কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
রাজধানী দিল্লির ভোট হয়ে গিয়েছে। ফল প্রকাশিত হবে আগামীকাল। সেই ফল দেশকে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম হবে বলে গরিষ্ঠতম ভারতবাসীর বিশ্বাস। অর্থাৎ ভারত হিন্দু বাদে সবাইকে দুচ্ছাই করে তাড়াবার চেষ্টা করবে, নাকি সবাইকে আপন করে নেওয়ার মন্ত্রপাঠ করে, উজ্জীবিত হয়ে এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে যাবে? তা বলে দেবে দিল্লির নির্বাচনী ফল। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্রের বাহুবল ও বাক্যবলের প্রসঙ্গটি মনে পড়ে গেল। সৌজন্যে অনুরাগ ঠাকুর সহ বিজেপির একাধিক নেতার প্রচার। ভাবা যায়, প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজেপির মন্ত্রী মানুষকে উস্কানি দিয়ে বলছেন, ‘দেশকো গদ্দারো কো’, সমস্বরে গেরুয়া বাহিনীর সমর্থকরা উন্মত্তভাবে চিৎকার করে বলছেন, ‘গোলি মারো...’। এই সব বিদ্বেষমূলক প্রচারের মধ্যেই দুটি ক্ষেত্রে দুই রামভক্তের গুলিছোঁড়ার ঘটনা রাজধানীতে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। একটি জামিয়া মিলিয়ায় এবং অন্যটি শাহিনবাগে। এই দুটি ঘটনার সঙ্গে অনুরাগের ওই স্লোগানের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ আছে কি না আমরা জানি না। কিন্তু একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যখন খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হিংসার আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার স্লোগান দেন, তখন সেটাকে ধিক্কার জানাতেই হয়।
এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির ভোট সার্বিক ক্ষেত্রে এক বিরাট অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষা ভারতের অন্তরাত্মারই। এই ভোটই বলে দেবে ভারতের অন্তরাত্মা আসলে কী বলছে? সে কি ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে, নাকি বিজেপির হিন্দুত্বের পক্ষে? বিজেপি এই দেশকে যেদিকে নিয়ে যেতে চায়, তাতে কি সমর্থন রয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের? নাকি সিএএ, এনআরসি’র আন্দোলনে রাত জাগছেন যাঁরা, তাঁদের স্বপ্নটাই ঠিক? আগামীকালের ফলই বলে দেবে সেকথা।
একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় আমরা সকলেই লক্ষ্য করেছি। সেটা হল দিল্লির ভোটের প্রচারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ভোট প্রচারের চরিত্রগত পার্থক্য। একদিকে আপ তাদের প্রচারে বারাবার উন্নয়নের কথা বলেছে। অর্থাৎ বিগত পাঁচ বছরে তারা রাজ্যের মানুষের উন্নয়নের জন্য কী কী কাজ করেছে, তার কথা বলেছে। যেমন বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, ওয়াইফাই। নিরাপত্তায় সিসি টিভি, মেয়েদের বিনামূল্যে বাসে যাতায়াত ইত্যাদি। এছাড়া স্কুলশিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও নজির গড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। স্বভাবতই এই উন্নয়নের নজিরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি দিল্লি বিজেপির ছিল না। একেই তারা এখন সিএএ, এনআরসি নিয়ে দেশে কোণঠাসা অবস্থায়। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি গোহারা হেরেছে। এখন দিল্লিতে হারলে লজ্জার আর শেষ থাকবে না। তাই তারা প্রচারে পাল্টা স্ট্রাটেজি হিসেবে শুধু বিদ্বেষ বিষ ছড়িয়েছে। তারা প্রচারে বারবার হিংসার কথা বলেছে। বলেছে কেউ গেরুয়া সমর্থক না হলেই সে দেশের শত্রু, বলেছে শাহিনবাগের কথা, বলেছে টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের কথা। বলেছে গোলি মারার কথা। এর থেকে বোঝা যায় একটা দলের কাছে উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলে তাকে এমন ছন্নছাড়া খেলাই খেলতে হয়। তাকে মন্দির নির্মাণের তাস খেলে ভোট বাক্স আঁকড়ে ধরার খেলা খেলতে হয়। সুতরাং প্রচার কৌশলে ইতিমধ্যেই বিজেপি আপের কাছে হেরে বসে আছে।
ভোটের ফল কী হবে, তা অবশ্য কালই জানা যাবে। কিন্তু দিল্লির কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, তাঁরা কেজরিওয়ালের ফিরে আসার ব্যাপারেই আশাবাদী। তার কারণ কেজরিওয়ালের স্বপ্নসজ্জায় অনেকটাই সেজে উঠেছে দিল্লি। তিনি ফিরে এলে অসম্পূর্ণ কাজ করবেন। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আম আদমি পার্টি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল। পাশাপাশি শূন্যগর্ভ বিজেপি নেতারা ছায়াশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা খেলেই আনন্দে মেতে থেকেছেন। মাঝে মাঝেই মোদিজি বলেন, ‘এক্ষুণি যুদ্ধ হলে পাকিস্তানকে হারাব।’ আমরা কেউ কেউ ভাবি, এই বুঝি যুদ্ধ বেধে গেল। আমাদের, মানে দেশের সাধারণ মানুষের কী হবে? দেশাত্মবোধে সকলকে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে মোদিজি অভয়বাণী দেন, ভয় কী? আমি তো আছি। সত্যিই তো আমাদের আর ভয় কী? ডাকাবুকো মোদিজি আছেন তো। আমাদের পাহারাদার। তিনিই তো আমাদের সব ধরনের শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
যুদ্ধটা যেন তাঁর চেতন, অচেতনের মধ্যে জড়িয়ে আছে। স্বপ্নে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটাও এক ধরনের রোগ বলে মনে করতেন স্বপ্নতত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী যাঁদের স্বপ্নে যুদ্ধ বারবার ফিরে আসে, তাঁরা আসলে কোনও কিছুর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় পান। মনে হয়, কিছু একটা আছে, এই বুঝি হারাব। অথবা নিজের ভয়টাকে অন্যের মধ্যে চারিত করে এও এক ধরনের মানসিক তুষ্টিবোধ। বিজ্ঞান সেটাই বলছে। তাহলে কি মোদি এবং তাঁর দলের অন্যরা কিছু হারানোর ভয় পাচ্ছেন?
যদি তিনি সত্যিই ভয় পান, তবে তার কারণও আছে। কেননা গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে একের পর এক হেরেই চলেছেন তিনি। মোদি-শাহ জুটির তলোয়ার ঘুরিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার কোনও পজিটিভ ফলই আর সেভাবে মিলছে না। যত কোণঠাসা হচ্ছেন, ততই নানাবিধ ইস্যুতে তাঁরা দেশটাকে বেঁধে ফেলতে চাইছেন। চিরাচরিত, নম্র, ভারতকে তাঁরা নিয়ে চলেছেন অন্য এক দিকনির্দেশে। আমাদের মন্ত্রই ছিল ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। সারা বিশ্বই আমার আত্মীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’ কিন্তু কেউ যদি নিজের মধ্য থেকে বেরতে না পারেন, কূপমণ্ডুকতা যদি তাঁকে গিলে খায়, তবে তিনি হয়ে ওঠেন কুয়োর ব্যাঙ। দৃষ্টির স্বচ্ছতা হারিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন অন্ধ। সত্যের পথ তিনি দেখতে পান না। বিজেপি আজ ক্রমেই সেই পরিণতির দিকে এগচ্ছে। এর একটাই কারণ, তারা মনে করছে, এখনও আমরা সাড়ে চার বছর কেন্দ্রে থাকব।। আমরা অনেক কিছু এই সময়ের মধ্যে উলটে দেব। মানুষের সব বিরোধী মনোভাবকে পক্ষে আনতে সক্ষম হব। সেও এক মূঢ় ভাবনা। তার গদি এখন অনেকটাই টলোমলো। এই মুহূর্তে দেশের সাধারণ নির্বাচন হলে মোদি-শাহ জুটি ফিরতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও তর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু এই জুটি গত কয়েকমাসে সারা দেশের মানুষকে যে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তার ফল তাঁদের ভুগতেই হবে। সে বিপন্নতা মানুষের অস্তিত্বের বিপন্নতা। আমার আজন্মের দেশ আর আমার থাকবে কিনা, এই বিপন্নতা সব থেকে বড়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপন্নতা। ব্যাঙ্কগুলি আজ অনেকটাই বিপন্ন। সুদের হার তলানিতে। ব্যাঙ্কে টাকা রাখা আজ অনেকটা অর্থহীন। অবসরের পর যে সুদের টাকায় মানুষ বাকি দিনগুলি মোটামুটিভাবে কাটানোর স্বপ্ন দেখত, তা এখন ভেঙে চুরমার। বাজেটের দিশাহীন অবস্থায় মানুষ আরও বিপন্নতার শিকার।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির ভোট কতটা ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে, তা বোঝা যাবে কালই। যদিও বুথফেরত সমীক্ষায় সকলেই বলছে, আপ আবার ফিরে আসবে। বিজেপির কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর কোনও ইঙ্গিত এই সব সমীক্ষায় মেলেনি। তবু সত্য জানার জন্য কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
কালই বোঝা যাবে, আম আদমি পার্টির ঝাড়ু কতটা কার্যকর প্রতীক। ঝাড়ু হল সব ধরনের আবর্জনাকে ঝেঁটিয়ে দূর করার প্রতীক। গত দুই টার্মে কেজরিওয়াল এই ঝাড়ু দিয়ে ‘স্বচ্ছ দিল্লি’ গড়ার কাজ করে চলেছেন। এবার তিনি হ্যাটট্রিক করতে পারেন কিনা, সেটাই দেখার। বুথফেরত সমীক্ষা অনুযায়ী ফল হলে আপ-নেতা কর্মীরা মনের আনন্দে সলিল চৌধুরীর সেই গানটা গাইতে পারবন। ‘মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর..।’
দিল্লির ফল আগামীদিনের পক্ষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কেননা আগামীদিনে ভোট পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, বিহার, চেন্নাই, পুদুচেরিতে। রাজ্যগুলিতে এনআরসি নিয়ে প্রতিবাদ তুঙ্গে। সেই প্রতিবাদে এবং বিরোধী দলগুলিকে নতুন করে অক্সিজেন জোগাবে দিল্লির এই ফল। তাই দিল্লির ফল এই সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।