মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
প্রশ্ন:
(ক) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি), কেন্দ্র ও রাজ্যের কোনও আইন প্রয়োগ সংস্থা, পুলিস, কেন্দ্র ও রাজ্যের কোনও ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা প্রভৃতির মধ্যে কেউ কি ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ নামে কোনও সংঠগনকে চিহ্নিত এবং তালিকাভুক্ত করেছে?
(খ) ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’—এমন একটি পরিভাষা যে ব্যবহার করা হচ্ছে, এর ভিত্তিটা কী—কেন্দ্রীয় মন্ত্রক কিংবা আইন প্রয়োগ সংস্থা অথবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে পাওয়া কোনও তথ্য?
(গ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, এনসিআরবি, অথবা আইন প্রয়োগ সংস্থা অথবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কি ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর অভিযুক্ত নেতাদের এবং তার সদস্যদের তালিকা তৈরি করেছে?
(ঘ)‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের মতো কোনও ফৌজদারি শাস্তির কথা (বিশেষ করে ভারতীয় দণ্ডবিধি বা আইপিসি অথবা অন্য আইনে নির্দিষ্ট) বিবেচনা করা হচ্ছে কি? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কিংবা অন্য কোনও আইন প্রয়োগ সংস্থা অথবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কি এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে?
(ঙ) যদি সেরকম হয়, তবে বিস্তারিত জানানো হোক।
উত্তর
(ক) থেকে (ঘ): কোনও ধরনের আইন প্রয়োগ সংস্থা এই বিষয়ে কোনও প্রকার তথ্য সরকারের গোচরে আনেনি।
দেশকে টুকরো করা হচ্ছে?
যেহেতু ২০১৯-এর মে মাসে ভোটের মাধ্যমে বিজেপিকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরানো হয়েছে, সেই সূত্রে দেশের অনেক মানুষকেই খাওয়ানো গিয়েছে যে, ভারত বিপদের মধ্যে রয়েছে। ভারতকে টুকরো টুকরো করার লক্ষ্যে কয়েকটি গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে অপকম্ম করে চলেছে। এই গোষ্ঠীগুলিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের নামে দেগে দেওয়া হয়েছে—নকশাল, মাওবাদী, মুসলিম সন্ত্রাসবাদী, শহুরে নকশাল প্রভৃতি। কানহাইয়া কুমারসহ চারজন ছাত্রনেতার নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) একটি বড় ছাত্রসমাবেশ হয়েছিল। ওই প্রতিবাদী ছাত্রদেরকেই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ নামে দেগে দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে বিজেপির নীতি ও কাজের বিরোধী সকলকেই ওই তকমাটাই সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। এই তকমা রাজনৈতিক ভাষণের ভিতরেও ঢুকে পড়েছে। দুর্ভাগ্য যে, সেটা মার্জিত রুচির বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকরের ভাষণেও জায়গা করে নিয়েছে।
বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং মানুষের গায়ে এই তকমা সেঁটে দেওয়ার দ্রুততায় অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে ভেবে নিচ্ছেন যে, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ সত্যিই রয়েছে আর সেটা দেশের সামনে এক ভয়ংকর ও ক্রমবর্ধমান বিপদরূপেই উপস্থিত হয়েছে। এই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর মধ্যে বিজেপির বিরোধী কাকে না ধরা হয়েছে—শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, লেখক, শিল্পী, ছাত্রছাত্রী, শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন, কৃষক, বেকার যুবক-যুবতী, মহিলা, এমনকী শিশুরাও। আর অবশ্যই নাম করতে হবে বিরোধী দলগুলির নেতাদের। মহিলা ও শিশুরা হল ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এ সর্বশেষ সংযোজন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং প্রস্তাবিত জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জির (এনপিআর) বিরুদ্ধে শাহিনবাগে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠতেই তাদেরকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তালিকাটি রোজ লম্বা হচ্ছে।
ছকে সামান্য ভুল
