কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
অন্যদিকে, রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মতামত থাকবে, এবং থাকবে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক কৌশল। এর প্রেক্ষিতে বাম-কংগ্রেস পেশ করতে চাইছে বিজেপি-তৃণমূল গোপন আঁতাঁতের তত্ত্ব। বিজেপি বলছে তৃণমূল, কংগ্রেস এবং বাম সবাই একদলে হয়ে বিরোধিতা করছে বিজেপির, আদতে বাংলার মানুষের জনসমর্থনের নিরিখে এগিয়ে তারাই। সৌজন্য প্রকাশ বা রাজ্যের দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্যে নয়, রীতিমত চাপে পড়েই নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তৃণমূলের বক্তব্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে দোষের কিছু নেই। সেটাই একজন মুখ্যমন্ত্রীর সঠিক প্রশাসনিক ভূমিকা। তাদের মূল বক্তব্য হল সারা দেশে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে মেনে নিতেই হবে যে নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যদি কোনও গোপন আলোচনা করতে হয় সেক্ষেত্রে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির অনেক উপায় আছে। তার জন্যে নেতানেত্রীর মুখোমুখি বসে কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ এখানে বুঝতে হবে যে সহজ সরল ‘সেটিং’য়ের তত্ত্ব সত্যি হোক কি না-হোক, তা ক্যামেরার সামনে দুই নেতানেত্রীর বৈঠক কিংবা একই অনুষ্ঠান মঞ্চে পাশাপাশি বসার অনুসিদ্ধান্ত হতে পারে না। কিন্তু তাঁরা দুজন এই যে একাধিকবার দেখা করলেন, অথবা নরেন্দ্র মোদি যে বেলুড়ে রাত কাটালেন তার মধ্যে দেশের সবথেকে পরিচিত দুই নেতানেত্রীর সুগভীর রাজনৈতিক ভাবনা থাকতেই পারে। কিন্তু গোপন আঁতাঁতের কারণে তাঁদের কলকাতায় বৈঠক করতে হচ্ছে—এই যুক্তি একেবারেই অতি সরলীকরণ। যেহেতু দু’জনেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় দেশের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে, তাই তাঁরা ঠিক কী কী ভেবে এই সমস্ত পদক্ষেপ করেছেন তা হয় নিজেরাই জানেন, অথবা জানেন তাঁদের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহযোগীরা। বাকিরা শুধুমাত্র চেষ্টা করতে পারেন দূর থেকে তা অনুধাবন করতে। সেটা ঠিকও হতে পারে, আবার ভুলও। তবে রাজনীতি যেহেতু সম্ভাবনার বিজ্ঞান, তাই নেতানেত্রীর কৌশল অনুমান করতে দোষ কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোট এখনও বেশিরভাগটাই তৃণমূলের দিকে। সেখান থেকে বিজেপির ভোট কাটার সম্ভাবনা বেশ কম। নাগরিকত্ব নিয়ে তীব্র আন্দোলন বজায় রাখতে পারলে সেই ভোটে ভাগ বসাতে পারে বাম-কংগ্রেস জোট। একই ঘটনা ঘটবে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি মহাশয়ের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) নামক দলটি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে লড়তে এলে। তারা যদি সংখ্যালঘু জনমনে প্রভাব ফেলতে পারে, তাহলে ভোট কাটবে তৃণমূলের। এতে সুবিধে বেশি বিজেপির। অন্যদিকে এই মুহূর্তে হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ অবশ্যই বিজেপির দিকে, আবার সেখানে তৃণমূলের প্রতিও যথেষ্ট সমর্থন আছে। সেই ভোটের ভাগাভাগিটাও নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রসঙ্গে হিন্দু ভোটারদের আমরা তিনভাগে ভাগ করতে চাই। প্রথম হল একেবারে দক্ষিণপন্থী এবং তীব্র জাতীয়তাবাদী। এই ভোট বিজেপি থেকে সরার সম্ভাবনা খুব কম। দ্বিতীয় ভাগ হল মধ্যপন্থী। তাঁরা এই মুহূর্তে সিএএ ভালো না খারাপ সেই নিয়ে ভাবছেন। জাতীয়তাবোধ তাঁদের যথেষ্টই আছে, পড়শি দেশকে উচিত শিক্ষা দিলে তাঁরা খুশিই হন, কিন্তু একই সঙ্গে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কাগজপত্র জোগাড়ের হয়রানির কথা ভেবে তাঁরা কিছুটা সন্দিহান এবং বিরক্ত। এই জায়গার ভোট মূলত ভাগ হয় বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে। তৃতীয় ভাগ হল প্রগতিশীল উদারবাদী হিন্দু। কংগ্রেস বা বামফ্রন্টের টিমটিমে সমর্থককুল মূলত এই জায়গা থেকেই আসে। তৃণমূলের পক্ষেও এখানে যথেষ্ট সমর্থন আছে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই ভাগ থেকে বিজেপির পক্ষে সমর্থন পৌঁছনোর সম্ভাবনা বেশ কম।
