কর্মপ্রার্থীদের কর্মযোগে বিলম্ব ঘটবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মযোগ আছে। ব্যবসায় যোগ দেওয়া যেতে পারে। কোনও বন্ধুর ... বিশদ
সাক্ষাতের প্রায় শুরুতেই মাস্টারমশাই ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করে বসেছিলেন, ‘‘ঈশ্বরকে কি দর্শন করা যায়?’’ শ্রীরামকৃষ্ণ জবাবে বলেছিলেন, ‘‘হাঁ অবশ্য করা যায়।’’ ইংরেজি জানা উচ্চ শিক্ষিত মাস্টার মশাইয়ের অহংয়ের আঁধার ক্রমে ক্রমে ঠাকুরের জ্ঞানালোকে দূর হতে লাগল।
তিনিও উপলব্ধি করলেন পরম সার কথাটি, ঈশ্বর লাভই মানব জীবনের উদ্দেশ্য। ঠাকুর মাস্টারমশাইকে ঈশ্বরদর্শনের উপায়ের কথা শুনিয়েছিলেন, যা আমাদের অহঙ্কারের আবিলতায় ঢাকা পড়ে থাকে। তিনি বললেন, ‘‘জীবের অহংকারই মায়া। এই অহংকার সব আবরণ করে রেখেছে।’’ ‘‘আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।’’ যদি ঈশ্বরের কৃপায় ‘আমি অকর্তা’ এই বোধ হয়ে গেল, তাহলে সে ব্যক্তি তো জীবন্মুক্ত হয়ে গেল। তার আর ভয় নাই। ‘‘এই মায়া বা অহং যেন মেঘের স্বরূপ। সামান্য মেঘের জন্য সূর্যকে দেখা যায় না। যদি গুরুর কৃপায় একবার অহং বুদ্ধি যায় তাহলে ঈশ্বর দর্শন হয়।
আমরা চৈতন্যহীন। তাই মায়ার কবলে পড়ে টাকার জন্য কেঁদে ভাসিয়ে দিই বটে, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কীভাবে কাঁদতে হয় জানি না। এই মায়ার সংসারে আমরা, সাধারণ মানুষ, তাই বড় অসহায়। উপদেশেও কোনও ধারণা হয় না। উটের মতো সংসারের কাঁটা ঘাসে হৃদয় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবুও শিক্ষা হয় না। কিছুদিন যেতেই যে কে সেই।
মরীচিকায় জলের ভ্রম হয়। এটি জানলে পথিক সতর্ক হয়ে যায়। সংসারে থেকে আমরা এইভাবে সতর্ক হতে পারি না। এই মরীচিকারূপ মায়া প্রতিপদে আমাদের নাজেহাল করে ছাড়ে। উদয়-অস্ত অবিশ্বাস, অসত্য, কপটতা, বিদ্বেষ, কুসঙ্গ, কর্মব্যস্ততা, অবিবেচনা, ঈশ্বর বিমুখতা, ইত্যাদি অবগুণ আমাদের কুরে কুরে খায়। একটু শান্তি পেতে কী না করি! সবাই কি শান্তি পাই? কেউ কেউ একটু আধটু পাই। কিন্তু কিছুতেই তা স্থায়ী হয় না। ফের দুঃখ ঢেলে দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যায়। পাকাপাকিভবে শান্তিকে ধরে রাখতে পারি না। বারবার মরীচিকাকেই জলাশয় ভেবে ভুল করে বসি।
ঈশ্বরে মন এলে ক্রমে বুদ্ধি সুপথে পরিচালিত হয়। মন শুদ্ধ হয়ে ওঠে। শুদ্ধ মনে সদা শান্তি বিরাজ করে। শান্ত মনে ঈশ্বর অনুভব হয়। এসব কেবল শাস্ত্রেরই কথা নয়। এটিই অতি বাস্তব সত্য। শ্রীরামকৃষ্ণ তা হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। সংসারে থেকে নানান প্রলোভনে পড়ে আমরা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই। শুদ্ধ মন কী জিনিস বুঝি না। তাই এত গোল। এত কষ্ট। ঠাকুর উপায় বলে দিলেন। একহাতে সংসার ধরো, অন্য হাতে ঈশ্বর। তারপর সময় হলে দু’হাতেই আঁকড়ে ধরো তাঁকে। অর্থাৎ, সংসার করতে করতে ঈশ্বরে মন রাখলে ঠিক-বেঠিক, ভালো-মন্দ, এসব বিচার হয়। বুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বর কৃপা করেন। বিপদ, শোক, তাপ এসব অধৈর্য করে তুলতে পারে না। সংসারের প্রতি, সমাজের প্রতি কর্তব্য-কর্ম ঠিক ঠিক হয়। ভাবনা থাকে না। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা গভীরতর হয়। তখন মন আপনা থেকেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাইকে বলছেন, ‘‘ব্যাকুলতা হ’লেই অরুণ উদয় হ’ল। ব্যাকুলতার পরই ঈশ্বর দর্শন।’’
এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে ঠাকুর সহজ সরল করে নানান উপমা সহযোগে আটটি মার্গের সন্ধান দিয়ে গেলেন সংসারপীড়িত মানুষের জন্য: ১) ঈশ্বরে বিশ্বাস, ২) সত্যে আঁট, ৩) মন-মুখের সমন্বয়, ৪) সর্বধর্মে শ্রদ্ধা, ৫) সাধুসঙ্গ, ৬) নির্জনবাস, ৭) বিচার ও ৮) প্রার্থনা।
