বিদ্যার্থীদের মানসিক স্থিরতা রাখা দরকার। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। তবে নতুন বন্ধু লাভ হবে। সাবধানে পদক্ষেপ ... বিশদ
ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে যে রিপোর্টটি পাওয়া গেল, সেটির অভিঘাত সুদূরপ্রসারী। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক রিপোর্টের নাম ‘রিপোর্ট অন ট্রেণ্ড অ্যাণ্ড প্রোগ্রেস অফ ব্যাঙ্কিং ইন ইন্ডিয়া’। সেখানে স্বীকার করা হয়েছে, ভারতের মানুষ সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে নিজেদের টাকা জমা রাখা অথবা ইনভেস্ট করার প্রবণতা বেসরকারি ব্যাঙ্কের দিকে শিফট করে নিচ্ছে। আপাতভাবে এই বিশ্লেষণ দেখে মনে হবে এতে এমন আর কী ক্ষতি হচ্ছে? মানুষ যেখানে সুবিধা বেশি পাবে, সেখানেই যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা নয়। বরং এই মনোভাব ভারতের মতো দেশে চরম উদ্বেগজনক। কারণ মানুষের এই আচরণের সঙ্গে একটি চিন্তাজনক বার্তা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, শাসক দল, রাষ্ট্রের কাছে। সেটি হল মানুষ আর সরকারি ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ‘আমার টাকা সরকারি ব্যাঙ্কে আর নিরাপদ নয়’, এরকম মনোভাব কি তৈরি হচ্ছে? যদি হয়, তা হলে সেটা মারাত্মক এক নেতিবাচক ইঙ্গিত। বস্তুত মোদি সরকারের কাছে বৃহত্তর উদ্বেগের জায়গা ক্রমেই কিন্তু এটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে দ্বিতীয় মোদি সরকারের সরকারি সিস্টেমের প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। ব্যাঙ্কের রিপোর্ট তারই একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ। এবার আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
অসমের বক্সা জেলার তামুলপুর গ্রামের জাবেদা বেগম মহাসঙ্কটে পড়েছেন। জমির রাজস্ব রশিদ, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাঙ্ক পাসবই, ১৯৬৬ সাল থেকে বাবা-মায়ের ভোটার তালিকায় নাম থাকার প্রমাণপত্র, গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের প্রদান করা ম্যারেজ সার্টিফিকেট ইত্যাদি মোট ১৫টি সরকারি নথি মেনে নিতে রাজি হয়নি গুয়াহাটি হাইকোর্ট ও প্রশাসন। ওই নথিগুলির একটিও জাবেদা বেগমের নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র নয় বলে প্রশাসন জানিয়েছে। জানিয়েছে হাইকোর্টও। এখন একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট ভরসা। কেন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন তিনি? কারণ যে বাবা-মায়ের ভোটার তালিকার প্রমাণপত্র তিনি দাখিল করেছেন, তাঁরা যে তাঁরই বাবা মা এটা প্রমাণ করতে পারছেন না তিনি। যে ভাইয়ের সব কাগজপত্র নাগরিকত্ব প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, তিনি যে সত্যিই জাবেদার ভাই এটাও প্রমাণ করা যাচ্ছে না। এই মহাসঙ্কটে ৫০ বছরের নিরক্ষর জাবেদা বেগম গুয়াহাটি থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে এসে দিশাহারা হয়ে ঘুরছেন। এই ঘটনাটি অস্বাভাবিক নয়। বলা যেতেই পারে অসমে এনআরসি চালু হয়েছে। সেখানে তো প্রমাণ করতেই হবে নিজেকে। মহামান্য আদালত প্রমাণ না পেলে কেন নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বলবে? একদম ঠিক। কিন্তু প্রশ্নটা আমাদেরও চরম বিপদে ফেলছে। কারণ আমাদের কাছে কী প্রমাণ আছে যে আমরা ভারতের নাগরিক? স্বয়ং সরকারই বলছে, এনআরসি করা দরকার যাতে নাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে এখন আমরা কী করব? সরকার বলেছে, এখন আমাদের কাছে থাকা কোনও কার্ডই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। অর্থাৎ সেটা মেনে নিলে আজ আমাদের মতো বৈধ নাগরিকের যে স্ট্যাটাস, একজন অনুপ্রবেশকারীরও একই স্ট্যাটাস রাষ্ট্রের চোখে।
বহুবছর আগে বলা হল, ভোটার কার্ড ছাড়া ভোটদান হবে না। ওটাই আমাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ জানলাম সেদিন। আমি যদি ভারতের নাগরিক হই, তাহলেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে। তাই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের জন্য ভোটার কার্ড দিলেই হয়ে যেত। দিন কেটে গেল। আবার একদিন প্রশ্ন শুরু হল, আপনি ভারতের নাগরিক? আয় করেন ভারতে? তাহলে প্যান কার্ড করান। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। হঠাৎ দিকে দিকে বার্তা রটে গেল, আধার নামক একটি কার্ড করতে হবে। ওটাই ভারতের নাগরিকত্বের সবথেকে মোক্ষম প্রমাণপত্র। কারণ ব্যাপারটা ডিজিটাল। বায়োমেট্রিক শব্দটা শুনে আমাদের সমীহ হল। আমরা আমেরিকা হয়ে যাচ্ছি এরকম একটা আলোচনাও চলল। আধার নিয়ে মারাত্মক বাড়াবাড়িও শুরু হল পূর্বতন ইউপিএ সরকারের সময়, যা এখনও মোদি সরকারের আমলে হচ্ছে। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডে বহু গরিব মানুষ রেশন না পেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটান এখনও। কারণ তাঁদের রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ হয়নি। অন্যদিকেও রেহাই নেই। পি এফের সঙ্গে আধার সংযোগ করান, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার সংযোগ করান, মোবাইলের সঙ্গে আধার সংযোগ করান। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম আধার একটা সাংঘাতিক মূল্যবান নথি।