অর্থাৎ বিজেপি আর তৃণমূল এই মুহূর্তে যে অংশের জন্যে লড়াই করবে তা হল মধ্যপন্থী হিন্দু ভোট। তাই গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে যে নরেন্দ্র মোদির দু’দিনের (ঘণ্টার হিসেবে এক দিনের মতো) কলকাতা সফর এবং বেলুড়ে রাত্রিবাস এই ধরনের ভোটারদের উপর কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে? আবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে সংসদীয় গণতন্ত্রের সৌজন্যের আড়ালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এই বার্তা দিতে পারেন যে তাঁর দলের মধ্যেও কিছুটা জাতীয়তাবাদী ভাবনা বর্তমান, সেক্ষেত্রে মধ্যপন্থী হিন্দু ভোটের উপর কিছুটা দখল রাখার সুযোগ থাকবে তাঁরও। সিএএ বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হলে এই ভোটের সামান্য কিছু অংশ হয়তো বাম-কংগ্রেসের দিকেও যেতে পারে, তবে সে আলোচনায় আমরা আপাতত আর এগচ্ছি না।
এই প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর বেলুড় মঠে রাত্রিযাপন এবং এবং ভোরবেলা ধ্যান করার বিষয়গুলি। মনে রাখতে হবে হিন্দুদের একটা বড় অংশ রামকৃষ্ণ মিশনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন। প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় আসার আগে এটা জানা ছিল যে তিনি বেলুড় মঠে যাবেন, কিন্তু সেখানে যে রাত কাটাবেন সেকথা সম্ভবত সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে জানা যায়নি। সে সংবাদ প্রচারিত হয় তিনি কলকাতা সফরে আসার দিনেই। ফলে এই খবরে চমক ছিল যথেষ্ট। তার উপর বেলুড় যাত্রা সড়কপথে নয়, বরং জলপথে গঙ্গা পার হয়ে। এর মধ্যে অবশ্যই দেশজ ঐতিহ্যের একটা ছোঁয়া আছে। সব থেকে বড় কথা, রাজভবনে না-থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী যে বেলুড় মঠে রাত্রিবাস করবেন, এতে তাঁর সাদামাটা জীবনযাপনের কথা জনমানসে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা বলাই বাহুল্য। তৃণমূল বা বাম-কংগ্রেসের গোঁড়া সমর্থকরা একে কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবেই দেখবেন। কিন্তু মধ্যপন্থী ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমাজের কাছে এটি সরাসরি রাজনৈতিক চাল হিসেবে গণ্য হবে না মোটেই। তার কারণ বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি মহাশয়ের সম্পর্ক যুবা বয়স থেকেই। তাই নরম হিন্দুত্বের অনুগামী বাঙালি জনমানসে এর ইতিবাচক প্রভাব কিছুটা পড়বেই। অর্থাৎ যে মধ্যপন্থী হিন্দু ভোটাররা গত লোকসভায় বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে নাগরিকত্ব সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে, তাঁদেরকে কিছুটা কাছে টানার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সম্ভবত সফল হতে পারেন নরেন্দ্র মোদি। বেলুড়ে বিবেকানন্দের জন্মদিনে যুবদিবসের ভাষণে তাই বারবার প্রধানমন্ত্রীর গলায় উঠে এসেছে রাজনীতির কথা। সিএএ যে মানুষের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, তা কেড়ে নেওয়ার নয়, সেই কথা জোর গলায় প্রচার করেছেন তিনি।
ঠিক এই জায়গাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চ্যালেঞ্জ। বাম-কংগ্রেস নাগরিকত্ব বিরোধী আন্দোলন এবং পশ্চিমবঙ্গে এআইএমআইএম-এর মৃদু উপস্থিতি সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তার সময় আসেনি তাঁর। তাই এখনও মধ্যপন্থী হিন্দু ভোটের দিকে নজর দেওয়ার সময় এবং সুযোগ থাকবে কিছুটা। সেই জায়গায় তীব্র মোদি-বিরোধী অবস্থান নিয়ে খুব লাভ হবে না। অর্থাৎ সোজা কথায় ব্রিটিশ নির্বাচনে জেরেমি করবিন অতি বামপন্থার যে পথ নিয়ে ভুগেছেন, সেই রাস্তা সযত্নে এড়িয়ে যেতে চাইছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তুলনায় তিনি হয়তো অরবিন্দ কেজরিয়ালের পদক্ষেপগুলি বঙ্গীয়করণের চেষ্টা করবেন। লক্ষ করলে দেখবেন যে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী গত প্রায় এক বছর ধরে বিজেপির জাতীয়তাবাদী ভাবনা এবং তার রূপায়ণের তীব্র বিরোধিতা করছেন না একেবারেই। দিল্লির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগরিকত্ব বিষয়ক আন্দোলন সমর্থন এবং বিরোধিতা এই দুই দিক থেকেই খুব সন্তর্পণে দূরত্ব বজায় রাখছেন তিনি। তুলনায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বিজেপি-বিরোধিতা বহুগুণে তীব্র। সেখানে একটু নরম মনোভাব দেখালে মধ্যপন্থী হিন্দু ভোটাররা হয়তো কিছুটা কাছে আসতে পারে। উল্টোদিকে সেই জায়গায় বাম-কংগ্রেস আরও জোর গলায় দাদা-দিদির সেটিংয়ের অভিযোগ তুলবে। ব্যঙ্গোক্তি শোনা যাবে ‘ক্যা ক্যা ছি ছি’ আর ‘কাছাকাছি’ গোছের শব্দবন্ধে। অর্থাৎ গোটা বিষয়টির রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বহুমাত্রিক, এবং কীসে লাভ কীসে ক্ষতি তা এই মুহূর্তে বুঝতে পারা শক্ত। তবে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিতর্ক যে সামনের বছর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিশেষ প্রভাব ফেলবে তাতে কোনও সন্দেহই নেই।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত