দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
আচমকা শিবের প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যান পার্বতী। একটু থেমে বলেন, এমন কথা বলছো কেন?
শিব বললেন, শিবরাত্রিতে যেভাবে ভক্তরা গ্যালন গ্যালন ভেজাল দুধ মাথায় ঢেলেছে, তাতেই ভয় হচ্ছে, করোনা ভাইরাস না হয়ে যায়!
পার্বতী একটু চিন্তান্বিত হয়ে বললেন, এই তো ভয় ধরিয়ে দিলে। তুমি এখন ক’দিন কাছে এসো না। আইসোলেশন এরিয়ায় গিয়ে থাকো।
শিব বললেন, আমার আইসোলেশন এরিয়া মানে তো শ্মশান-মশান। ওখানে গিয়ে একটু চিতার ছাই মেখে নিলেই অ্যান্টি করোনা অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে। তাছাড়া কী সব ভেজাল দুধ-ঘি মাখিয়েছে, সারা গা চুলকোচ্ছে।
পাবর্তী বললেন, কোথাও যেতে হবে না। ক’দিন কৈলাস ভবনের নীচের ঘরে থাকো, ঠিক হয়ে যাবে। নন্দী-ভৃঙ্গীকে বলি, তোমায় সাবান মাখিয়ে ভালো করে স্নান করিয়ে গায়ে একটু অ্যান্টি ফাংগাল ক্রিম মাখিয়ে দিতে।
শিব একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, হুম। তারপর কিছুটা থেমে বললেন, বুঝলে পারু, তোমার বাপের বাড়ির ব্যাপার স্যাপার এবার তেমন ভালো ঠেকল না। অন্যবার যাই কেমন যত্ন আত্তি জোটে। ভক্তরা খুব যত্ন করে। এবারের শিবরাত্রিতে তেমন কিছু জোটেনি গো!
পার্বতী বললেন, দেখো করোনা নিয়ে যা ইচ্ছে বল, কিন্তু অকারণে আমার বাপের বাড়ির বদনাম কোরো না।
শিব বললেন, বদনাম করছি না। কিন্তু এবার আমার পুজোর বদলে অন্য সব ব্যাপার নিয়ে সবাই মেতে রইল। একটা নামকা ওয়াস্তে জল ঢালা হল মাত্র। যেদিন শিবরাত্রি ছিল, সেদিন ছিল ভাষা দিবস। ফলে ভাষা দিবসের কবলে পড়ে আমার পুজোটা ভাসাভাসা রয়ে গেল। ভক্তিমার্গের তেমন লক্ষণ দেখাই গেল না।
পার্বতী বললেন, মানুষের ভক্তি কি কমছে তাহলে?
শিব বললেন, ভক্তি কমেনি গো। ভক্তির স্রোতটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভক্তি তো অন্তরের ব্যাপার। কিন্তু তোমার বাপের বাড়ির দেশে ভক্তি এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক ভক্তি। তোমার বাপের বাড়ির দেশে অনেক ভাষা, অনেক মত, অনেক সংস্কৃতি। তাই ভোটের অঙ্কে সব ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার একটা সর্বনাশা খেলা শুরু হয়েছে। যেহেতু দেশের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দি ভাষায় কথা বলে, তাই হিন্দি ভাষীর ভোট টানতে রামকে বড় করে তোলা হচ্ছে। হিন্দুরা সংখ্যাগুরু, তাই হিন্দুত্বের জিগির তুলে সব হিন্দু ভোট এককাট্টা করার বেনিয়াবৃত্তি চলছে। দলীয় রাজনীতি একটা পণ্য ছাড়া আজ আর কিছু নয়। তাই রামের বড় মূর্তি হবে, রামের বড় মন্দির হবে, আর আমার তেমন কদর চোখেই পড়ল না। ওই নমো নমো করে একটা কিছু।
পার্বতী অবাক হয়ে বললেন, ও মা রামকে পুজো করে ভোট পাওয়া যায়, আর তোমাকে পুজো করে কিছুই মেলে না নাকি?
