ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত সাফল্য নাও দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি। শ্বাসকষ্ট ও বক্ষপীড়ায় শারীরিক ক্লেশ। ... বিশদ
কে বলেছে, বাংলায় সুচিকিৎসক নেই, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বলে আজ মানুষজন দক্ষিণের বেঙ্গালুরু মুম্বই হায়দরাবাদ চেন্নাই ভেলোর ছুটছেন? যাঁরা দক্ষিণে ছুটছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করুন, দেখুন কি উত্তর পান। সকলে স্বীকার করবেন, ওই লিভার বিশেষজ্ঞের মতো হাজারো ভালো চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকেন্দ্র আছে রাজ্যে, আছে জটিল চিকিৎসার সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতিও। তাহলে কী নেই? নেই—সার্বিক পেশাদারিত্ব, রোগীর প্রতি দায়বদ্ধতা এবং ভালোবাসা। সে জন্যই ওঁদের মুখে শুনবেন, এখানে বলে দিলো ক্যান্সার, কেমো শুরু করে দিতে হবে। মুম্বই টাটায় গেলাম—বলল, কিসসু হয়নি। সামান্য ক’টাকার ওষুধ খেয়ে সেরে উঠলাম। ভাবুন! এরপর কার সাহস হবে? বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ এসেছে এবং আসছে। শুধু কি তাই, আমার পরিচিত এক তরুণের বেশ কিছুদিন যাবৎ পেটে অস্বস্তি চলছিল, খাওয়াদাওয়ার ইচ্ছে চলে যাচ্ছিল। বাঘা বাঘা ডাক্তারদের কাছে ধারণা দিয়ে হাজার হাজার খরচা করেও সুরাহা হচ্ছিল না। কেউ কানের সোনোগ্রাফি করাতে বলছেন কেউ পেটের। কেউ বলছেন পেশি সমস্যা, ব্যায়াম করতে হবে! শেষমেশ গ্যাসট্রো সার্জন ডাক্তার মাইতি জানিয়ে দিলেন, গলব্লাডারে পাথর এবং সেটি বাদ দিতেই ফিট! যে ডাক্তারবাবু হাতে দক্ষিণযাত্রী প্রত্যাখ্যান প্ল্যাকার্ড নিয়ে সেদিন পিজি হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ছবি তোলালেন, তিনি জানেন না এসব?
আর একটা ঘটনা বলি। আমার বন্ধু ওই এক পেটের সমস্যা ও ফুল অ্যাবডোমেন ইউএসজি রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলেন এক ‘বিখ্যাত’ ডাক্তারবাবুর মধ্য কলকাতার চেম্বারে। গুরুগম্ভীর মুখে রিপোর্টে এক ঝলক চোখ বুলিয়েই তাঁর নিদান, ‘লো-কার্বোহাইড্রেট ডায়েট। ওষুধটসুধ তেমন কিছু লাগবে না। তো, স্বাভাবিকভাবেই রোগী জানতে চেয়েছিলেন, ওই লো-কার্বোহাইড্রেট ডায়েট কী? উত্তর শুনলে পিজির ডাক্তারবাবুও বোধ করি আমার মতো স্তম্ভিত হবেন। উত্তরটা ছিল—দেখুন, ওটা জানতে আপনাকে অমুক ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে। গ্যাসট্রোর ‘সিলেবাসে’ তো ডায়েট থাকে না! ভাবুন এবার! ডাক্তারবাবুর ফি হাজার দেওয়া হয়ে গেছে এবার আর এক দফা দিতে হবে, তবে জানা যাবে ডায়েট! তারচেয়েও বড় কথা, সত্যিই কি পেটের হবু ডাক্তারবাবুদের সিলেবাসে ‘ডায়েট’ থাকে না? জানি না। কেউ আলোকপাত করলে আমাদের মতো সাধারণ বাধিত হয়। তবে, কথা হল—‘সিলেবাসে’ যদি নাও থাকে, তবু কি এটা মানতে হবে পেটের যন্ত্রপাতি বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তারবাবুর সামান্য একটা ডায়েটজ্ঞান নেই! নিশ্চয়ই আছে। আর আছেই যদি তাহলে জানাতে আপত্তি কেন? তাছাড়া, এমনকী একজন রোগীকে বলা যায়! এও তো এক ধরনের ‘প্রত্যাখ্যান’—তাই না?
