বিদ্যার্থীদের মানসিক স্থিরতা রাখা দরকার। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। তবে নতুন বন্ধু লাভ হবে। সাবধানে পদক্ষেপ ... বিশদ
যে কোনও নির্বাচনেই মুখ একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আর সেই ভোট যদি হয় পঞ্চায়েত বা পুরসভার মতো তৃণমূল স্তরের, তখন ভোটারদের কাছে প্রার্থীর মুখই প্রাধান্য পায়। তাই পুরভোটে মানুষের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করাটাই যে কোনও দলের আসল কাজ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বকে প্রার্থী করলে লড়াইটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু, প্রার্থী বাছাইয়ে লবিবাজি, গোষ্ঠীবাজি প্রাধান্য পেলেই ঘনায় বিপদ। অপছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি করার জন্য দরকার হয় জোরজবরদস্তির। তখনই হয় মারামারি, খুনোখুনি।
তৃণমূল স্তরের ভোটে মুখ যে একটা বড় ফ্যাক্টর তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে উন্নয়ন নজর কাড়লেও বেশ কিছু এলাকায় তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছিল। তবে, সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর। জেলা পরিষদের সভাধিপতি ছিলেন বলরামপুরের সৃষ্টিধর মাহাত। তাঁর ছেলে সুদীপ মাহাত ছিলেন বলরামপুর ব্লকের তৃণমূলের সভাপতি। সেই সুদীপবাবুই আবার ছিলেন বলরামপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি। দলটাকেই প্রায় পকেটে পুড়ে ফেলেছিলেন। অভিযোগ, বলরামপুরে চলত বাপ-বেটার রাজত্ব।
বাপ-বেটার দাপটে বিরোধীরা তো বটেই, দলের কোনও নেতা তাঁদের বিরুদ্ধে রা কাড়তেন না। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে সৃষ্টিধরবাবুর বিরুদ্ধে জেলা পরিষদ আসনে কেউ প্রার্থীই হতে চাইছিলেন না। কাউকে প্রস্তাব দিলেই কোনও না কোনও অজুহাতে পাশ কাটিয়ে দিতেন। জলে বাস করে কে আর কুমিরের সঙ্গে শত্রুতা করতে চায়? শেষপর্যন্ত দাঁড়ালেন এক সময় তাঁরই অধীনে কাজ করা রঘুনাথপুরের প্রাক্তন মহকুমা তথ্য আধিকারিক গোপীনাথ গোস্বামী। শুধু দাঁড়ালেনই না, হারিয়েও দিলেন। ব্যবধানটাও চোখ কপালে ওঠার মতো। ১০ হাজারেরও বেশি। যাকে বলে, নিঃশব্দে ইন্দ্রপতন। অথচ গোপীনাথবাবুকে সাধারণ মানুষ চিনতেনই না। সেই অর্থে তিনি কোনও মুখই ছিলেন না। তবুও তিনি জিতেছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন বহু মানুষের ‘অপছন্দে’র মুখের প্রতিদ্বন্দ্বী।
সৃষ্টিধরবাবু ভুঁইফোঁড় বা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনও নেতা ছিলেন না। বরং ‘মাওবাদীদের আঁতুড়ঘর’ বলরামপুরের বুকে তাঁর বুক চিতিয়ে লড়াই জঙ্গলমহলের স্যালুট কুড়িয়েছিল। সেই লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রথমবার জেলাপরিষদে জিতেই সভাধিপতি। গরিবের সঙ্গে মুড়ি ভাগ করে খাওয়া সৃষ্টিধরবাবুর সামনে পিছনে তখন নিরাপত্তারক্ষী। নিরাপত্তা বেষ্টনীর ঘেরাটোপে থাকতে থাকতে কখন যে তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তা সৃষ্টিধরবাবু নিজেও হয়তো বুঝতে পারেননি। মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়িয়েও তিনি বুঝতে পারেননি, তাঁরই পিছনে থাকা লোকগুলির কাছে তিনিই সব চেয়ে বেশি অপছন্দের মুখ। উল্টে ভাবতে শুরু করলেন, তিনিই বলরামপুরের শেষ কথা। ফলও মিলল হাতে নাতে। যে বলরামপুরের বুকে লড়াই করতে করতে সৃষ্টিধরবাবু ‘মাওবাদী উন্নয়ন কমিটি’র মুখ হয়েছিলেন, সেই বলরামপুরের মাটিতেই তিনি মুখ থুবড়ে পড়লেন। শুধু সৃষ্টিধরবাবু বা তাঁর ছেলেই হারলেন না, তাঁরা গোটা দলটাকে নিয়ে ডুবলেন।
