দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
শিকাগোর তুলনায় বস্টনে জীবনধারণ কিছুটা সস্তা। স্বামীজি বস্টনে গেলেন। ট্রেনে বস্টন যাওয়ার পথে তাঁর আলাপ হয় ক্যাথেরিন এবট স্যানবর্ন ওরফে কেট নামে প্রভাবশালী প্রৌঢ়ার সঙ্গে। বস্টনে থাকার বন্দোবস্ত তিনিই করে দেন। বাগ্মী ও লেখিকা হিসেবে বিশেষ প্রতিপত্তিও ছিল তাঁর। কেটের মাধ্যমেই শিক্ষিত গণ্যমান্য শ্রেণীর মধ্যে সহজ প্রবেশাধিকার মেলে স্বামীজির। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে প্রফেসর রাইটের। তাঁরই বদান্যতায় ধর্মমহাসভায় স্বামীজির জন্য প্রতিনিধির আসনটি নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে, এই পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁকে কত যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ হয়তো কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। যেটুকু জানা যায়, সেটুকুই ভয়ঙ্কর! ‘বিবেকানন্দ’ নামটাই পশ্চিমাদের জিভে ঠিকমতো উচ্চারিত হতো না। ফলে, তিনি একাধিক বিকৃত নামের অধিকারী হলেন। তাঁর অদ্ভুত পোশাক ও পরিচয় নিয়েও নানা মজা হতো। খবরের কাগজেও তাঁর মুখে মনগড়া বিবৃতি বসানো হয়েছে। হজম করেছেন রাস্তার ফালতুদেরও বিদ্রুপ।
ধৈর্য ও সাহসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেখা গেল, আমেরিকার সমাজ তাঁকেই ‘ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা ঋষি’ হিসেবে তুলে ধরছে। তাঁকে দেখার জন্য, তাঁর মুখের কথা শোনার জন্য বড় বড় জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসতে লাগল। উল্লেখ্য, শিকাগো ছেড়ে বস্টনে যাওয়ার পর স্বামীজি ধর্ম মহাসভায় যোগদানের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। প্রফেসর রাইট অনেক বুঝিয়েই তাঁকে ফের শিকাগোয় পাঠান। পরিচয়পত্র না-থাকার অস্বস্তি কাটাতে রাইট স্বামীজিকে যে-কথা বলেছিলেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে—‘‘আপনার কাছে পরিচয়পত্র চাওয়া আর সূর্যকে তার কিরণ-বিকিরণের কী অধিকার আছে জিজ্ঞাসা করা তো একই কথা!’’ তবুও রাইট নিজ দায়িত্বে চিঠি লিখলেন মহাসভার প্রতিনিধি নির্বাচক কমিটির সেক্রেটারিকে—‘‘ইনি এমন একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি যে আমাদের সকল অধ্যাপককে একত্র করলেও তাঁর জ্ঞানের সমকক্ষ হবেন না।’’ স্বামীজির শিকাগো যাওয়ার ট্রেনের টিকিটটাও প্রফেসর কিনে দিলেন এবং মহাসভার পক্ষ থেকে বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সমীপে একটি চিঠিও লিখলেন। কিন্তু, শিকাগো পৌঁছেও স্বামীজি এক নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যান। তখনই আলাপ হয় সহৃদয় জর্জ ডব্লু হেল পরিবারের সঙ্গে। মহাসভার মঞ্চে প্রতিনিধির আসন পেতে স্বামীজিকে চূড়ান্ত সাহায্যটি করেন তাঁরাই। জে বি লায়নের পরিবারে থাকারও বন্দোবস্ত হয়। কিন্তু, সমস্যা দেখা দেয় সেই বাড়িতে আশ্রিত কিছু বর্ণবিদ্বেষীকে নিয়ে। স্বামীজির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই মিস্টার লায়ন এতটাই মুগ্ধ হন যে, এই কথা জানার পর তাঁর স্ত্রী এমিলিকে সাফ বলেন, ‘‘সব অতিথি চলে গেলেও আমার এতটুকু দুঃখ নেই। আমাদের ঘরে এ যাবৎ যতজন এসেছেন তাঁদের মধ্যে এই ভারতীয় মানুষটিই সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত এবং আমাদের মন কেড়ে নিয়েছেন। ইনি যতদিন খুশি এখানে থাকবেন।’’