শিব বললেন, হয়তো মেলে, তবে এবারের নৈতিক ভোটে আমি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি দেখলাম। আগে দেখতাম, ‘ব্যোম ব্যোম ভোলে’ বা ‘হর হর মহাদেব’ স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হতো। এখন শুধু ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘জয় বজরংবলী’। তবে আমার মনে হয়েছে, ষাঁড় না হয়ে আমার বাহন গোরু হলে ভালো হতো। ওখানে গোরুর খুব কদর। ওরা গোরু নিয়ে যেমন মাতামাতি করে ভাবা যায় না। ওখানে তো গোবলয় বলে একটা বিশাল এলাকাকেই বোঝানো হয়। যেসব গোভক্তরা আছেন, তাঁরা কিন্তু বেশ হাড্ডাকাড্ডা। মাথায় তাঁদের ফেট্টি বাঁধা। গোরুর বিরাট ভক্ত সব। তুমি গোভক্ত না হলেই বিপদ। ওখানে রোগ হলে গোমূত্র পান করিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা চলছে। ক্যান্সারে নাকি গোময় খেয়ে রোগ সারানো যায়। মহাভারত, রামায়ণের চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিজ্ঞানকে আবার সব নতুন করে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা চলছে। বলছে, এখনকার বিজ্ঞান মিথ্যা। এখনকার বিজ্ঞানীরা নাকি সব গাধা। ওরা বলছে, গোরুর দুধে সোনা আছে। এই যে এত দুধ ঢালল, চুলকুনি ছাড়া আর কী পেলাম বলতো!
কবি ভারতচন্দ্র আমার সম্পর্কে যে কবিতা লিখেছিলেন, সেখানে উনি ব্যজস্তুতির ঢংয়ে বলেছিলেন, ‘কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ / কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।’ সেখানে দেবী অন্নপূর্ণা রূপে তুমি নিন্দার আড়ালে আমার প্রশংসা করেছিলে। আমার পঞ্চমুখ। তাই আমি পঞ্চানন। আমার কণ্ঠভরা বিষ, তাই আমি নীলকণ্ঠ। আর তোমার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব। মানে মিলন। কিন্তু এখনকার সময়ে সেই কথার সবটাই খারাপ অর্থে ব্যবহার করা যায়। এখনকার বেশিরভাগ রাজনীতিকের মুখে শুধু কুকথা, তাঁদের ভাষা বিষাক্ত। এত সাজিয়ে গুছিয়ে ভাষা দিবস পালন করেন, অথচ তাঁদের মুখের কী ভাষা! আর কেবল বিরোধী দলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। মারামারি, খুনোখুনি ছাড়া কি রাজনীতি হয় না?
পার্বতী বললেন, সত্যি তোমার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
শিব বললেন, আরও আছে, এবার গিয়ে দেখলাম সর্বত্র এলাহি আয়োজন। আমি ভাবলাম, আমার জন্য বুঝি এত সাজসজ্জা, আয়োজন। ও বাবা, পরে শুনলাম, আমেরিকা থেকে টেম্পো সাহেব আসবেন, তাঁর তেলা মাথায় তেল দিতে শত কোটি টাকা রাজকোষ থেকে ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে।
পার্বতী বললেন, কেন, ওনাকে এত খুশি করার চেষ্টা কেন?
শিব বললেন, দেখো পারু, পৃথিবীটা চিরকালই শক্তের ভক্ত। উনি এসে একটু মুচকি হাসবেন, কত্তামশাইয়ের কাঁধে হাতটি রেখে বলবেন, উনি একজন অসাধারণ রাজামশাই। ব্যস সব টাকা উসুল হয়ে যাবে। তবে টেম্পো মশাই কিন্তু খুব চালাক। ওনার নিয়মই হল, ফেল কড়ি মাখো তেল। উনি এসে কত টাকার অস্ত্র বিক্রি করে যাচ্ছেন জানো?
পার্বতী অবাক হয়ে বললেন, এত অস্ত্র কী হবে গো? অনেক অস্ত্রই তো আছে।
শিব বললেন, ঠিক বলেছো, যে যুদ্ধ করতে জানে, কম অস্ত্রেই বাজিমাত করতে পারে। যেমন তুমি, তোমাকে এতগুলো অস্ত্রে সজ্জিত করে অসুর বধের জন্য পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু আমার ওই এক ত্রিশূলেই তোমার কার্যসিদ্ধি হয়েছিল। আসলে ওই অস্ত্র কেনার লক্ষ্য হল টেম্পো সাহেবকে তুষ্টু করা। যুদ্ধুর জন্য অস্ত্র, না তুষ্টু করার জন্য অস্ত্র, তা বলা সহজ ব্যাপার নয়। অস্ত্র কেনাটাই হল একটা রাজনৈতিক অস্ত্র। তার জন্য কত্তামশাই গরিবি লুকোচ্ছেন। সব গরিব লোককে পাঁচিল তুলে দৃষ্টির আড়ালে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই লুকনো ওনার একটা বিশেষ লক্ষণ। দেশের অর্থনীতি লুকোচ্ছেন, বাণিজ্য লুকোচ্ছেন, সাংবাদিকদের থেকে নিজেকে লুকোচ্ছেন। শুধু হিন্দুত্বের কার্ডটাই প্রকাশ্যে খেলছেন।
পার্বতী বললেন, এই হিন্দুত্ব ভয়ংকর একটা খেলা। হিন্দু দেবদেবীদের পুজোর পুরোটাই তাহলে একটা রাজনৈতিক খেলা?
শিব বললেন, হ্যাঁ, সেটাই। এখন আবার উনি ভয়ে ভয়ে আছেন। টেম্পো সাহেব এসে যদি এই ধম্মগিরি নিয়ে কোনও খোঁচা মেরে দেন! ব্যস, তাহলে তো সব বেলুন চুপসে যাবে। টেম্পোভক্তি বেরিয়ে যাবে।
পার্বতী বললেন, হুম।
শিব বললেন, আর একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। সেটা হল, যে মানুষটি নিজেকে দেশের চৌকিদার বলে জাহির করেন। কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে সেটা প্রচারও করেন, তাঁর নিরাপত্তার দেখভাল করতেই প্রতিদিন নাকি কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায়। এক চৌকিদারকে নিরাপত্তা দিতে হাজার চৌকিদার তাঁকে ঘিরে থাকছে। তার মানে পুলিশের নিরাপত্তার জন্য আরো পুলিস দরকার। সেনাদের নিরাপত্তার জন্য আরও সেনা দরকার, তাদের নিরাপত্তার জন্য আরও সেনা দরকার। ভাবো, তাহলে শুধু মানুষেরই নিরাপত্তা নেই। মানুষ যেন ফুটবল। যারা শক্তিশালী তারাই লাথি মেরে সারা মাঠে দৌড় করাচ্ছে। আমি তো গাঁজা-ভাঙ খাই আনন্দে। আর দেশের যুবকরা চাকরি না পেয়ে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়ে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। খড়কুঠোর মতো আঁকড়ে ধরছে মদ, হেরোইন সহ নানা ধরনের নেশাকে। তরুণ সমাজ যেন অবসাদে নুয়ে পড়েছে। আর অর্ধশিক্ষিত নেতাদের বছরের পর বছর সম্পত্তি বেড়েই চলেছে।
গম্ভীর হয়ে যান পার্বতী। সেই বেদনা যেন তাঁকেও স্পর্শ করেছে।
নন্দী এসে বললেন, প্রভু চলেন, গরম জল রেডি। আপনারে সিনান করিয়ে দিই।
শিব উঠতে উঠতে বললেন, বুঝলে পারু, আমার মনে হচ্ছে, আবার একটা তাণ্ডব নৃত্য চালাতে হবে। তখন তুমি ছিলে আমার কাঁধে। সতীরূপে। দক্ষযজ্ঞের আসর থেকে তোমার দেহটা নিয়ে আমি সমস্ত জগৎকে লয় করে দিতে চেয়েছিলাম। এবার ধর্মান্ধতা, কুশিক্ষা আর অত্যাচারে মৃত মানবাত্মার দেহটাকে নিয়ে আমি প্রলয় নাচন নাচব। মিথ্যা ধর্মের বিনাশ করব, রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজিকে ধ্বংস করব। ধর্ম হল সেটাই, যা মানুষের কল্যাণ করে। বাজারে এখন ধর্মের মোড়কে বিক্রি হচ্ছে অধর্মের চরস। তাই খেয়ে একদল বুঁদ হয়ে যাচ্ছে, আর অন্যদল যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে। তোমার দেহ যেমন বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছিল এবং তৈরি হয়েছিল এক একটা শক্তিপীঠ। মানুষের শক্তিও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে তৈরি হবে শক্তিপীঠ। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে অসংখ্য নিপীড়িত মানুষের শক্তি। আমাদের আশীর্বাদ ওদের সঙ্গে থাকবে। মানুষের সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিনাশ হবে অশুভ শক্তির।
শিব থামতেই নন্দী বলে উঠলেন, জয় ভোলানাথ বাবার জয়।