বলরামপুর বা সৃষ্টিধর মাহাত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে রাখতে হবে, যেখানে ক্ষমতা, সেখানেই বলরামপুর, সেখানেই সৃষ্টিধর মাহাত-র মতো কিছু লোক আছেন।
ক্ষমতা শুধু অতীতকেই ভুলিয়ে দেয় না, ভবিষ্যৎ উপলব্ধির ক্ষমতাও কেড়ে নেয় অনেকসময়। সেই কারণেই আস্ফালনের মিটার তখন চড় চড় করে বাড়ে। পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে শাসক দলের বিপর্যয় কারণ অনুসন্ধানে উঠেছে এসেছে ক্ষমতার আস্ফালনের বিষয়টি। তাই অনেকেই বলছেন, পুরভোটে আগাম সতর্কতা দরকার। ক্ষোভ একবার জনসমক্ষে এলে তা মেরামত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
লোকসভা ভোটে ধাক্কা খেতেই তৃণমূল নেতৃত্ব ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামতে দেরি করেনি। ময়দানে নামিয়েছে পেশাদার ভোট বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোরকে। শোনা যাচ্ছে, পুরভোটের জন্য অনেক আগেই পিকে তাঁর টিমকে বাজারে ছেড়ে রেখেছেন। গ্রাম, শহর সর্বত্র তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি চলেছে গ্রহণযোগ্য মুখের খোঁজ। ওয়ার্ড ধরে ধরে গ্রহণযোগ্য চারটি নামের তালিকাও নাকি তৈরি। সেই রিপোর্ট এখন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে। রিপোর্টে নাকি বেশ কিছু জনপ্রতিনিধির আয়, সম্পত্তি ও জীবনযাত্রার মানের উল্লেখ আছে। আর তাতেই অনেকের বুক ঢিপ ঢিপ করছে।
এখন দেখার, তৃণমূল নেতৃত্ব মানুষের অপছন্দের মুখগুলিকে ছেঁটে ফেলতে অথবা সাইড লাইনে পাঠাতে পারে কি না। এবার পুরভোটে তৃণমূলের সেটাই আসল পরীক্ষা। অনেকেই বলছেন, টিকিট না পেয়ে কোনও কোনও কাউন্সিলার বিরোধী শিবিরে গেলেও দু’চারজন ছাড়া বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না। কারণ তৃণমূলটা চলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে। উল্টে প্রার্থী বাছাই ঠিকঠাক হলে পুরভোটে তৃণমূলের অ্যাডভান্টেজ নিশ্চিত। কারণ স্রেফ রাস্তাঘাট, পানীয় জল, আলোর নিরিখে ভোট হলে তৃণমূলকে ঠেকানো কঠিন।
হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি প্রভৃতি রাজ্যে গেরুয়া শিবিরের ভরাডুবি হলেও এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিই তৃণমূলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। পুরসভা নির্বাচনে বিজেপির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, তারা চাইলেই স্বচ্ছ ইমেজের প্রার্থী দিতে পারবে। ইচ্ছা করলেই তৃণমূল এবং সিপিএম থেকে আসা অপছন্দের মুখগুলি বাদ দিতে পারবে। বাদ দিলেও বিজেপির ক্ষতি করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। ওই সব নেতা দাঁড়িয়ে আছেন গুচ্ছমূলের উপর, মাটির গভীরে শিকড় নেই।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি একধার থেকে তৃণমূলছুট লোকজনকে পদ্মের প্রতীক দিয়েছিল। বহু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিল। কিন্তু, লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি পার্টি অফিসে লোকজনের যাতায়াত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই পুরভোটে প্রার্থী হতে আগ্রহী লোকজনের সংখ্যাও বাড়বে। তবে পুরভোটেও তৃণমূল ও সিপিএমের ‘ছাঁট’দের প্রার্থী করলে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব স্বয়ং দিলীপ ঘোষও ঠেকাতে পারবেন না। ইতিমধ্যেই আরামবাগ সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় নতুনদের গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগ তুলে ‘বিজেপি বাঁচাও কমিটি’ তৈরি হয়েছে। পুরসভা নির্বাচনের আগে সেই প্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে একের পর এক রাজ্যে বিজেপির হারে বেজায় খুশি সিপিএম। সম্ভবত তৃণমূলের চেয়েও। কারণ এরাজ্যে বিজেপির প্রভাব কমার উপরেই নির্ভর করছে সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানো। দিল্লিতে লোকসভা ভোটের তুলনায় বিজেপির ১৬ শতাংশ ভোট কমায় সিপিএম নেতৃত্ব আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। সিপিএম মনে করছে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে শক্তিক্ষয় হলেই এরাজ্যেও বিজেপির কর্মী সমর্থকদের মনোবল দুর্বল হবে। আর আশ্রয় দুর্বল হলেই অন্য ঘরের সন্ধান করাটাই মানুষের প্রবৃত্তি। বিজেপিতে যাওয়া বাম কর্মী সমথর্কদের সিপিএমে ফেরার সম্ভাবনা বাড়বে। তাতে তৃণমূলের সাময়িক লাভ হলেও অদূর ভবিষ্যতে তারাই নাকি ফায়দা তুলবে। অঙ্ক মিলুক বা না মিলুক, কষতে তো বাধা নেই।
এবার একসঙ্গে শতাধিক পুরসভার নির্বাচন। তাই অনেকেই বলছেন, এটা নাকি ‘মিনি বিধানসভা’ নির্বাচন। তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পুরভোট হবে, নাকি ভোট করানো হবে?
পুরসভা বা পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলি রাজ্যের নির্বাচন কমিশন দ্বারা পরিচালিত। ফলে সর্বত্রই শাসকদল তার সুযোগ নেয়। এরাজ্যে বাম জমানায় সিপিএম নিত। ফলে, হাজার হাজার আসন বিনা ভোটে জিতত। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৮ সালেও কোনও কোনও জায়গায় একই কায়দায় পঞ্চায়েত ভোট করিয়েছিল। ত্রিপুরাতেও বিজেপি ক্ষমতায় বসে একই কায়দায় ৯০ শতাংশেরও বেশি আসনে স্রেফ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে।
কিন্তু, ‘ভোট করানো’র ফল যে সুদূরপ্রসারী হয়, তার প্রমাণ এরাজ্য দেখেছে। পঞ্চায়েতে ‘ভোট করানোর’ খেসারত শাসক দলকে মেটাতে হয়েছে লোকসভা নির্বাচনে। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে শাসক দল সত্যি সত্যিই শিক্ষা নিয়েছে কি না সেটাও পুরভোটে প্রমাণ হবে।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, পঞ্চায়েতের কায়দায় ভোট না করিয়ে উপ নির্বাচনের মতো ভোট হলে তৃণমূলেরই লাভ। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিলে হয়তো তৃণমূল কিছু আসনে হারবে বা বড়জোর কয়েকটি পুরসভা হাতছাড়া হবে। কিন্তু, মানুষের আস্থা অর্জন নিশ্চিত। যার বেনিফিট তৃণমূল পাবে ২০২১ সালে।