স্বামীজি ক্রমশ উৎসাহ ফিরে পেতে লাগলেন। তাঁর কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে, স্বয়ং ভগবানই তাঁকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ধর্মমহাসভা নতুন কিছু নয়। অতীতে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকবার অনেক দেশে হয়েছে। কিন্তু, একটিমাত্র মহামঞ্চ থেকে সব ধর্মের প্রতিনিধি মুক্তকণ্ঠে নিজ নিজ মত ব্যক্ত করবেন এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কারণ, যুগটা ভীষণভাবে পরমত অসহিষ্ণুতার। তাই মহাসভাটি স্বামীজির কাছে দৈবনির্দিষ্ট ও অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়েছিল। শিকাগোর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দকে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘‘ধর্মমহাসভাটা আমারই জন্য হচ্ছে। আমার মন তাই বলছে। শিগগিরই এর প্রমাণ পাবে।’’ দ্রুত প্রমাণ পেয়েছিল সারা পৃথিবী। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯০ তারিখ মহামঞ্চে উপস্থিত হয়েই সমবেত দর্শকমণ্ডলীকে তিনি ‘আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতাগণ’ বলে সম্বোধন করলেন। পশ্চিমি মানুষ এমন আন্তরিক সম্বোধন কস্মিনকালেও শোনেনি। এই ছোট্ট সম্বোধনই তাঁদের হৃদয়জয়ের সূচনা করল। মহাসভাস্থল করতালিতে ফেটে পড়ল। সেই অভিনন্দন যে থামতেই চায় না! বিনয়ের সঙ্গে তা গ্রহণ করার পর তিনি সনাতন হিন্দু ধর্ম দর্শন এবং উদার ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিলেন। স্বামীজি তাঁর ভাষণের গোড়ার দিকে একটি অত্যন্ত দামি কথা বললেন, যা আজ অধিকতর প্রাসঙ্গিক—‘‘যে-ধর্ম জগৎকে চিরকাল সমদর্শন ও সর্ববিধ মত-গ্রহণের বিষয় শিক্ষা দিয়ে আসছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা যে কেবল অন্য ধর্মাবলম্বীর মত সহ্য করি, তা-ই নয়—সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে-ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি ‘এক্সক্লুশান’ (হেয় বা পরিত্যাজ্য) শব্দটি কোনোমতে অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্মভুক্ত।’’
দেশের পথে পা বাড়ানোর মুহূর্তে এক ইংরেজ বন্ধু স্বামীজির কাছে প্রশ্ন রাখেন—‘‘বিলাসের লীলাভূমি, গৌরবের মুকুটধারী মহাশক্তিধর পাশ্চাত্যে চার বছর ভ্রমণের পর মাতৃভূমি আপনার কেমন লাগবে?’’ স্বামীজি হাসি মুখে জবাব দিয়েছিলেন—‘‘পাশ্চাত্যে আসার আগে ভারতকে ভালোবাসতাম। এখন তো আমার কাছে ভারতের ধূলিকণা পর্যন্ত পবিত্র, ভারতের বায়ু পবিত্রতামাখা, ভারতভূমি তীর্থস্বরূপ।’’
