দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
অথচ, তার ঠিক আগেই একাদিক্রমে ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের মতো দেশের তিন-তিনটি রাজ্যে এই পদ্মবাহিনীকেই হারের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এবং, ভোটফল প্রকাশের পর দলের শীর্ষমহলের আক্ষেপে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল যথাযোগ্য ‘মুখ’-এর অভাবের কথা। ঠিকঠাক মুখ প্রজেক্ট না-করে মোদিজি শাহজির ভরসায় লড়তে গিয়েই বিপর্যয়—এমন কথাও উঠেছিল। ২০১৯ লোকসভায় বিপুল জয়ের পরও ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা, এমনকী মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরও রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞজনের অনেকেই ভোটের লড়াইতে দলীয় ‘মুখ’-এর গুরুত্ব স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। তাঁদের একাংশের বক্তব্য ছিল, দেশ-জনতার কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি এখনও অপরিহার্য হলেও রাজ্য-ভোটে অর্থাৎ বিধানসভার লড়াইতে যেখানে আঞ্চলিক দল ও সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় সেখানে তিনি ও তাঁর সংস্কারক ভাবমূর্তি প্রশ্নাতীতভাবে অবিসংবাদী নন। সেখানে সংশ্লিষ্ট নেতানেত্রী ও তাঁদের জনমনোরঞ্জক আঞ্চলিক ভাবমূর্তি তাই বহু ক্ষেত্রেই টেক্কা দিয়েছে মোদিজির জাতীয় আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে। নোটবন্দি, কালো টাকা উদ্ধার থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ, তিন তালাক রদ, পুলওয়ামার বদলা ইত্যাদি সংস্কার ও শক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের পর তাঁর প্রতি দেশ-জনতার আস্থা-বিশ্বাসের যে দৃঢ় ভিত তৈরি হয়েছিল তার মূলেও একটা ক্ষুদ্র প্রশ্নচিহ্ন বিঁধে দিয়েছে। দেশজুড়ে এনআরসি, সিএএ এবং এনপিআর তৈরির প্রয়াস যে সাম্প্রতিকে সেই প্রশ্নচিহ্নকে আরও কিছুটা বল জুগিয়েছে তাতেই-বা সন্দেহ কী?
কারণ, কোনওরকম বিতর্কে না-গিয়েও বলা যায়, আজ বিরোধী শিবির প্রবল প্রচারে এবং সক্রিয় বিরোধিতায় সাধারণ দেশবাসীর একাংশের মনে (বিশেষত মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে) একটি ভীতি অন্তত ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন যে মোদিজির ওই কার্যক্রমগুলো কার্যকর হলে দেশভাগের সমতুল হবে, মানবতার উপরে ঠাঁই পাবে ধর্ম! সাধারণ দেশবাসী, গরিবগুর্বো তো আর আইন পড়ে বিচার বিশ্লেষণ করে কোনও ধারণা গ্রহণ বর্জন করেন না, করেন প্রচারের গুরুত্ব ও ব্যাপ্তির নিরিখে। এই শ্রেণীতে ব্যতিক্রম হয়তো আছে, কিন্তু তার পরিমাণ পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়নের অনুকূল বা ক্ষমতাসম্পন্ন—এমন বলা যাবে কি? সুতরাং, এনআরসি ইত্যাদি নিয়ে এখন বলা বাহুল্য। রীতিমতো বেকায়দায় গেরুয়া বাহিনী ও তার শীর্ষ সঞ্চালকবৃন্দ। দিল্লি ভোটের একপেশে ফলে (আপ ৬২ এবং বিজেপি ০৮) তার আভাসও কি নেই? শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস, বেলগাছিয়া। চলছে অবস্থান বিক্ষোভ। জারি রয়েছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-যুব থেকে পদ্ম-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি। সব মিলিয়ে উত্তাল দেশ। এর ভিতরে গেরুয়া দলের পাল্টা প্রতিবাদ, যুক্তিজাল কোথায়? মাঝেমধ্যে দিল্লি থেকে কখনও প্রধানমন্ত্রী মোদিজি, কখনও তাঁর সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড অমিত শাহ জোর গলায় ঘোষণা ছুঁড়ছেন—হবে। নাগরিকপঞ্জি কী সিএএ রূপায়ণ—এসব থেকে সরে আসার প্রশ্নই নেই। দেশের দশের উন্নয়ন ও প্রগতির স্বার্থেই ওসব হবে! ব্যস, ওইটুকুই। রাজ্যে রাজ্যে তার প্রতিধ্বনি কোথায়, কতটুকু? পশ্চিমবঙ্গও কি তার ব্যতিক্রম?
এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে দিল্লি বিধানসভার ভোটফল আরও কয়েটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও কি তুলে দেয়নি? প্রথমত, ধর্ম না কাজ, মানুষের সার্বিক উন্নয়ন না তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় গুরু-লঘু বিভাজন—রাজ্য-ভোটে রাজ্যের মানুষের কাছে কোনটার অগ্রাধিকার? দ্বিতীয়ত, কুকথায় পঞ্চমুখ নেতানেত্রী না সুভদ্র যুক্তিবাদী বাস্তববাদী মানবতাবাদী ও কর্মনিষ্ঠ (ভিতরে যা-ই হোন, অন্তত জনসমক্ষে তেমনই ভাবমূর্তির রচয়িতা) লিডার—কাকে চান সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আম বাসিন্দা? রাজনীতি সর্বব্যাপ্ত—দলীয় রাজনীতিতে বিভক্ত জনতা, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু, আজকের দিনে, এই মিডিয়া-প্রকোপিত, মিডিয়া-মগ্ন সময়ে জ্ঞানভাণ্ডারের বিপুল আদান-প্রদানের যুগে যখন সক্কলে সব জানেন, মনে হয়, সেটাই শেষ কথা নয়। তারপরেও ‘চয়েস’ নির্ভর করে আরও কিছু ফ্যাক্টরের উপর। যেমন রাজনীতির শীর্ষলোকের কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব, তাঁদের বাণী ও বচনের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্য, উন্নয়ন-উন্নতির সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বাহুল্য, তা নিয়ে আগের সঙ্গে চলতির তুলনামূলক ভাবনা ইত্যাদির মতো হাজারো বিষয় সেখানে। এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই তৈরি হতে থাকে কোনও বিশেষ নেতানেত্রীর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি।
ফলে, এই প্রক্রিয়ায় অনিবার্যভাবেই জুড়ে থাকে সেই ভাবমূর্তির ব্যক্তিমুখ। আর জনতার যাবতীয় আশা-প্রত্যাশা ভোটকালে আবর্তিত হতে থাকে সেই মুখটিকে কেন্দ্র করে, নির্বাচনী মহারণের রাজনৈতিক রোমাঞ্চের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ওঠে সেই মুখ, হয়ে ওঠে জনতার অভাব-অভিযোগ জানানোর কমপ্লেন-বক্স, আশা-প্রত্যাশা বিশ্বাসের বিগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা তারই উজ্জ্বল সব উদাহরণ। শুধু তাই নয়, আপন কর্মকুশলতায় সংশ্লিষ্ট রাজ্যবাসীর মনে তাঁদের স্থান আজ এতটাই দৃঢ় যে, সেখান থেকে তাঁদের স্থানচ্যুত করা প্রায় অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষত, মুখহীন বা দুর্বলমুখ বিরোধী দল হলে সেই অসম্ভাব্যতা আরও প্রকট হয়ে পড়ছে।
সেজন্যই কিছুদিন হল বাংলার বিজেপি দলের অন্দরে দাবি উঠেছে—মুখ চাই মুখ। ২০২১ সালে জবরদস্ত লড়াইয়ের জন্য একটি কালিমাহীন শিক্ষিত সজ্জন মুখ চাই পদ্মশিবিরে সেনাপতি পদে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের উপযুক্ত দাবিদার হিসেবে। সেইমতো দিল্লিতে পৌঁছেছে বাংলার আবেদনও। তাতে সাড়া দিয়ে নাকি দলের রাজ্য সভার সংসদ সদস্য স্বপন দাশগুপ্তকে ‘মুখ’ করে যুদ্ধে নামার বার্তা পাঠিয়েছেন দিল্লির সাংগঠনিক কর্তারা। দিল্লিতে মনোজ তিওয়ারিকে দিয়ে ব্যর্থতাই এসেছে। কেজরিওয়াল ও তাঁর সুশিক্ষিত সুবক্তা দলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি তিনি। বাংলায় সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি চাইছেন না অমিত শাহ থেকে বিজেপি নেতৃত্বের কেউই। অমিতজি তো স্বয়ং স্বীকার করেছেন, কুকথা পরনিন্দায় ক্ষতিই হয়েছে। কারণ, উল্টো দিক থেকে পাল্টা কুকথা উড়ে আসেনি কখনওই। বুদ্ধিটা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের হোক কিংবা দলটা নিজ সিদ্ধান্তে কেবল গণপরিষেবা ও উন্নয়নের খতিয়ান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পেশ করে গেছে। ফল মিলেছে হাতেনাতে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পথেই হাঁটছেন। সভা-সমিতিতে সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের বিরোধিতায় দু-চারটে কটুবাক্য বললেও অধিকাংশ জুড়েই থাকছে তাঁর বিপুল উন্নয়নের কথা, সংযত শান্ত ভাষণে।
একে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেত্রী, তায় তাঁর আস্থাময় অক্লান্ত উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তি—এমন দুই কঠিন প্রতিপক্ষের মোকাবিলা যে কেবল দলীয়ভাবে সম্ভব নয়, সেটা বিজেপির একাংশ বুঝেছেন। এবং, সেইমতো স্বপন দাশগুপ্তকে খাড়া করতে চাইছেন তাঁরা ‘মুখ’ হিসেবে। কিন্তু, দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সাফ জানাচ্ছেন, কোনও মুখ লাগবে না। দলীয় রীতিপ্রথা অনুসারে যাবতীয় মোকাবিলা দলই করবে। তারপর ‘মুখ’-এর প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, একপক্ষ চাইছেন দুর্নীতি সন্ত্রাসের সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণকে সামনে রেখে লড়তে। অন্যপক্ষের বক্তব্য, চলতি সরকারের ব্যর্থতা ও ‘অপশাসন’ হোক হাতিয়ার! আবার কেউ বলছেন, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই হিসেবে ২০২১ বিধানসভার আসরে নামতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এবং দলীয় কর্মী-সমর্থকদের একাংশ মনে করছেন, ভোটের আগে (পুরভোট এসে গেল। এপ্রিলে) নীতি-নির্ধারণে এই মতপার্থক্যের কারণই মুখের অভাব। সেই মুখ যা দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মিলেমিশে আপন ব্যক্তিত্ববলে কার্যকরী একটা রণকৌশল তৈরি করবেন এবং সেইমতো প্রাণপণ লড়াইতে প্রাণিত করবেন দলীয় নেতা-কর্মীদের। কিন্তু, তা না-হয়ে বিভাজনের আবহ তৈরি হয়ে যাচ্ছে বিজেপির মতো রেজিমেন্টেড পার্টিতেও!
অন্যদিকে, মমতার সঙ্গে লড়াইতে কেবল শিক্ষিত সজ্জন রাজনীতিক হলেই কি চলবে? মমতার ওই বিপুল জনপ্রীতি, তাকে টেক্কা দিতে হবে না? তার জন্য বঙ্গ বিজেপির সেই মুখকে জনপ্রীতিতেও তো যথেষ্ট দড় হতে হবে—তাই না? সবচেয়ে বড় মুশকিলটা বোধহয় সেখানেই। দিলীপ ঘোষ বছর চারেকের পরিক্রমায় এখন চেনা মুখ। কিন্তু, স্বপন দাশগুপ্ত কি পারবেন? মাঝে তো মাত্র বছরখানেক। বলতে কী, ২০২১ বিধানসভার লক্ষ্যপূরণের পথে আপাতত বঙ্গ বিজেপির চিন্তা সেখানেই। কারণ, আস্থার মুখটিকে ভালোমতো বুঝে নিতে না-পারলে অন্তত এই বাংলায় মানুষ মজেন না—এমনই বলেন মহাজনেরা, বলেছে দিল্লি। অতএব, সাধু সাবধান।