বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
নোটবন্দি করতে গিয়ে তিনবছর আগে প্রধানমন্ত্রী মোদি দাবি করেছিলেন, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি কালো টাকার অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করবেন। বিদেশ থেকেও ধনকুবেরদের গচ্ছিত কালো টাকা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার ছিল তাঁর ভাষণে। গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নগদ টাকার ভূমিকা কমিয়ে ডিজিটাল লেনদেনের উপর নির্ভরতা বাড়ানোই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। প্রথমটায় সাধারণ মানুষ অপরিসীম কষ্টের মধ্যে পড়লেও কালোটাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারের সাধু প্রয়াস বলে পুরো বিষয়টিকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু আজ প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, কালোবাজারিদের শায়েস্তা করার বদলে নোটবাতিল জব্দ করেছে সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষকেই। কেউ চাকরি হারিয়েছে, কেউ ব্যবসা হারিয়ে সর্বস্বান্ত। লাভের লাভ হয়নি কিছুই।
নোটবাতিলের কয়েক মাস পর থেকেই বলা হচ্ছে, বাজারে ছাড়া ৯৯ শতাংশ নোটই নাকি ঘরে ফিরেছে। তাজ্জব কী বাত! তাহলে সবই যখন একই রইল, কারও ঘরে কি তাহলে কোনও কালো টাকা ছিলই না। নাকি এই সুযোগে কতিপয় বড় শিল্পপতির কালো টাকা সুকৌশলে সাদা করে দেওয়াই ছিল নেপথ্যের আসল খেলা। কে জানে! তাহলে নোটবন্দিতে আসলে বন্দি হল কে? কালো টাকার মালিক না সাধারণ গরিব দেশবাসী?
১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। আর একনায়ক মোদির হাত ধরে ২০১৬ তে স্বাধীন ভারতে প্রথমবার অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। সেই সব বিভীষিকাময় দিনগুলি সহজে ভোলার নয়। লাইনে দাঁড়িয়ে শতাধিক প্রবীণ নাগরিকের মৃত্যু, কাজহারা শ্রমিকের যন্ত্রণা কিম্বা ছোট মাঝারি ব্যবসা লাটে ওঠার হতাশা দেশবাসীকে খাদের কিনারায় এনে ফেলেছিল। আর আজ তিনবছর পর দেখা যাচ্ছে গোটা প্রক্রিয়াটাই ধাপ্পা। এত কিছু করে হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়েও কালো টাকার কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া গেল না। সব টাকাই নাকি ফেরত চলে এসেছে। তাহলে কালো টাকা কোথায় গেল? কালো টাকা ধরার আড়ালে তাহলে কি কালো টাকা সাদা করে দেওয়ার খেলা চলল। এমনও বলা হয়েছিল, কালো টাকার বিরুদ্ধে এর আগে আর কখনও এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ঘোষণা করতে দেখা যায়নি দেশের শাসককে। কিন্তু আজ তিন বছর পেরনোর পর দেখা যাচ্ছে, মোদি সরকারের নোটবন্দির কোনও উদ্দেশ্যই সফল হয়নি। শুধু দুর্ভোগই পোয়াতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।
তিনবছর পর কেন্দ্রীয় রিপোর্টই বলছে, জাল টাকা আগের মতোই এখনও ভারতীয় অর্থনীতির গলার কাঁটা। ৫০০ ও ১০০০ টাকা তুলে নিয়ে মোদি সরকার তার পরিবর্তে বাজারে ছেড়েছিলেন ২০০০ টাকার নোট। বলা হয়েছিল, এই ‘অবতার’কে নকল করা নাকি দুঃসাধ্য! কোনওভাবেই নকল করা সম্ভব নয় এমন কিছু রক্ষাকবচ অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারি রিপোর্টই বলছে, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে এই ২০০০ টাকার নোটই জাল হয়েছে সর্বাধিক। ধরাপড়া জাল নোটের ৫৬ শতাংশই ২০০০-এর নোট! আর এক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে মোদি-অমিত শাহদের গুজরাত। দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। ভয়ঙ্কর তথ্য, সন্দেহ নেই। যে-উদ্দেশ্যে ২০০০ টাকার নোটের প্রবর্তন তা যে শুধুমাত্র ফাঁকা আওয়াজ ছিল, জাল নোট যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এখনও এক বিরাট বিপদ তা পরিষ্কার। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে মোদি সরকার এত বড় ঝুঁকি নিয়েছিল কেন? ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাজার থেকে সরিয়ে নিয়ে নতুন ২০০০ টাকার নোট ছাড়তে সরকারি কোষাগারের খরচ হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা। সেই অপচয়ের কী জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অর্থমন্ত্রকের বিশেষজ্ঞরা? এমনও শোনা গিয়েছিল, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া নোটবন্দির ব্যাপারে আর কেউই আগাম কিছু আঁচ করতে পারেননি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও পুরো পরিকল্পনার কথা জানতেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এমনকী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত প্যাটেলও শেষ মুহূর্তে ভাসা ভাসা কিছু শুনেছিলেন। পুরোটা জানতেন না বলেই খবর। এত বজ্র আঁটুনি সত্ত্বেও দেশের লাভটা কী হল? শুধু মোদিজির শখ মেটানোর জন্যে এত বড় ঝুঁকি দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল কেন?
