উচ্চবিদ্যায় ভালো ফল হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে সুযোগ আসবে। কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
ওপার বাংলার বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস, কলকাতার চিকিৎসা-পরিষেবা ঢাকার চেয়ে ভালো, আর সেটা ঐতিহাসিক কারণে। কলকাতার এই পরিষেবার উপর তাঁদেরও হক রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। ইএম বাইপাস লাগোয়া কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে সারা বছরই রোগীর ভিড় থাকে। এই রোগীদের একটি বড় অংশই বাংলাদেশি। এখানকার পরিষেবায় তাঁরা এতটাই সন্তুষ্ট যে অনেকে প্রায়ই চিকিৎসা করাতে আসেন। সিএএ-এনআরসি নিয়ে কিছুদিন যাবৎ কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ এবং আরও একাধিক অঞ্চল উত্তাল। তারই মধ্যে একদিন আলাপ হয় মাঝবয়সি এক আইনজীবীর সঙ্গে। আব্দুল জলিল। বাংলাদেশের একটি জেলা কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, এই ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া কী? তিনি হেসে জবাব দিলেন, বাংলাদেশে মৌলবাদের বাড়াবাড়ি নিয়ে এতদিন আপনারা (ভারতীয়রা) হেসেছেন, আর এখন আমরা হাসছি আপনাদের (ভারতীয়দের) দেখে!
জলিল সাহেব বলেন, আপনাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও নিখাদ সত্যিটা এই—বাংলাদেশের আজকের যুবসমাজ মনে-প্রাণে অনেক আধুনিক। তাদের বেশিরভাগের কাছে মৌলবাদের কোনও স্থান নেই। বয়স্কদেরও চোখ খুলে দিচ্ছেন বয়োকনিষ্ঠরা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে ক্রমে দূরে সরে আসার প্রবণতাটি আজকের বাংলাদেশের বিরাট প্রাপ্তি। ধর্মের নামে জাতের নামে বজ্জাতি বেশি বেশি মানুষ মন থেকে পরিত্যাগ করছেন বলেই জামাত এবং বিএনপি শিবিরে ত্রাহি রব উঠেছে।
জলিল সাহেবের আন্তরিক আমন্ত্রণ, শুধু মুখের কথা নয়, আসুন—সামনে তো একুশের বইমেলা, তারপর বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। দেখে যান কেমন অসাম্প্রদায়িক আনন্দের পরিবেশ আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি। এমনকী, দুর্গাপুজোতেও কী আনন্দ হয় নতুন এই বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র, আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। দুর্গাপুজোর উৎসব যাতে পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে পারে তার অভূতপূর্ব বন্দোবস্ত আমাদের সরকার করে থাকে। শিক্ষা এবং চাকরি ক্ষেত্রেও হিন্দুসহ সমস্ত সংখ্যালঘু শ্রেণী আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বেশিরভাগ সরকারি উচ্চপদেও হিন্দুরা আর ব্র্যাত্য নয়।
জলিল সাহেবের সঙ্গে এই কথার মধ্যে যোগ দিলেন পাশে দাঁড়ানো এক বাংলাদেশি যুবক। অনির্বাণ ইসলাম। ঢাকায় সরকারি চাকুরে। অনির্বাণ বলেন, আজকের বাংলাদেশের স্বপ্ন—অচিরেই যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হওয়া। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সাকার করে তোলাই আমাদের স্বপ্ন। তাঁকে হত্যার পরই ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফের বঙ্গবন্ধুর সংবিধান ফিরিয়ে আনাই মুক্তমনা বাংলাদেশিদের লক্ষ্য।
জলিল সাহেব বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু এমন উন্নত চেতনার যুবসমাজকে পাশে না-পেলে তিনি এই অসাধ্যসাধন করতে পারতেন না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন যে পিছিয়ে ছিল তার মূল কারণ জনসংখ্যার অর্ধেককে অকেজো করে রাখা হয়েছিল। আজ মেয়েরাও সামনের সারিতে উঠে আসছেন। বাংলাদেশে সফল হয়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। শিক্ষার হার দ্রুত বাড়ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুব দুর্বল, আর ছিল তীব্র বিদ্যুৎসমস্যা। পূর্ববঙ্গ ব্রিটিশ ভারতে দুয়োরানির সন্তানের মতোই ব্যবহার পেয়েছে, শোষণ পাকিস্তান জমানায় আরও তীব্র হয়েছে। হাসিনার সরকার সেই অতল থেকে টেনে তুলেছে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে। আজকের বাংলাদেশ সামনে এগোনো ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবছে না। প্রত্যেকে নিজ নিজ সৎ জীবিকাকেই পাখির চোখ করেছে। তাই ভারতে কী হচ্ছে, তা নিয়ে নষ্ট করার মতো সময় আমাদের নেই।
জলিল সাহেব যে-আক্ষেপসহ উপসংহার টানলেন তার ভিতরে একটি চেতাবনি লক্ষ করলাম—আমরা (বাংলাদেশিরা) একটা ‘আনসেটেলড’ (অমীমাংসিত) ইস্যুকে ‘সেটেলড’ (মীমাংসিত) করার জন্য আপ্রাণ লড়াই করছি আর ভারত সেই ‘সেটেলড’ ইস্যুটাকেই ‘আনসেটেলড’ করতে প্রয়াসী হয়েছে! তিনি অবশ্য এটাও মানলেন যে ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত। বললেন, তাই আমরা ধরেই নিচ্ছি, এই সমস্যা ভারতের মানুষ দ্রুত সামলে নেবে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো অক্ষুণ্ণই থাকবে। এই দুই মুক্তমনা বাংলাদেশি নাগরিকের কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে দেখছি—বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ভিতরে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। সিডনির বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকনোমিকস অ্যান্ড পিস-এর ২০১৯-এর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০১৮-র তুলনায় বাংলাদেশ ওই বছর ৬ ধাপ এগিয়েছে। ২০১৭-র তুলনায় ২০১৮-তে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী হামলায় প্রাণহানি কমেছে ৭০ শতাংশ। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স অনুসারে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের প্রভাব এখন মাঝারি মাত্রার।
পরিস্থিতি আগে অনেক খারাপ ছিল। এই সাফল্য অবশ্য হাওয়ায় আসেনি। ২০১৩-১৫ সালের ভিতর মুক্তমনা নাগরিকদের উপর একের পর এক মৌলবাদী আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজনের প্রাণও গিয়েছে তাতে। ২০১৩-তে উগ্র মৌলবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তমনা নামী ব্যক্তিদের খতম করার হুমকিসহ একটি হিট লিস্ট প্রকাশ করে। তারপর একের পর এক ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, সাংবাদিক আরিফ মহিউদ্দিন, শাহবাগ আন্দোলনের শরিক সানিউর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সফিউল ইসলাম, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস, ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ও প্রতিভাবান ব্লগার অভিজিৎ রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ, নামী প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও আহমেদুর রশিদ চৌধুরী, লেখক রণদীপ বসু ও তারেক রহমান প্রমুখ। তার আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রক্তাক্ত হন প্রখ্যাত যুক্তিবাদী অধ্যাপক লেখক হুমায়ুন আজাদ। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, ‘নারী’ এবং ‘আমার অবিশ্বাস’ শিরোনামের বিতর্কিত ও সাড়া জাগানো বইগুলি তাঁরই কলম থেকে বেরিয়েছিল।
২০১৬ সালে ঢাকার গুলশান এলাকায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে (জনপ্রিয় রেস্তরাঁ) ঘটে যায় এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা। এরপরই হাসিনা সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে এগোয়। তাতে শুধু আইনশৃঙ্খলারই উন্নতি হয়নি, ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সে-দেশের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের এই সাফল্য ধরা পড়েছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকেও। ২০১৯-এর অক্টোবরের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয়েছে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স। তাতে দেখা যাচ্ছে ভারতের পজিশন সাত ধাপ নেমে গিয়েছে: ৯৫ থেকে ১০২ নম্বরে। অন্যদিকে, এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ (৮৮)। ছোট এই পড়শি দেশটি ২০১৮-তেও ভারতের চেয়ে এগিয়ে ছিল, যে-দেশ একসময় ভারতের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল খাদ্যসহ নানা প্রয়োজনে।
তবে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশ থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছে, এমন দাবি কেউ করেননি। রক্তবীজের ঝাড় যে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ২০১৮-র ৩ মার্চ। ওইদিন সিলেটে আততায়ীর হাতে আক্রান্ত হন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের নামী লেখক, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ মহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁকে আক্রমণের ঘটনায় ধৃত এক মাদ্রাসা-ছাত্র পুলিসের জেরায় দাবি করেছিল, সে প্রফেসর জাফর ইকবালকে ‘ইসলামের শত্রু’ মনে করে।
সিএএ, এনআরসি প্রভৃতি ভারতের মানুষ গ্রহণ করবেন কি করবেন না, তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও হয়নি। তবে, এটুকু বলা যেতে পারে—এই ইস্যুতে ব্যাহত হচ্ছে আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলি। অর্থনৈতিকভাবে আমরা দ্রুত পিছিয়ে পড়ছি। পাশাপাশি এই অধ্যায় বহির্ভারতে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না যার দ্বারা অন্তত বাংলাদেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উদ্বাহু নৃত্য করে পাকিস্তানের মৌলবাদী শক্তি। এই উপমহাদেশে শান্তি-সুস্থিতি প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্ত হল—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতা। যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ সহিষ্ণু ভারত ছাড়া আর কে তার প্রেরণা হতে পারে? ভারতের উচিত, এই চাহিদায় নিজেকে প্রশ্নাতীত প্রমাণ করা, সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দেওয়া নয়। কে বলতে পারে সেই পবিত্র আলো-হাওয়ায় পাকিস্তানও কোনও একদিন যুক্তিবাদের গুলবাগিচা হয়ে উঠবে না!