বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
রাষ্ট্রসংঘ ভারতকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সাত দশকে ভারতের সাধারণ মানুষ এই শিরোপা অর্জন করেছেন। এক রাজনৈতিক শক্তি থেকে অন্য রাজনৈতিক শক্তিতে ক্ষমতা বদল হয়েছে। কিন্তু দেশ নিজের গতিতেই চলেছে। গত মাত্র দু’বছরে আধ ডজনেরও বেশি রাজ্যে রাজনৈতিক দল বদলে গেল। বহু দশকের রাজনৈতিক জোট পাল্টে গেল, রাজনৈতিক সমীকরণ উল্টে গেল, জাতীয় দল ও আঞ্চলিক দলের উত্থান-পুনরুত্থান হল। কিন্তু গণতন্ত্রই জিতে গিয়েছে। জরুরি অবস্থার সামান্য কিছু সময়ের দুঃস্বপ্নের দিনগুলি বাদ দিলে গণতন্ত্রের পতাকা কখনও ভূলুণ্ঠিত হয়নি।
এর সবটুকু কৃতিত্ব ভারতের সাধারণ মানুষের। বুকের পাঁজর যেমন ছোট্ট হৃদপিণ্ডকে ঘিরে রাখে তেমন আপাতদৃষ্টিতে সরল, দেহাতি, বোকাসোকা মানুষেরা গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই সংখ্যাটাই বেশি। এটিই গণতান্ত্রিক ভারত। যাঁরা ভোট দেন, বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস মনে করেন না। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের একাংশের এত প্রতারণার পরেও গণতন্ত্রের উপরেই ভরসা রাখেন। এই ভারতের চেহারায় জৌলুস নেই, বিলিতি উচ্চারণে অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে না, তবে বংশপরম্পরায় দেশটাকে ভালোবাসে।
খুব সামান্য সংখ্যক মানুষ এই গণতান্ত্রিক ভারতের বিপক্ষে। কারণ, তাঁরা যে মতাদর্শে বিশ্বাস করেন তাতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থান নেই। এই মুষ্টিমেয় মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য ভারতকে ‘টুকরো টুকরো’ করা। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে অসহিষ্ণুতার নামে বিশ্ববাসীর কাছে গণতান্ত্রিক ভারতকে ছোট করাই হোক, কাশ্মীরের ভয়ানক নরসংহারকারীর জন্য মধ্য রাত্রে সুপ্রিম কোর্ট খোলার ব্যবস্থাই হোক কিংবা আজ শত শত ছাত্রের ভবিষ্যৎ বাজি রেখে নিজেদের অগণতান্ত্রিক বক্তব্য চাপানোর নিষ্ঠুর প্রয়াস, সবকিছুর পিছনে সেই হাতেগোনা কয়েকজন বাজিকর।
মজার ব্যাপার হল, আমাদের দেশের প্রচারমাধ্যমের একটা বড় অংশ এঁদের ফেলো ট্রাভেলার। কারণটা আদর্শগত নস্ট্যালজিয়া না পেশাগত ঋণশোধ, না কি নিছকই সস্তায় ‘নু্ইসেন্স ভ্যালু’ কাজে লাগানো? এই নিয়ে বৃহত্তর বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু বাস্তব হল—কলকাতার রাস্তায় গণতন্ত্রপ্রেমী হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠস্বর চেপে দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ছয়-সাতজনের গণতন্ত্র-বিরোধীর বেয়াদপি প্রবল গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় ছবিসহ দেখানো হয়।
বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ওই হাতেগোনা মানুষের মুখই উঠে আসে। কোন অজ্ঞাত কারণে কাশ্মীর প্রসঙ্গে রাহুল পণ্ডিতিয়া বা অনুপম খেরের মতো ভুক্তভোগী লেখক বা অভিনেতার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ পায় না জানি না। কিন্তু, লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের কথা অমৃত সমান! এই বাজিকরদের কথায় মনে হয় যে—দেশের সব দুঃখের কারণ হল ভারতীয় গণতন্ত্র! দেশটা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রসাতলে যাবে! তাই ছাত্রদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু ব্যয় করে, শিল্পী সাহিত্যিকদের সব পুরস্কার ফেরত দিয়ে, কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বর্বরোচিত ভাবে হেনস্তা করে এর প্রতিবাদ করা উচিত! আজও ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাজি রাখছেন ওই ‘পরিণত বুদ্ধি’র কয়েকজন। জেএনইউ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে ওই গরিব ছাত্রদের কথাও তো প্রচারে আসা উচিত, যাঁরা পরিবারের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে দিল্লিতে কেবল লেখাপড়া শিখতে এসেছিলেন। তাঁরা নতুন বছরে অনলাইন ফর্ম ভরেছিলেন। রুষ্ট জেএনইউএসইউ প্রতিবাদীদের দাপটে সার্ভার রুম ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, বহু টাকার অপটিকাল কেবল কেটে টুকরো টুকরো হল, সেইসঙ্গে এঁদের ভবিষ্যৎটাও। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ এমনই একটা বিষয় ছিল। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের এতে ক্ষতির কোনও সম্ভাবনা নেই। এই আইন একটি সার্বভৌম দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রচিত হয়েছে। এতে কোনও মানুষের নাগরিকত্ব বা কোনও অধিকার কেড়ে নেওয়ার কথা বলা নেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে যাঁরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে দেশভাগের পর থেকেই অত্যাচার সহ্য করেছেন, বর্তমান সরকার তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে চান। এই তিনটি দেশেই ইসলাম ‘রাষ্ট্রধর্ম’। তাই সেখান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে কোনও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে আসেননি। তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণে সিএএ-তে মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম নেই।
ওই অত্যাচারিত মানুষগুলির অবস্থা তথাকথিত মহাপণ্ডিতরা জানেন না? সারা পৃথিবীর মানবাধিকারের জন্য যাঁদের ঘুম হয় না, তাঁরা পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপর পাশবিক অত্যাচারের কথা শোনেননি! কিন্তু ওই মহামানবেরা ওই মানবিক কাজে কেবল বাধাই দিলেন না, অনেক মাথা খাটিয়ে গভীর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিলেন। যখন স্টেশনের পর স্টেশন জ্বলছে, কাতারে কাতারে বাস পোড়ানো হচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন করা চলছে, তখন অনেক সাংবাদিক বিক্ষোভকারীদের প্রশ্ন করেছেন, এসব করছেন কেন? প্রায় কেউই বিক্ষোভের কারণটা বলতে পারেননি।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কেউ অত্যন্ত যত্ন করে সাম্প্রদায়িকতার বীজ স্থানে স্থানে বপন করেছে। যে স্লোগানটি এই ক’দিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে তা কোনও মাদ্রাসায় তৈরি হয়নি—‘সে ইট অন দ্য ব্যারিকেড লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। শেষ অংশটি কোনও মাদ্রাসা বা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে যোগ করা হতে পারে। একদম সোজা অর্থ—লা (নেই) ইলাহা (ঈশ্বর) ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া)—‘আল্লাহ ছাড়া অন্যকোনও ঈশ্বর নেই।’ কিন্তু ‘সে ইট অন দ্য ব্যারিকেড’ এই অংশটি এল কোথা থেকে?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ফার্দিনান্দ ডে লা ক্রোয়ার আঁকা ফরাসি বিপ্লবের বিখ্যাত প্রতীকী ছবিটির কথা—‘লিবার্টি অন দ্য ব্যারিকেডস’—যেখানে রাইফেল হাতের সেই মহিলা, যাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও বস্ত্র নেই। এই ছবির সঙ্গে মাদ্রাসার কোনও দূরগামী যোগও নেই। এই উদ্ভাবন ওই কতিপয় বাজিকরের ঊর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু, যে-পথে জেহাদি উগ্রপন্থার কোনও নির্দেশ ভারতের প্রতি প্রান্তে পৌঁছে যায়, এক্ষেত্রেও সেই একই পথ ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু দেশের মধ্যে এই বিশৃঙ্খলা তৈরি করে গরিব দেশটার কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি পরিকল্পনামাফিক নষ্ট করে এঁদের কী লাভ? সঠিক উত্তর একটাই—‘ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে’। কিন্তু সুবিধাটা হল, এই পণ্ডিতদের কেউ প্রশ্ন করেন না, তাঁরাই কেবল গণতন্ত্রকে প্রশ্ন করেন। ভারত অসহিষ্ণু, কাশ্মীরে মানবাধিকার নেই, তিন তালাকের বিলোপে সংখ্যালঘুদের প্রাণান্তকর অবস্থা! আচ্ছা, সোভিয়েত রাশিয়ার অসহিষ্ণুতা তো আজ শিশুপাঠ্য কাহিনীতেও এসে গেছে। কবি ভারভারা রাও তো কয়েকটা কবিতা লিখতে পারেন তার উপরে। চীনে উইঘুর গোষ্ঠীর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানবাধিকারের একটা সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রবন্ধ তো লিখতেই পারেন রামচন্দ্র গুহ। প্রগতিবাদী ঔপন্যাসিক জানেন, বাংলাদেশের গণধর্ষিতা কোনও নমঃশূদ্র মেয়ের হৃদবিদারক কাহিনী তাঁকে লিখতে হবে না।