আমেরিকা, ইউরোপ, সিংহল ঘুরে স্বামীজি ১৮৯৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখেন মাদ্রাজে, পাম্পান দ্বীপে। খবর পেয়ে রামনাদ-রাজ তাঁর জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনারই ব্যবস্থা করেছিলেন। মাদ্রাজের পর তাঁর গন্তব্য নির্দিষ্ট হয় কলকাতা। ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘মোসাম্বা’ জাহাজে চড়ে বসলেন। সহযাত্রী স্বামী শিবানন্দ, স্বামী নিরঞ্জনানন্দ, ক্যাপ্টেন সেভিয়ার, মিসেস সেভিয়ার, গুডউইন ও আনন্দ চার্লু। গন্তব্য ছিল সম্ভবত খিদিরপুর। চারদিন পর, ১৮ ফেব্রুয়ারি জাহাজ যখন গন্তব্যের কাছাকাছি এল, তখন প্রায় সন্ধ্যা। নেভিগেশনের নিয়ম অনুযায়ী, সেখানেই নোঙর করা হয়। সপার্ষদ স্বামীজির রাত কাটল জাহাজেই। পরদিন, অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি মাটিতে পা রাখেন। বজবজে। স্বামীজি বজবজ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন। কাঠ ও বেতের তৈরি যে চেয়ারে বসেছিলেন সেটি উদ্ধার করে রেলের হেরিটেজ গ্যালারিতে রাখা হয়েছে। স্বামীজির পদার্পণের পুণ্যস্মৃতি ধরে রাখতে ১৯৮৬-তে বজবজ স্টেশনের ওয়েটিং রুমের দেওয়ালে একটি প্রস্তরফলকও বসানো হয়েছে।
স্পেশাল ট্রেনে তাঁকে তোলা হয় আনুমানিক সকাল সাড়ে ৬টায়। ঘণ্টাখানেক বাদে তাঁরা শিয়ালদহে পৌঁছন। কলকাতায় তাঁকে বিপুল অভ্যর্থনা করা হয়। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন দ্বারভাঙার মহারাজ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। স্বামীজি মাদ্রাজে পৌঁছতেই কলকাতায় অভ্যর্থনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শিয়ালদহে বিশ হাজার মানুষের সমাগম হয়। সুগন্ধী ফুল মালায় তাঁর ঢাকা পড়ার অবস্থা। উপস্থিত গুরুভাইদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়েরও সুযোগ নেই। আবেগবিহ্বল ভক্তদের ভিড় ঠেলে কোনোরকমে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ির দিকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেভিয়ার দম্পতির সঙ্গে স্বামীজি গাড়িতে বসতেই একদল ছাত্র ঘোড়া দুটিকে মুক্তি দিয়ে নিজেরাই গাড়ি টেনে নিয়ে গেল। সঙ্গে চলল ব্যান্ডপার্টি ও কীর্তনের দল। জায়গায় জায়গায় সুন্দর তোরণ সেজে উঠেছিল। শহরের রাস্তাগুলিতেও উপচে-পড়া ভিড়। এইভাবে স্বামীজি বাগবাজার, বরানগর ছুঁয়ে পৌঁছে গেলেন আলমবাজার মঠে। মঙ্গলকলসসহ তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন মঠের সাধুরা। পরদিন কাগজে কাগজে বর্ণনা ছাপা হল। কলম্বো এবং মাদ্রাজেও তাঁকে অভ্যর্থনার খবর বাংলার মানুষ জেনেছিল সংবাদপত্র থেকে। আমেরিকা এবং ইউরোপে পাওয়া অভিনন্দনপত্রগুলিরও ছবি ছাপা হতো। স্বামীজির বিশেষ ট্রেন শিয়ালদহে আসামাত্র সমস্বরে জয়ধ্বনি ওঠে—‘‘জয় পরমহংস রামকৃষ্ণদেব কী জয়, জয় স্বামী বিবেকানন্দ কী জয়।’’ সারা বাংলা ভীষণ উজ্জীবিত হল।
কলকাতায় এই জন-অভ্যর্থনা প্রসঙ্গে স্বামীজি বলেছিলেন—‘‘আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে আমায় নিয়ে একটু হইচই হয়। কী জানিস, একটা হইচই না-হলে তাঁর (ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ) নামে লোক চেতবে কী করে? এত সংবর্ধনা কি আমার জন্য করা হল? না। তাঁর নামেরই জয়জয়কার হল। তাঁর বিষয় জানবার জন্য লোকের মনে কতটা ইচ্ছা হল। এইবার একটু একটু করে তাঁকে জানবে। তবে না, দেশের মঙ্গল হবে। যিনি দেশের মঙ্গলের জন্য এসেছেন, তাঁকে না-জানলে লোকের মঙ্গল কী করে হবে?’’