এর ওপর আছে রাজনীতি। হাসপাতাল, নার্সিংহোম থেকে অপারেশন থিয়েটার—রাজনীতি কোথায় নেই? মনে পড়ছে, আজ থেকে বছর দশেক আগে চেন্নাইতে এক প্রবাদপ্রতিম শল্যচিকিৎসক, যাঁকে রোগীরা ব্রেন অপারেশনের ভগবান বলে আজও মানেন, এক আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন, সার্জন অপারেশন ঠিকঠাক করলেই যে শেষ অবধি তার পুরো সুফল রোগী পাবেন এমন কিন্তু নয়। সার্জন একেবারে সফল অস্ত্রোপচার করলেও তার পরের শুশ্রূষা (পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার) যদি যথাযথ না হয় তবে বিপরীত ফলও হতে পারে। যে কোনও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তা থেকে চিকিৎসক থেকে নার্স, সাফাইকর্মী সকলে একযোগে একলক্ষ্যে কাজ করলে তবেই রোগী যথার্থ চিকিৎসা পান। সেটা যেখানে ঘটে না সেখানেই চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে, রোগী পরিবারে ছড়ায় অসন্তোষ অনাস্থা। তাছাড়া, রাজনীতি তো আছেই। সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত যদি রাজনীতি ঠেলতে হয় তবে চিকিৎসাই বা হবে কখন আর সে সংক্রান্ত পড়াশোনাই বা করব কখন? বাম জমানার শেষদিকে এই রাজনীতির প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে চেন্নাই চলে গিয়েছিলেন ওই বিখ্যাত সার্জন। এটাও তো সত্যি। অর্থাৎ কেবল রোগী নয়, অনেক কৃতী ডাক্তারবাবুও কিন্তু দক্ষিণপন্থী হয়েছেন। সুতরাং, দক্ষিণে চিকিৎসা করাতে যাওয়া রোগীদের ব্যাপারে ক্ষুণ্ণ হওয়ার আগে ডাক্তারবাবু একটু ভাববেন নিশ্চয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দক্ষিণযাত্রা নিয়ে ওই ডাক্তারবাবু যতই ক্ষোভ প্রকাশ করুন, উনি কিছুতেই রোগী প্রত্যাখ্যান করবেন না। কারণ, ওঁর সুনামই এক্ষেত্রে ওঁর পথরোধ করে দাঁড়াবে এবং আন্তরিক চিকিৎসায় প্রণোদিত করবে। সে প্রণোদনা অস্বীকার করার ক্ষমতা ডাক্তারবাবুর নেই।
কারণ, দিন শেষের বিচারে ওঁর মতো প্রতিভাবান ডাক্তারবাবু মাত্রেই রোগীর দূরসম্পর্কের নিকটাত্মীয়। রোগজ্বালার শত যন্ত্রণার মধ্যেও আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। আর এই আত্মীয়তার বন্ধন খারিজ করা কি ডাক্তার কি রোগী—উভয়ের পক্ষেই অসম্ভব। কতটা অসম্ভব—তা দেখিয়ে দিয়ে গেলেন অকালপ্রয়াত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আশিস মুখোপাধ্যায়। কলকাতার চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয়বাহুল্য ভেবে যাঁরা দিশেহারা হয়ে যান—তাঁদের চোখে কার্যত আস্থা-বিশ্বাসের ধ্রুবতারা হয়ে উঠেছিলেন ডাক্তার আশিস এবং তাঁর স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান নেতাজি সুভাষ ক্যান্সার রিসার্চ হাসপাতাল। একেবারে হতদরিদ্র থেকে ধনী—আশিসের হাসপাতালে সমমর্যাদা ও সমগুরুত্বে চিকিৎসা পেয়েছেন, পাচ্ছেন। আশা করব, তাঁর অবর্তমানেও এর কোনও ব্যত্যয় হবে না। লোকমুখে শুনে বলছি না।
