে পারে। ইতিমধ্যেই এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে চীনের অর্থনীতিতে। যার প্রভাব কাটাতে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক ফুরিয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় অন্যান্য দেশে ভাইরাসের প্রভাব বাড়লে, তা হবে মারাত্মক। অবস্থা সামলানোই কঠিন হবে। ভারত সহ বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজারকে টেনে নামাচ্ছে সেই আশঙ্কাই। অন্যদিকে সুরক্ষিত সোনায় লগ্নি বাড়ছে। ফলে বাড়ছে তার চাহিদা। বিশ্ব বাজারে চড়ছে দাম। আর ভারতে সোনার দাম মূলত ওঠানামা করে আন্তর্জাতিক দামের ভিত্তিতেই। তার উপর ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম তিন মাসের তলানি ছুঁয়েছে। এ দেশে প্রয়োজনীয় সোনার প্রায় সবটাই মেটাতে হয় আমদানি করে। আর তা হয় ডলারে। এই পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে সোনা কেনার জন্য ডলার জোগাড় করতে টাকা লাগছে বেশি। এটাও ঠেলে তুলছে সোনার দামকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের ভয় যে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আমদানি-রপ্তানির পথে বিরাট বাধা হতে পারে, তা পরিষ্কার। তার উপরে চীনের মতো এত বড় অর্থনীতি ধাক্কা খেলে, তার প্রভাব বইতে বাধ্য গোটা বিশ্ব। সেই ঝাপ্টা থেকে বাদ যাবে না ভারতও। পণ্য জোগান ব্যাহত হওয়ায় আর্থিক ক্ষেত্রে বড় মাপের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যেই শিল্পক্ষেত্রে পড়তে শুরু করেছে।
সব থেকে বড় কথা, জীবনের প্রতি পদে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ কতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, তা চীনের মানুষ প্রাণ দিয়ে বুঝতে পারছে। এর ফলে সবচেয়ে ভয়ানক যে ঘটনা ঘটতে পারে, তা হল চীনে শাসনব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে পারে। এটা এমন নয় যে হুট করে সরকারের পতন হবে। এই মহামারী আরও বিস্তৃত হলে জন-অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে এবং তা গৃহযুদ্ধে মোড় নিতে পারে। গৃহযুদ্ধের একপর্যায়ে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার গদ্দাফিকে উৎখাত হতে হয়েছিল। চীনে যদি সে ধরনের গৃহযুদ্ধ বাধে, তাহলে তা গোটা বিশ্বের জন্য মহাদুর্যোগ বয়ে আনবে। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইউয়েন অং-এর দাবি, চীনের অভ্যন্তরীণ কড়াকড়ি নীতি নিয়ে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তার দায় জি জিনপিং এড়াতে পারেন না। যে চিকিৎসক করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রথম সবাইকে সতর্ক করার পর সরকারের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন, সেই লি ওয়েনলিয়াং ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় সরকারের উপর মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। যা এতদিন ভাবাই যেত না। সর্বত্র একটাই প্রশ্ন, তাহলে কি আঙ্কেল জি-র স্বর্ণযুগ শেষ হচ্ছে?