পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
কাল মার্কস শিখিয়েছিলেন, ক্ষমতা কেড়ে নিতে হয়। কারণ সব শাসকই শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। মার্কস সাহেবের এই লড়াইয়ের রাস্তা ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সামন্ত প্রভুর বিরুদ্ধে। বহু যুগ পরেও তার প্রাসঙ্গিকতা থেকেই গিয়েছে। বিশেষ করে বিরোধীদের কাছে। বিরোধী রাজনীতিতে জঙ্গিপনার এখনও বেশ কদর। মার্কসীয় দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দিলীপবাবুদের রাজনীতির অবস্থান। আদশর্গত অবস্থানের বিচারে উভয় দলের সম্পর্ক একেবারেই সাপে নেউলে। তা সত্ত্বেও দিলীপবাবু সেই জঙ্গিপনাকে আঁকড়ে ধরেই রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হতে চাইছেন। তাঁর চলনে, বলনে দিন দিন সেই ছাপই প্রকট হচ্ছে।
কট্টর আরএসএস ঘরানার মানুষ দিলীপবাবু খুব ভালো করেই বুঝেছেন, বিরোধী দলের জায়গাটা শক্তপোক্ত করতে হলে শাসকের বিরুদ্ধে জেহাদকে সপ্তমে চড়াতে হবে। শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আছে, প্রমাণ দিতে পারলেই বিরোধী মনস্ক লোকজনকে একছাতার তলার নীচে আনা সম্ভব। তাই ছোবল মারার শক্তি থাক বা না থাক, ফোঁস করতেই হবে। শিখিয়ে গিয়েছেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
বিজেপির রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দিলীপবাবু সেই কাজটি অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে যাচ্ছেন। সাফল্যও পেয়েছেন। দলগত এবং ব্যক্তিগত। সংগঠনের ছিটেফোঁটা না থাকা সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে রাজ্যের প্রায় অর্ধেক আসন কব্জা করেছেন। তাঁরই নেতৃত্বে এরাজ্যে বিরোধী দলের জায়গাটা বিজেপির পাকা করেছেন। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আবার ব্যক্তিগতভাবে প্রথমে তিনি বিধায়ক এবং পরে সংসদ সদস্য। এখন তিনি দলের কোচ কাম প্লেয়ার।
একটা সময় কলকাতার ময়দানে পিকে ব্যানার্জির ‘ভোকাল টনিক’ ছিল চর্চার বিষয়। অনামী খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়েও স্রেফ ভোকাল টনিকের জোরে ম্যাচ বের করে আনতেন। খেলোয়াড়দের চাঙ্গা করার জন্য নতুন নতুন কৌশল বের করতেন। আর সেই অনন্য ক্ষমতার জন্য পিকের কোচ হিসেবে চাহিদাও ছিল তুঙ্গে।
অনেকেই মনে করছেন, রাজনীতির ময়দানে দিলীপবাবু একইভাবে অনামী খেলোয়াড়দের নিয়ে ম্যাচ বের করতে চাইছেন। ভরসা ভোকাল টনিক। খড়্গপুর উপনির্বাচনেও কর্মীদের ভোকাল টনিক দিয়েছিলেন। ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’ স্টাইলে দিলীপবাবুর ডায়ালগ ছিল, ‘ভোটের দিন বাইরের লোক খড়্গপুরে ঢুকবে হেঁটে, ফিরবে খাটিয়ায় চেপে।’ কিন্তু, টনিক কাজ করেনি। ঘটেছে দুর্গের পতন। তবে ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ পরামর্শ মেনে লড়াইয়ে টিকে থাকার নিরন্তর চেষ্টায় মগ্ন গেরুয়া শিবিরের সেনাপতি। উপনির্বাচনে ভরাডুবিতে ঝিমিয়ে পড়া কর্মীদের চাঙ্গা করতে ভোকাল টনিকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। তাতে মাঝেমধ্যেই ফাউল করছেন। দেখছেন হলুদ কার্ডও। কিন্তু, সতর্ক হওয়ার লক্ষণ নেই।
সিএএ ইস্যুতে উত্তরপ্রদেশে আন্দোলনকারীদের গুলি করে মারাকে সমর্থন জানিয়ে দিলীপবাবুর বক্তব্য, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করতে গেলে গুলি করে মারাই উচিত। অনেকেই ভেবেছিলেন, উত্তেজনার বশে মুখ ফসকে দিলীপবাবু একথা বলে ফেলেছেন। নিশ্চয়ই তিনি আর পাঁচজন রাজনৈতিক নেতার মতো সংবাদ মাধ্যমের উপর দায় চাপিয়ে দাবি করবেন, তাঁর কথার অন্য ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কিন্তু দিলীপ ঘোষ সে বান্দা নন। উল্টে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানিয়ে দিলেন, তিনি তাঁর অবস্থান থেকে একচুলও নড়ছেন না। যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। অর্থাৎ, দিলীপ ঘোষ ভাঙবে, কিন্তু মচকাবে না।