বিগত দশ বছরেরও অধিককাল ওই চিকিৎসালয়ের পরিষেবা নিতে গিয়ে আমার সাধারণ অভিজ্ঞতার কথাই বললাম। ক্যান্সারের মারণ থাবা থেকে হয়তো তিনি সমস্ত রোগীকে রক্ষা করতে পারেননি কিন্তু তাঁর ঐকান্তিক চিকিৎসা প্রয়াস রাজ্যের এমনকী ভিনরাজ্য বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্যান্সার আক্রান্তদের মনেও একটা প্রবল আস্থার সঞ্চার করেছিল। হাসপাতালের দিনরাত জোড়া ভিড় সেই আস্থার সংকেতই ভেসে বেড়িয়েছে, ভেসে বেড়াচ্ছে। এবং, সত্যি বলতে কি—একজন চিকিৎসক ঘুমে জাগরণে কেবল রোগী চিন্তায় মগ্ন, যেন সেই তাঁর একমাত্র সাধনা সেই তাঁর বিনোদন, যেন সেই তাঁর ধেয়ানের আলোকরেখা—এমনটি অন্তত আমি দ্বিতীয় দেখিনি। নিশ্চয়ই আছেন আরও অনেকেই—আমার দুর্ভাগ্য তাঁদের সাক্ষাৎ আমি পাইনি।
ডাক্তার আশিসের ‘ও কিছু না, ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে’র মতো অভয়বাণী ক্যান্সারের মারণডাক বেজে চলা রোগীর বুকেও কতটা বাঁচার আবেগ জাগিয়ে তুলে তো তার সাক্ষ্য হাসপাতালে পা দিলেই মিলে যাবে আজও। বলতে কী ডাক্তার আশিসের আকস্মিক প্রয়াণে দেশরাজ্যের হাজারো মারণ রোগাক্রান্ত প্রকৃত অর্থেই বাজবিদ্যুতে ভরা খোলা আকাশের নীচে এসে পড়লেন। বজ্র ঠেকাবার যে আস্থাভরা বর্মটি এতদিন তাঁদের মাথার ওপর অতন্দ্র ছিল—আর রইল না। আজ নয়াবাদে তাঁর হাসপাতাল জুড়ে সেই হাহাকারই যেন ছড়িয়ে রয়েছে। রোগী-রোগিণী থেকে হাসপাতালকর্মী সকলের মুখেই যেন এক দূরসম্পর্কের নিকটাত্মীয় বিয়োগের কালশিটে ব্যথা।
এ তো বড় কম কথা না। তাহলে গর্বের সঙ্গে বলতে পারি তো—আমাদের রাজ্যেও এমন চিকিৎসা পরিষেবার আয়োজন সম্ভব, এমন রোগী আস্থা উপার্জন সম্ভব। এমন ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সমমানের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। দেওয়া হয়। ডাক্তার আশিস পেরেছেন। রাজ্য সরকারের হাসপাতালগুলোতে, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, সুপার স্পেশালিটিতে হাজার ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও চিকিৎসার উত্তম এবং আধুনিক আয়োজন যে আছে তাতেই বা সন্দেহ কী? আছেন প্রতিভাবান ডাক্তারবাবু চিকিৎসাকর্মীরা। না থাকলে রাজ্যের হাজারো লাখো গরিবগুর্বো, সাধারণ কি এমন সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারতেন? তারপরও যদি কেউ চান যাবেন, ভিন রাজ্যে মনোমতো চিকিৎসালয়ে—দূরসম্পর্কের নিকটাত্মীয় সন্ধানে। আপত্তি কীসের! তবে, গেলেই যে সব সময় মেলে না—সেই বাস্তবতাও কিন্তু স্বীকার করেন অনেকে। তাহলে উপায়? একটু ভাবুন।