ঠিক এরকম একটি সময়ে এনআরসি হুংকার। বলা হল আরও একটি মজার কথা। ভোটার, প্যান, আধার, পাসপোর্ট, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কিছুই নাগরিকত্ব প্রমাণ নয়। এনআরসি যদি করা যায়, তা হলে ওটাই একমাত্র আসল প্রমাণপত্র। এবার একটা ধাঁধা বলা যাক। ধরা যাক, এনআরসি হচ্ছে। আমাকে বলা হল, আপনার কাছে কী কী প্রমাণপত্র আছে? সব দাখিল করুন কিংবা আপলোড করুন। আমি দেখালাম পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড। সব ঠিক থাকলে রাষ্ট্র আমাকে বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে। আপনার নাম এনআরসিতে থাকছে। আপনি নাগরিক। কিন্তু আশ্চর্য কথাটি হল, যেসব কার্ডকে এখন বলা হচ্ছে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রই নয়, সেইগুলি দেখাতে হবে প্রমাণ হিসেবে। অর্থাৎ তখন সেগুলি নাগরিকেত্বর প্রমাণ! দেখালেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? এটা কেমন ধাঁধা? তাহলে তো সেগুলিই নাগরিকত্বের প্রমাণ? একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে সরকারকে? এই যে মাঝেমধ্যেই নতুন নতুন কার্ড দেওয়ার প্রকল্প, এই কার্ডের সঙ্গে সেই কার্ডের সংযোগ করার প্রকল্প, নতুন নতুন বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা, এসবের জন্য যে সফটওয়্যার বা ডেটা প্রসেসিং কোম্পানিগুলিকে কনট্রাক্ট দেওয়া হয়, যেসব মেটিরিয়ালস আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে, এসব তো একটা বিপুল বাণিজ্য! সব দলের আমলেই হয়েছে। হয়ে চলেছে। কোটি কোটি টাকার লেনদেন। এসব কারা পায়? এই চুক্তি, এই টেণ্ডার, এই কোম্পানি বাছাই করা, এই উপকরণ আমদানি—এই তথ্যগুলি আমজনতার জানা দরকার।
সিংহভাগ মানুষ কেন এনআরসি নিয়ে বিরূপ? কারণ এটাই। সরকারকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না যে, এরা ঠিক কী চাইছে? অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদিদের কাছে বৃহত্তর উদ্বেগের বার্তা হল, মানুষ আর তাঁদের বলা কথায় বিশ্বাস করছে না। কেন? এই যে একের পর এক রাজ্যে বিজেপি পরাজিত হচ্ছে, এর অর্থ মোটেই এটা নয় যে, বিরোধীরা খুব ভালো, তাই মানুষ তাদের সমর্থন করছে। ভালো করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া হয়েছে। জয়ীকে জেতানো হবে বলে ভোট দেওয়া হয়েছে এমন নয়। বিজেপিকে হারাতে চেয়েছে মানুষ। কে জিতছে সেটা ভাবা হয়নি। কেন এই প্রবণতা? এটাই প্রকৃত সঙ্কট নরেন্দ্র মোদিদের কাছে। দিল্লিতে গোটা সরকার, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা এত কিছু বললেন কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে, প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু মানুষ একটা কথাও বিশ্বাস করল না কেন?
সরকারি ব্যাঙ্ককে মানুষ বিশ্বাস করছে না। সরকারি সিস্টেমকে বিশ্বাস করছে না। সরকারি সিদ্ধান্তকে সন্দেহের চোখে দেখছে। শাসক দলের নেতা ও মন্ত্রীদের উপর ভরসা করতে পারছে না। সভায় যাচ্ছে, জয়ধ্বনি দিচ্ছে, কিন্তু ফিরে এসে ভোট দিচ্ছে বিরোধীদের, এই আস্থাহীনতা একটা সংক্রমণের মতো। আগামীদিনে অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। যে কোনও ইস্যুতে সমালোচক কিংবা বিরোধীদের দেশদ্রোহী আখ্যা না দিয়ে ওই সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক দিকটা নিয়ে ভাবুক বিজেপি। কারণ বিরোধীরা মুখে বলছে বটে যে বিজেপি এরকম বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করুক, আসলে কিন্তু বিরোধীরা এখন বেশি করে চাইবে বিজেপি যেমন আচরণ করছে এরকমই করতে থাকুক। তাহলেই রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীদের লাভ বেশি হচ্ছে। তাই বিজেপির অতি আগ্রাসী নেতামন্ত্রীরা বদলে গিয়ে প্রচারের স্ট্র্যাটেজি বদলে দিলেই বরং বিরোধীদের ক্ষতি। এটা সবার আগে বুঝতে হবে বিজেপি ও মোদি সরকারকেই। সন্দেহ হয়,এই ‘কাশ্মীর-পাকিস্তান-নেহরু-সংখ্যালঘু তোষণ-গান্ধী ফ্যামিলি-রামমন্দির-হিন্দুসঙ্কট’ এই চেনা ফরম্যাটের বাইরে অন্য ফর্মুলা বিজেপি নেতামন্ত্রীরা জানেন তো? নাকি আর কোনও বিকল্প প্ল্যান জানা নেই বলেই একই কপি-পেস্ট টাইপের প্রচারের ফরম্যাট চলছে সর্বত্র? দেশের ৬৫ শতাংশ ভোটার ৩৫ বছরের নীচে। অবিলম্বে বিজেপির উচিত রণকৌশলের সফটওয়্যার আপডেট করা!