বিশ্বাসেই আমাদের যত সংশয়। এ বিষয়ে পুরাণের একটি উপমা টেনে ঠাকুর বলছেন যে, একবার বিশ্বাস হয়ে গেলেই হল। রামচন্দ্র সাক্ষাৎ পূর্ণচন্দ্র নারায়ণ হয়েও লঙ্কায় যেতে সেতু বাঁধতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু ভক্ত হনুমান রাম নামে বিশ্বাস করে লাফ দিয়ে পাড়ি দিয়েছিল সমুদ্র, সেতুর আর দরকার হয়নি। আমরা আপ্তবাক্যেই আঁট থাকতে পারি না। সংশয় আর আশঙ্কা আমাদের লক্ষ্য ভ্রষ্ট করে দেয়।
মন-মুখ এক না-হলে অন্যের আস্থা অর্জন করা যায় না জেনেও কপটতা করতে দ্বিধাবোধ করি না। ঠাকুর বার বার করে বচনবদ্ধের কথা নানাভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। একবার তিনি জনৈক ভক্তকে কথা দিয়ে প্রায় ব্যর্থ হতে যাচ্ছিলেন। মধ্যরাতে স্মরণ হতেই ভক্তের দরজায় গিয়ে
হাজিরা দিয়ে শেষমেশ কথা রেখেছিলেন ঠাকুর।
‘যত মত তত পথ’। নানা পথের মাঝে তিনি সমন্বয়সাধনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, পানি, জল কিংবা ওয়াটার সবই এক বস্তু। নামে কিছু যায় আসে না। মিছে আমরা সেসব নিয়ে গোল বাধিয়ে দিই। পরস্পরের মধ্যে বিরোধ করে মরি ।
একটি কথা প্রচলিত আছে, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস। মানুষ কুসঙ্গে পড়ে অধোগামী হয়। ঠাকুর বললেন, সাধুসঙ্গে সদসৎ বিচার হয়। ‘‘অসৎপথে মন গেলেই বিচার করতে হয়।’’ উপমা দিয়ে বললেন, ‘‘হাতি পরের কলাগাছ খেতে শুঁড় বাড়ালেই মাহুতকে ডাঙশ মারতে হয়।’’
সংসারে সারাদিন কাজের মধ্যে ঈশ্বরে মন হয় না। তাই নির্জন বাসেরও প্রয়োজন আছে। নির্জনে ঈশ্বরে মন রাখা সহজ হয়। উপমা দিলেন, ‘‘যখন চারাগাছ থাকে, তখন তার চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে!’’
বিচার না-করে আমরা বোকামি করে বসি। ভুল করে বসি। ঠাকুর ভক্তদের বলতেন, ভক্ত হবি, তবে বোকা হবি না। সাধুকে দিনে দেখবি, রাতেও দেখবি।
প্রার্থনা ঈশ্বরকে কাছে এনে দেয়। ঠাকুর কালী মায়ের কাছে সন্তানের মতো প্রার্থনা করতেন। কথায় কথায় মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করতেন, অভিমান করতেন। জগজ্জননীর সঙ্গে কথা বলতেন। উপমা দিয়ে বললেন, যখন ছেলে পয়সা চায়, আর বারে বারে বলতে থাকে, ‘‘মা, তোর দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে দুটি পয়সা দে।’’ তখন মা ব্যাজার হয়ে তার ব্যাকুলতা দেখে পয়সা ফেলে দেয় ।’’
ঠাকুর হলেন ভক্তঅন্ত প্রাণ। তাদের কাছে না-পেলে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। চিৎকার করে ডাকতে থাকতেন, ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস, আমার কাছে আয়
আমরা চৈতন্যহীন। তাই মায়ার সাগরে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকি। সংসারযাতনা ভোগ করতে থাকি। ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। ঠাকুর তখন কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। যে-কোনও মুহূর্তে দেহ ছেড়ে দেবেন তিনি। এক দুঃসহ করুণ মুহূর্ত। রোগজীর্ণ কঙ্কালসার শরীরে একটু পাশ ফিরে পর্যন্ত শুতে পারেন না। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কাণ্ড করে বসলেন। হঠাৎ ঘোরের মধ্যে চকিতে দোতলা থেকে নীচে নেমে এলেন ঠাকুর। ভক্তের কষ্টের কথা ভেবে আকুল হয়েছেন। দিন যে ফুরিয়ে যায়! আর যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ঘটল সেই চিরঅবিস্মরণীয় ঘটনাটি। ঠাকুর ‘কল্পতরু’ হলেন সকলের মাঝে। ভক্তদের বরাভয় দিলেন অকাতরে। বললেন,‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’ ঠাকুরের এই প্রার্থনার তাৎপর্য দুর্বোধ্য ঠেকার নয়। চৈতন্যলাভ না-হলে মানবজীবন যে বৃথাই থেকে যায়।
কেবলই ভোগ আর সুখের জন্য সংঘাত করতে করতে আমরা যে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। ধর্মের নামে, জাতের নামে বজ্জাতি করা যে আমাদের মজ্জায় বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। হাহাকারে অন্তরাত্মা কেঁদে উঠছে বারবার। শ্রীশ্রীঠাকুরের এই পুণ্য আবির্ভাব তিথিতে তাঁর বরাভয় যেন সকলের উপর বর্ষিত হয়। সকলের যেন চৈতন্য হয়।