কালো টাকা বা সমান্তরাল অর্থনীতি আজও যেমন চলার তেমনিই চলছে। নগদ টাকার লেনদেনের গুরুত্ব আজও এতটুকুও কমেনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, তাঁর সিদ্ধান্তের ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলির আর্থিক মেরুদণ্ডই নাকি ভেঙে যাবে! কারণ, সীমান্তপারের শত্রুরা জাল নোটের মাধ্যমেই তাদের কাজকর্ম চালায়। কিন্তু জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভাঙা দূরের কথা, তাদের অনেকের কাছ থেকেই দেদার জাল ২০০০-এর নোট মিলছে। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে পর পর দু’বছর প্রায় ৪৬-৪৭ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়েছে, যার সিংহভাগই ২০০০ টাকার। এসবই প্রমাণ করে, নোটবন্দির কোনও উদ্দেশ্যই সফল হয়নি। শুধুমাত্র দেশের মানুষের দুর্ভোগই বেড়েছে। আর রাজকোষ থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে নতুন নোট ছাপাতে। অন্য দেশ হলে এর দায়ভার নিশ্চয় সরকারের ঘাড়ে বর্তাতো। এবং, গোটা দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে কৈফিয়তও দিতে হতো। কিন্তু ভারত অতিরিক্ত উদার দেশ। তাই এখানে সরকারের সর্বোচ্চ পদে আসীন কোনও ব্যক্তির ভুলের শাস্তি হয় না। দুর্নীতিরও শাস্তি হয় না। ধামাচাপা দিতে নাম কা ওয়াস্তে একটা তদন্ত হয়, কিন্তু তার রিপোর্ট আর বেরোয় না। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হলেও কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। তাই এখানে রাজনীতির রাঘব বোয়ালরা বেশ সুখ-শান্তিতেই রাজ্যপাট সামলান। নোটবন্দির পিঠোপিঠি মোদি সরকার দ্রুত জিএসটি কার্যকর করে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে। সেই ক্ষত আজও পূরণ হয়নি। একদিকে নোটবন্দি, অন্যদিকে জিএসটি। এই জোড়াফলায় আজ ভারতীয় অর্থনীতি কার্যত ফুটিফাটা!
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়েই আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। অত্যন্ত কঠিন কাজ। একদিকে, মধ্যবিত্তের হাতে পয়সার জোগান বাড়িয়ে সাধারণ জিনিসের চাহিদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা তাঁকে করতে হবে। অন্যদিকে, থমকে যাওয়া ছোট ও মাঝারি শিল্পে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় নতুন ছোটখাটো কাজের সুযোগ বাড়বে না। তা নাহলে অর্থনীতি চিরঘুমে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ, ৩৭০ ধারা বাতিল, তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ কিংবা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন দিয়ে দেশবাসীর পেট ভরবে না। দেশের মানুষের চাই দু’মুঠো খাবার আর মাথাগোঁজার আশ্রয়। সেই ব্যবস্থা না করে শুধু মানুষে মানুষে বিভেদ আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে না। এই সার কথাটি মোদি-অমিত শাহদের বুঝতে হবে। নাহলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।