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির অধিকর্তা সি এন ভট্টাচার্য এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। মাওবাদীরা কীভাবে কাশ্মীরের মুজাহিদিনদের মাধ্যমে আফগানিস্তানের তালিবানদের কাছ থেকে ‘রেডিও কন্ট্রোল্ড এক্সপ্লোসিভ’ এবং ‘আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি’ রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তি এদেশে প্রথম এনেছিল। এরাজ্যে এত শিক্ষিত চকচকে ব্যক্তিত্ব মাওবাদীদের সমর্থনে টিভিতে আসেন, কাগজের সম্পাদনা করেন, উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন কিন্তু ২০১৪ সালে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে কেউ তাঁদের প্রশ্ন করেনি, যে এত ভয়ানক প্রযুক্তি ভারতে আনা হল কেন? ভারতের কোন গরিব মানুষটি এতে উপকৃত হয়েছেন?
২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতায় আবার সেই দুই ভীষণ ভারত-বিরোধী শক্তি এক হয়েছে। কিন্তু ঝকঝকে চেহারার উচ্চশিক্ষিত তুখোড় ইংরেজি বলা পরিকল্পনকারীরা জানেন যে, ‘সে ইট অন দ্য ব্যারিকেড লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ তৈরি করে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর পরেও কেউ তাঁদের প্রশ্ন করবে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে যাঁদের বিশ্বাস, তাঁরাও নাচলেন সুতোর টানে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সব হারানো অত্যাচারিত হিন্দু উদ্বাস্তুরা সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন। নিজে উদ্বাস্তু কলোনিতে বড় হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিবারগুলির উপর পার্টির প্রভাব খুব কাছ থেকে দেখেছি। ব্রিগেডে বা কোনও বড় মিটিং হলে বাড়িতে বাড়িতে কমরেডরা বলে যেতেন, ‘‘মাসিমা, চাইরখান কইর্যা রুটি।’’ মা, জেঠিমারা ওই দারিদ্র্যের মধ্যেও অতি যত্নে নিজেদের হাতেগড়া কাগজের ঠোঙায় চারটি রুটি, একটু তরকারি আর এক টুকরো ভেলি গুড় দিয়ে পাঠাতেন অচেনা কোনও কমরেডের জন্য। সম্ভবত, সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত ২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে চিঠি লিখে বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। এই অত্যাচারিতদের সাধারণভাবে অর্থনৈতিক কারণে এদেশে আসা মানুষদের থেকে আলাদা করে বিবেচনার কথাও তিনি তাঁর চিঠিতে স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। কিন্তু আজ পার্টি তাদের পুরনো অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তাদের আন্দোলন, ভারত বন্ধ এইসবকিছুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুরা। উদ্বাস্তুদের নির্বোধ মনে করে থাকলে তাঁরা খুব ভুল করেছেন। চিরদিনের মতো ছিন্ন হয়ে গেল—‘‘মাসিমা, চাইরখান রুটির সম্পর্ক।’’
এই ব্যাপারে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ধরনের রাজনীতি করছেন সেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করতে পারছি না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে উঠে আসা তাঁর মতো অত্যন্ত সফল একজন জননেত্রীর পক্ষে এটা বেমানান। আর ইতিহাস এসব মনে রেখে দেয়। আন্দোলনের নামে গত একমাসে রাজ্যে যে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি ধংস করা হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের ভূমিকায় নিরপেক্ষতার অভাব স্পষ্ট। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা দেবী নিশ্চয় এটা চাননি, তবু ঘটে গিয়েছে। পুতুলনাচের বাজিকরদের সাফল্য এখানেই।
লেখক কলকাতায় সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত