গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
২০১৩ সালের পয়লা বৈশাখের কথা মনে আছে? সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে সেদিন উত্তাল হয়েছিল বাংলা। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছিল কয়েক লক্ষ বিনিয়োগকারীর। তার কয়েকদিনের মধ্যেই কাশ্মীর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সারদাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন। তারপর কত ভোট গিয়েছে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। সারদা পেরিয়ে তদন্তকারীদের নজর পড়েছে রোজভ্যালি সহ আরও নানা চিটফান্ডের উপর। কত জেরা, গ্রেপ্তার, তল্লাশি। আতঙ্কে মারা গিয়েছেন দুই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব সুলতান আহমেদ ও তাপস পাল। কিন্তু আজ ওই ঘটনার পর প্রায় সাত বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, প্রকৃত সত্য সামনে আসেনি। গরিব আমানতকারীরা তাঁদের টাকাও ফিরে পাননি। তাহলে এসবই কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ?—প্রশ্ন তুলেছেন স্বয়ং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর এই ক্ষোভ মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। দোষ করলে নিশ্চয়ই শাস্তি প্রাপ্য। তবে আইনকে আইনের পথে চলতে দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক কারণে আইনকে ব্যবহার করা উচিত নয়। এভাবে যে রাজনৈতিক জমি দখল সম্ভব নয়, বাংলার মানুষ তার মুখের মতো জবাব দিয়েছেন সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে। আগামী পুরভোট থেকে শুরু করে পরের বছরের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত তার কোনও অন্যথা হবে বলে মনে হয় না।
সরকারি ঘোষণা না হলেও জানা গিয়েছে, কলকাতা ও হাওড়ায় ভোট হবে আগামী ১২ এপ্রিল। আর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বাকি ১০০টি পুরসভায় নির্বাচন ২৬ এপ্রিল। নিঃসন্দেহে আগামী বছরের গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই শতাধিক পুরসভার ভোট শাসক ও বিরোধীদের কাছে সেমিফাইনাল। আগামী মার্চের মাঝামাঝি পুরভোটের বিজ্ঞপ্তি জারির সঙ্গে সঙ্গে এরাজ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে শুরু করবে, যা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছবে এপ্রিলে। তবে তার আঁচ থাকবে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। ২০১৯-এর লোকসভার ভোটে উত্তরবঙ্গে ও দক্ষিণবঙ্গের কিছু অংশে বিজেপি যেভাবে তৃণমূলের ভোটে থাবা বসিয়েছিল, সেই ট্রেন্ডই বহাল রয়েছে নাকি তৃণমূল তার হারানো জমি গত একবছরে পুনরুদ্ধার করে ফেলেছে, তারই অগ্নিপরীক্ষা আসন্ন এই ভোট। ইতিমধ্যেই, মাস কয়েক আগে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তৃণমূল তিনটি আসনের সবক’টিতেই জয়ী হয়ে বিজেপি এবং সিপিএম-কংগ্রেস জোটকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এনআরসি, মূল্যবৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান আর্থিক সঙ্কট ও তার মোকাবিলায় মোদি সরকারের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই আসন্ন শতাধিক পুরসভার ভোটে তৃণমূলেরই একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থাকবে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা।
তবে ফল যাই হোক, শাসক বা বিরোধী যার ভাগ্যের শিকেই ছিঁড়ুক না কেন সাধারণ মানুষের একটাই প্রার্থনা, ভোট যেন শান্তিপূর্ণ হয়। সবাই যেন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। বিরোধীরা যেন নির্ভয়ে মনোনয়ন পেশ ও প্রচার করতে পারে। ক্ষণিকের উত্তেজনায় রক্তপাত, প্রাণহানির মতো দুর্ভাগ্যজনক কোনও ঘটনা যেন না ঘটে। