পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
যারা ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটিকে অপছন্দ করে, তারা ধরেই নেয় ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটির মানে হল ওই যেসব বিখ্যাত ব্যক্তি আমার পছন্দের দলের বিরোধিতা করছেন, আমার প্রিয় নেতানেত্রীকে আক্রমণ করছেন, আমার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানের দলটির ছাতার তলায় এসে জড়ো হয়েছেন, তাঁরাই। আসলে কি তাই? মোটেই নয়। এরা ইন্টেলেকচুয়াল হতেও পারেন, নাও পারেন। আমার মুখটা টিভি অথবা সিনেমা কিংবা অনুষ্ঠানের বদান্যতায় জনসমাজে পরিচিত মানেই আমি ইন্টেলেকচুয়াল তা হয় না। ইন্টেলেকচুয়াল মানে একঝাঁক কবি, সাহিত্যিক, সিনেমা স্টার সেলেব্রিটি মোটেই নয়। তাঁরা তো সামান্য কয়েকজন!
একজন সম্পূর্ণ আড়ালে থাকা, নিজের মনে নিজের সংসারধর্ম, পেশায় থেকে জীবন প্রতিপালন করা মানুষও ইন্টেলেকচুয়াল হতে পারেন। ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটির প্রথমাংশ ইন্টেলেক্ট। অর্থাৎ শানিত বুদ্ধি। ইন্টেলেকচুয়াল তাঁরাই, যাঁরা নিজের বুদ্ধি দিয়ে সামাজিক ঘটনাক্রমকে বিশ্লেষণ করেন, অবস্থান গ্রহণ করেন। ইন্টেলেক্ট বাড়ানো যাবে কীভাবে? সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন ভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা এবং পড়াশোনা করা। বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী সব ধরনের পড়াশোনা। নিছক সোশ্যাল মিডিয়ার শিক্ষা নয়। যা আমার কাছে শেয়ার করা হচ্ছে সেগুলি ভেরিফাই করা, ক্রস চেক করা যে, সত্যিই এই ফরওয়ার্ড করা মেসেজ সঠিক তো? নাকি আমাকে বোকা বানানো হচ্ছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে? আমার অধীর বিদ্যা, আমার মধ্যে থাকা পূর্বপুরুষের ডিএনএ, জিন, আমার শিক্ষা, আমার সংস্কৃতিচর্চা, সমস্ত কিছুর মিশ্রণ দিয়ে, আমি স্থির করব কোনও একটি সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনায় আমার অবস্থান কী হবে। কোনও বাইরের নেতা বা নেত্রী স্থির করে দেবেন না আমার অবস্থান। দল অথবা সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত ভালো? নাকি খারাপ? এটা আমি দেখেশুনে উপলব্ধি করে বিচার করব। আমার দল একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অতএব সেটি ভালো হতে বাধ্য—এরকম বুদ্ধিহীন, চিন্তাহীন জীবনযাপন নিজেরই অসম্মান নয়? ইন্টেলেকচুয়াল হতে গেলে কবিতা লিখতে হবে না, সিনেমা করতে হবে না, দার্শনিক ভাষণ দিতে হবে না। শুধু নিজের সিদ্ধান্ত নিজের বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে নিলেই হবে। আমার বিপরীত মতামত যার, সেই লোকটি বোকা এবং শত্রুপক্ষের—এই মনোভাব থেকেও দূরে থাকার শক্তি অর্জন করা।
এই যে নিজের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে অবস্থান গ্রহণ করা, এটাই সবথেকে কঠিন। আর এটাই ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার প্রথম ধাপ। তাই কে সেলেব্রিটি আর কে সেলেব্রিটি নয়, সেটা দিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল হওয়া মোটেই নির্ভর করে না। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ যদি কোনও দলদাস না হন, কোনও নেতানেত্রীকে নিজের রোলমডেল হিসাবে বন্দনা না করেন, প্রতিটি ঘটনাকেই পৃথক পৃথকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করেন, তা হলে তিনিও কিন্তু একজন ইন্টেলেকচুয়াল। সমস্যা হল, যারা ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটিকে ঘৃণা করে, তারা আসলে চিন্তার শক্তিকেই ঘৃণা করে এবং ভয় পায়। তারা কোনও একটি বিশেষ দল বা নেতানেত্রীর ভক্ত হয় এবং তারা নিজেরাই যদি লক্ষ্য করে, দেখতে পাবে, তারা আসলে কোনও বিশেষ সিদ্ধান্তের সমর্থক নয়। তাদের প্রিয় দল বা নেতানেত্রী যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটাই তাদের সমর্থন পায়। তারা অযথা ওই সিদ্ধান্তটির পক্ষে নানারকম যুক্তিতর্ক দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করে। তারা এটা ভুলে যায় যে তার প্রিয় দল বা সরকারের নেওয়া ওই সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের জন্য ভালোই হোক অথবা খারাপ হোক, তারা সমর্থন করবেই। কারণ, তাদের প্রিয় দল ও নেতা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা আজ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কিংবা এনআরসি সমর্থন করছে, তারা প্রচ্ছন্ন একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে, যেন এই আইন দেশের জন্য খুব ভালো বলেই তারা সমর্থন করছে। আদতে তা কিন্তু নয়। এই আইন তাদের প্রিয় সরকার, দল ও নেতা গ্রহণ করেছেন বলেই তারা সমর্থন করছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অথবা শাসক দলের সব আচরণ, সব সিদ্ধান্ত মোটেই সমর্থনযোগ্য হয় না। আর সেটা যে হয় না, সেটা শাসক দল বিভিন্ন সময় প্রমাণও পেয়েছে। মানুষ বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।
সুতরাং ইন্টেলেকচুয়াল এবং সেকুলার হওয়ার অর্থ হল, পক্ষপাতহীন থাকা। নরেন্দ্র মোদির যে সিদ্ধান্তগুলি সত্যিই ভালো, সেগুলি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করা। আর যে কাজগুলি খারাপ তার তীব্র সমালোচনা করা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসংখ্য সরকারি প্রকল্প জনস্বার্থবাহী। সেকথা স্বীকার করা। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের আপত্তিকর কার্যকলাপও স্বীকার করতে হবে। একেই বলা হয় নিরপেক্ষ অবস্থান।
চিন্তার শক্তি এবং কোনও দলের প্রতিই মোহহীন অবস্থান না থাকলে ক্রমেই একটি দেশে মাথা চাড়া দেয় একটি বিশেষ শাসন প্রবণতা। সেটির নাম ইওরোপের চিন্তাবিদরা দিয়েছেন ন্যাশনাল পপুলিজম। বিশ্বজুড়ে ন্যাশনাল পপুলিজম সবথেকে বেশি চাপে ফেলছে এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে লিবারালিজমকে। অর্থাৎ উদার- মনস্কতাকে। সেই চ্যালেঞ্জের প্রথম ধাপ হয় পোস্ট ট্রুথ। আর প্রতিটি জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেওয়া এই ন্যাশনাল পপুলিস্ট দলের অন্যতম অস্ত্র হয় জাতিসত্ত্বাকে জীবনযাপনের অগ্রাধিকার হিসাবে স্থান দেওয়া। তাই বিশ্বের সর্বত্র ন্যাশনাল পপুলিস্টদের প্রধান ইস্যু আজ ইললিগ্যাল ইমিগ্রেশন। জার্মানিতে ফিরে এসেছে এরকম ন্যাশনাল পপুলিস্ট দল, হাঙ্গেরিতে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছে, ইতালিতে জোট সরকার গঠন করে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক ইন্টিরিয়র মিনিস্ট্র দখল করেছে। ফ্রান্সের যে শহরগুলিতে ন্যাশনাল পপুলিস্ট লিডার মেরিন ল্য পেনের প্রশাসন প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেইসব শহরবাসী কিন্তু বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি। আবার সুযোগ দিয়েছে। সুইডেনে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী সুইডেন ডেমোক্র্যাটস। এই তালিকায় সবথেকে উজ্জ্বল দুটি নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বরিস জনসন। ন্যাশনাল পপুলিস্টদের সবথেকে বড় সাফল্য কিন্তু আমজনতার সমর্থন নয়। তাদের সবথেকে বড় সাফল্য হল বিরুদ্ধপক্ষীয় লেফট অথবা সেকুলার লিবারাল দলগুলিকেও তারা বাধ্য করে কিছুটা নিজেদের আদর্শের দিকে নিয়ে আসতে। যাদের আজকাল পশ্চিমি দেশে বলা হচ্ছে, ন্যাশনাল পপুলিস্ট লাইট। ঠিক ভারতে যেমন প্রায় তাবৎ বিজেপি বিরোধী দলগুলি আজ পূর্বের অবস্থানে আর ফিরতে পারবে না। সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যাবে, তারা আজকাল আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির তীব্র বিরোধিতা করতে পারছে না। কারণ ভোটব্যাঙ্ক। অর্থাৎ তারাও পা দিয়েছে সফট হিন্দুত্বে! এটাই সাফল্য ন্যাশনাল পপুলিজমের!