দিল্লি বিধানসভার সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দুটি পদযাত্রায় অংশ নিয়ে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর কথা তুলে তাদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া অবশ্য এই ‘গ্যাং’-এর চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, ছকে সামান্য ভুল রয়ে গিয়েছে। আমরা কী দেখলাম—‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ যাদের বলা হচ্ছে তাদের এক হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা আর অন্য হাতে ভারতের সংবিধানের একটি কপি! এখানেই শেষ নয়, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর সদস্যদের দরাজ গলায় মাঝে মাঝেই ধ্বনিত হচ্ছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত! মানুষকে যে বাগাড়ম্বর শোনানো হয়েছিল আর মানুষ স্বচক্ষে যে ছবি দেখল, তা তো মিলছে না—একেবারেই যে আলাদা! মনে হয় সব ধরনের মানুষ তাদের বিশ্বাস অনুযায়ীই সব বিশ্বাস করেছে।
মন্ত্রী মশায়ের বিবৃতিটা চমকপ্রদ। গত কয়েক মাস যাবৎ বিজেপি নেতারা যেসব অভিযোগ করলেন আর গত সপ্তাহে সংসদে মন্ত্রী মশায় যে বিবৃতি দিলেন তা তো উল্টো! এই বৈপরীত্যের ব্যাখ্যা কী—তা দেওয়ার জন্য বিজেপির কোনও নেতাই এগিয়ে আসার সাহস দেখালেন না।
দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে এ জিনিস মোটেই অস্বাভাবিক কিংবা চারিত্রিক ত্রুটি বলে গণ্য হয় না। দক্ষিণপন্থী নেতারা এসবে বিশ্বাসের ব্যাপারে যে কট্টর তা নিয়েও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেবলমাত্র দক্ষিণপন্থীরা যখনই তাদের ধর্মের রাজনীতিকরণ করে এবং ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার অপচেষ্টা নেয়—‘আমার ধর্ম বনাম তোমার ধর্ম’ করে বেড়ায়—তখনই সংবিধান লঙ্ঘিত এবং সামাজিক ঐক্য বিঘ্নিত হয়। বিজেপি ঠিক এটাই করেছে। গত ছ’বছর ধরে সরকারে এবং অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেই লোকগুলিকে বসিয়ে দিয়েছে, যারা নিছক ধার্মিক নয়, অসংখ্য মানুষের মনে ভয় ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দিতে তাদের ধর্মবিশ্বাসকে অস্ত্র হিসেবে যারা ব্যবহার করবে।
যেমন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নীরা চান্ধোক লিখেছেন, ‘‘সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা যেটার সঙ্গে লড়াই করে সেটা হল—ক্ষমতার রাজনীতিকরণ, ক্ষমতার পক্ষে ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ, ধর্মীয় পরিচয়কে ক্ষমতায় রূপান্তর ... রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে মরিয়া রাজনীতির বর্ম পরা ধর্মকে ঠেকাবার একটি চেষ্টারও নাম সেকুলারিজম। এটা অপরিহার্যই ছিল। কারণ, দেশটা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল।’’
ধর্মের রাজনীতিকরণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অক্ষুণ্ণ রাখা—লড়াইটা এই দুইয়ের মধ্যে। লড়াই জারি রয়েছে দিল্লি, লখনউ, কলকাতা, হায়দরাবাদ, পুণে, কোচিতে ও অনেক ছোট শহরে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এবং আরও নানা স্থানে। এই আন্দোলনে মাথা গলাচ্ছেন যাঁরা তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলির চেনা মুখ নন। তাঁরা বরং একেবারে সোজা সাপটা অরাজনৈতিক মানুষজন। তাঁদের মধ্যে আছেন মহিলারা এবং তাঁদের খুদে ছেলমেয়েরা, বেশিরভাগ সময় যাঁরা বাড়ির চৌহদ্দিতেই কাটাতে অভ্যস্ত। আর যোগ দিয়েছেন রাজনীতি-বিমুখ যুব সম্প্রদায়ের অংশটা—যাঁরা পর পর গদিয়ান এই সরকারের কাজকর্মে হতাশ। শীতের কামড়, জলকামান, লাঠির আঘাত, এমনকী গুলির মতো মৃত্যুবাণকেও পরোয়া করেননি। উল্লেখ করা যায় যে, শুধু উত্তরপ্রদেশেই পুলিসের গুলি ২৩ জনের প্রাণ নিয়েছে।
দিল্লির ভোট ভারতের জন্য ‘ভিয়েতনাম আন্দোলন’ হয়ে উঠেছিল। জয়টা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল, যখন দিল্লির ভোটদাতারা দরাজ হাতে সমতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষ নিলেন। তাতে করে আমরা কী দেখলাম? বিজেপি-কথিত সেই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ই বিজয়ীর হাসি হাসল। প্রার্থনা করি, তাদের সাংবিধানিক লক্ষ্য পূরণ না-হওয়া অবধি ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ আরও শক্তিশালী হোক।