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে ১০২টি পুরসভার মধ্যে অন্তত ৯৫ থেকে ৯৭টি পুরসভা তৃণমূলের দখলে যাওয়া নিশ্চিত। এই হিসেবের কিছু কমবেশি হলেও, তেমন তুল্যমূল্য প্রতিরোধ বিরোধীরা গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। কলকাতা ও হাওড়ায় ১২ এপ্রিলের ভোটে তৃণমূলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনও সংশয়ই নেই। শাসক দলের জয় নিয়ে কোনও সংশয় না থাকলেও, যে বিষয়টি ভাবাচ্ছে তা হল—দু’বছর আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো হাঙ্গামা হবে না তো! গণতন্ত্রে শান্তি বজায় রাখা শাসক ও বিরোধী উভয়েরই অবশ্যকর্তব্য। একইসঙ্গে বিরোধীদের প্রচার ও মনোনয়ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করা এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়াও প্রশাসনের দায়িত্ব। আজ ক্ষমতা হারিয়ে যে বামপন্থীরা প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র বাঁচানোর কথা বলছেন, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই, ২০০৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল পশ্চিমবঙ্গের এ যাবৎকালের অন্যতম রক্তাক্ত গ্রামীণ ভোট। শুধু মুর্শিদাবাদেই সেবার ৪৫ থেকে ৫০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৭৬ জনের। বিরোধী দলের অনেকেই মনোনয়ন পর্যন্ত পেশ করতে পারেননি। কিংবা বলা ভালো, পেশ করতেই দেওয়া হয়নি। চারদিকে তখন ভয় আর আতঙ্কের পরিবেশ। সেই রক্তাক্ত পঞ্চায়েত ভোট যাঁরা পরিচালনা করেছিলেন, সেই বামপন্থীরাই আজ তৃণমূলের দিকে আঙুল তোলেন কোন স্পর্ধায়? ২০০৩ সালে সরকারি হিসেবই বলছে, ১১ শতাংশ পঞ্চায়েত আসনে বামপন্থীরা সেবার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জয় হাসিল করেছিল। ১৯৭৭ এর নির্বাচনে সিদ্ধার্থশঙ্করবাবুরাও একতরফা ভোট লুট করিয়েছিলেন। তাহলে এই রাজনীতির পথপ্রদর্শক কারা? এসবই প্রমাণ করে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বামফ্রন্টের আমল থেকেই শাসক দল বরাবর বিরোধীদের উপর দমন-পীড়নের নীতি প্রয়োগ করে আসছে। এটা মোটেই নতুন কিছু নয়। যেমন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও এরাজ্যের পক্ষে মোটেই সুখকর ছিল না। ওই নির্বাচনও বহু মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। ৩৪ শতাংশ আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। সেখানে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
কিন্তু, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। মাত্র এক বছর পরেই বিধানসভার ভোট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে পরপর তিনবার বাংলায় ক্ষমতা দখলের সুবর্ণ সুযোগ। এই অবস্থায় শাসক তৃণমূলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের উচিত সংযত থাকা। সেইসঙ্গে গণ্ডগোল, রক্তপাত এড়ানোর সবরকম চেষ্টা করা। তাহলেই এরাজ্যের মানুষ আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্দ্বিধায় আরও একবার দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন। কোনও মানুষই গণ্ডগোল, রক্তপাত হানাহানি এসব চান না। শাসকদলের নিচুতলার কর্মী সমর্থকদের অহেতুক বাড়াবাড়ি ছাড়তে হবে। রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে এবং নতুন করে বিনিয়োগ টানতে শান্তি ও সুস্থিতির প্রয়োজন সর্বাগ্রে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য নেতৃত্ব গত প্রায় এক দশক ধরে সেই রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। রাজ্য প্রশাসনকে আরও মানবিক ও সংবেদনশীল করে তুলেছে। এখন তাঁর সেই সুযোগ্য নেতৃত্বের উপর ভিত্তি করে আরও এগিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত। রাজ্যের গড় জিডিপি দেশের উৎপাদন হারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সম্প্রতি বাজেট বক্তৃতাতেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এই তথ্য জানিয়েছেন। রাজ্যের মানুষও এই সরকারের কাজকর্মে আগাগোড়া আস্থাবান। বিশেষ করে সারা দেশে রাজ্যস্তরে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের দলের পিছু-হটা যখন শুরু হয়ে গিয়েছে তখন পশ্চিমবঙ্গই বা বিকল্প পথে হাঁটবে কেন?
নানা কারণে বিজেপি সর্বভারতীয় স্তরে একের পর এক রাজ্যে জনপ্রিয়তা হারালেও, কংগ্রেস কিন্তু সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। গত একবছরে একের পর এক রাজ্য গেরুয়া দলের হাতছাড়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, দিল্লিতে আপ, বিহারে নীতীশের জেডিইউয়ের মতো আঞ্চলিক দলগুলি আরও বেশি করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। সেই ফাঁকেই কংগ্রেস ও বামপন্থীরা ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমে যেন অবান্তর হয়ে যাচ্ছে! সদ্য সমাপ্ত দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে সিপিএম যে তিনটি আসনে লড়েছিল, সবেতেই জামানত জব্দ হয়েছে। কংগ্রেস মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, শীলা দীক্ষিতের নেতৃত্বে এই দিল্লিতেই কংগ্রেস কিন্তু টানা ১৫ বছর শাসন করেছে। আর আজ তাদেরই দিল্লিতে কোনও গ্রহণযোগ্য নেতা নেই। কংগ্রেসি ভোটব্যাঙ্কেও সফল সিঁদ কেটেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল নামক এক ধূমকেতু! আবার পশ্চিমবঙ্গেও টানা ৩৪ বছর বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খাওয়ানো সিপিএম আজ স্রেফ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইটাই লড়ছে। জেলায় জেলায় সংগঠন বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই সম্মিলিত বামেদের। তরুণ প্রজন্মও আর সেভাবে বাম রাজনীতির মোহে ছুটে আসছে না। রাজনীতির এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় শিক্ষা। এক কূল ভাঙে আর এক কূল গড়ে। যখন কাউকে দেয় সেটা ছপ্পড় ফাড়কে, কিন্তু যখন ফকির করে তখন তার মতো নির্দয় আর কিছুই হয় না। ইতিহাস বারবার এই শিক্ষা দিলেও শাসকের টনক নড়ে না। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, ক্ষমতার বাড়াবাড়ি রকম ব্যবহার সব চলতে থাকে অবলীলায়। আজ যেমনটা হচ্ছে উত্তরপ্রদেশে। খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ সবই যেন যোগীরাজ্যের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। দিল্লির ভোটেও গেরুয়া দলের এই ‘গোলি মারো শালো কো’ সংস্কৃতির নগ্ন ব্যবহার দেখেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ গত লোকসভার ভোটে এই মানুষগুলিই বিজেপিকে ‘সাতে সাত’ দিয়েছিল!
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের নিচুতলার পার্টিকর্মীদের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ রুখতে ঠিক সময়ে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি চালু করে মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছেন। আজ, ভোটপণ্ডিত প্রশান্ত কিশোরের লোকজন প্রতিটি জেলায় ও শহরে তৃণমূলের ছোট বড় নেতাদের সম্পর্কে যেভাবে তথ্য সংগ্রহে নেমেছেন, তাতে সব ধরনের দুর্নীতি কমেছে বলেই খবর পাচ্ছি। আগামী বছর ভোটে জিতে বাংলার অগ্নিকন্যা ফের মুখ্যমন্ত্রী হলে এক উন্নততর তৃণমূলকে আমরা পাব বলে আশা করা যায়। অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার আমাদের দেখা হয়নি। সৎ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কিছু ভুলের কারণে বামফ্রন্টের সলিল সমাধি হয়েছে বলা যায়। কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ভুল করেননি। কোর ভোটব্যাঙ্কটাকে তিনি যেমন আঘাত করেননি, তেমনি উন্নয়নে গতিসঞ্চার এবং দলের দুর্নীতি মোকাবিলার প্রশ্নেও তিনি কোনওরকম আপস করতে নারাজ। আর সেইজন্যই আসন্ন পুরভোটে বিরোধীদের যেমন বিশেষ সম্ভাবনা দেখছি না, তেমনি নবান্নে তৃতীয়বারের জন্যে মমতার সরকার আসাটাও শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে মনে হচ্ছে।