বাংলার বুকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের একটা প্রভাব আগেও ছিল, এখনও আছে। মেগা সিরিয়ালের দৌলতে সেটা বেড়েছে বই কমেনি। তাই বুদ্ধিজীবীদের গেরুয়া ছাতার নীচে আনার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু, সেই প্রয়াস তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। তাই দিলীপবাবুর এখন টার্গেট, বুদ্ধিজীবীরা। বাংলা চলচ্চিত্রের অতি পরিচিত মুখ সব্যসাচী চক্রবর্তী সহ অনেকে সিএএ’র বিরোধিতা করে ‘কাগজ না দেখানোর’ মতামত ব্যক্ত করতেই দিলীপবাবু তাঁদের ‘নিমকহারাম’ বলতে সময় নেননি। তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু, স্ট্যান্ড বদলাননি। উল্টে পরের দিন আরও কুৎসিত আক্রমণ, যাদের বাবা মায়ের ঠিক নেই তারাই ক্যা এর বিরোধিতা করছেন। অনেকেই ছি, ছি, করছেন। কিন্তু, দিলীপবাবু নিজের বক্তব্যে অবিচল।
একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে সংবাদ মাধ্যমের ফুটেজ খাওয়ায় দৌড়ে তিনি অনায়াসেই কেষ্ট মণ্ডলকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন। তবে, তাঁর মন্তব্যে দল প্রশ্নের মুখে পড়ছে। গুলি করে মারার হুমকি সাধারণ মানুষ তো বটেই, তাঁর দলেরই অনেকে হজম করতে পারেননি। তাঁরা মনে করছেন, চোখা চোখা ডায়ালগে হাততালির ঝড় ওঠে, কিন্তু ফ্লোটিং ভোটারদের নিয়ে বাড়ে সংশয়। কারণ অনেকেই মনে করতে পারেন, শাসকের চেয়ারে বসলে দিলীপবাবুরা গুলি করে আন্দোলনকারীদের দমনপীড়নের পথ নেবেন। এই ধারণা একবার মনে গেঁথে গেলে মানুষ মুখ ফেরাতে সময় নেবে না।
তাই দলের কেউ কেউ সিএএ ইস্যুতে আন্দোলনকারীদের গুলি করে মারার সমর্থনের বিষয়টিকে ‘দিলীপ ঘোষের ব্যক্তিগত বক্তব্য, দলের কথা নয়’ বলে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করছেন। কিন্তু, তাতে দিলীপবাবু মোটেই বিচলিত হননি। কারণ তিনি জানেন, রাজনীতিতে ‘হিম্যান’ ইমেজের একটা অন্যরকম ভ্যালু আছে। আর সেটাই তিনি অত্যন্ত সযত্নে গড়তে চাইছেন। তাই বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ভুল স্বীকার তো অনেক বড় কথা, তিনি নিজেকে যে বদলাবেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
যে কোনও নির্বাচনে মুখ একটা ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করে। সে পুরসভার নির্বাচন হোক বা বিধানসভা কিংবা লোকসভা। ভোটাররা একটা ভরসাযোগ্য মুখ খোঁজে। বিগত লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবির নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যতটা সফল হয়েছিল, ঠিক ততটাই ব্যর্থ হয়েছিল বিরোধীরা। মুখের সুবাদেই ‘ক্লিন সুইপ’ করেছিল বিজেপি।
এরাজ্যের শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর মুখ স্পষ্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি এখনও মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে কাউকে সামনে আনেনি। কিন্তু, বিরোধী দলের প্রধান মুখ হিসেবে দিলীপ ঘোষের জায়গা পাক্কা। সমকক্ষ তো দূরের কথা, তাঁর ধারে কাছে কেউ নেই। কারণ রাজ্য সভাপতির প্রথম ইনিংসে বিজেপিকে প্রায় শূন্য থেকে তুলে এনে প্রধান বিরোধীর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সেই কৃতিত্বের পুরস্কার, দ্বিতীয়বার রাজ্য সভাপতি।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, এবার তাঁর লক্ষ্য রাজ্যে এক নম্বর হওয়া। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, সেই লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে খেলতে হবে ঝোড়ো ইনিংস। দক্ষ খেলোয়াড়ের খামতি মিটিয়ে ম্যাচ বের করতে হলে কোচের একমাত্র অস্ত্র কৌশল। তাঁকে থাকতে হবে প্রচারের আলোয়। হয়ে উঠতে হবে চর্চার কেন্দ্র। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, আরও চোখা চোখা ডায়ালগে সম্বৃদ্ধ হবে তাঁর ভাষণ। এই মুহূর্তে সেটাই তাঁর ইউএসপি।
নেগেটিভ প্রচারও এক ধরনের প্রচার। নেগেটিভ প্রচারের দৌলতে বিতর্কিত অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে টক্কর নেওয়ায় যায়, প্রধান বিরোধী মুখ হওয়া যায়, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া যায় না। কারণ
রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলা কথা বলে অন্য ভাষায়।