বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
সেটাই আপাতত হচ্ছে। একদিকে কর্মসংস্থানের অভাব। নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি তো হচ্ছেই না, উল্টোদিকে ছাঁটাই হচ্ছে পুরোদমে। মানুষের হাতে টাকা নেই। ফলে বাজারে পণ্যের চাহিদা কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ফলে সিঁদুরে মেঘ দেখে পণ্য প্রস্তুতকারক যাবতীয় সংস্থা তাদের উৎপাদন কমিয়েছে। আজকের বাজার অর্থনীতির পরিস্থিতি এটাই। এবং এই পরিস্থিতি চলছে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। সঙ্গে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি। গত ছ’বছরের মধ্যে যার সূচক সর্বাধিক। মানুষ গাড়ি, বাড়ি, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র না কিনে চালাতে পারে। কিন্তু খাবারই যদি না জোটে? এখন ১০০ টাকা পকেটে নিয়ে বাজার করতে বেরলে থলের এককোনাও ভরে না। জ্যোতি আলু খুচরো বাজারে হরেদরে ৩২ টাকা কেজি, পেঁয়াজ কমসম করেও ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। খাদ্যসামগ্রীর বাজার কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর জন্য সরকার কতটা দায়ী? আগে দেখা যাক, কীভাবে হয় এই ফুড ইনফ্লেশন। ধরা যাক আগের বছর উৎপাদন ভালো হওয়া সত্ত্বেও চাষিরা ফসলের উপযুক্ত দাম পাননি। লোকসান এতটাই হয়েছিল যে, এ বছর তাঁরা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন (যা হয়েছে এবার পেঁয়াজের ক্ষেত্রে)। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাজারে সেই পণ্যের জোগান কমে যাবে। তার উপর রয়েছে অকাল বর্ষণ।
ফলে মূল্যবৃদ্ধি যে হবেই, সে ব্যাপারে প্রশ্নের অবকাশ নেই। অন্য একটা সমীকরণও রয়েছে। তা হল, সরকার বাজার অর্থনীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটাও মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, প্রত্যেকটি রাজ্য সরকারের এক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব রয়েছে। কোনও ফসলের যদি উৎপাদনে ঘাটতি না থাকে, তাহলে তার দাম মাত্রা ছাড়ায় কী করে? এর কারণ একটাই। সেই ফসল বা খাদ্যদ্রব্য বাজারে সঠিকভাবে সময়ে সময়ে বণ্টন হয়নি। তার জন্যই বছরের শেষে এসে দামটাও নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। এটাও খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
মূল্যবৃদ্ধির এই সাঁড়াশি আক্রমণের ঠেলায় আজ তাই মধ্য ও নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে। এবার দেখা যাক, সরকার কী করতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে সবার আগে দরকার বাজারকে চাঙ্গা করা। সরাসরিভাবে বলতে গেলে পরিকাঠামো খাতে খরচ বাড়ানো। পাশাপাশি পণ্যপ্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে উৎপাদন বাড়ানোর মতো পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। সেটা কীভাবে? ভারত সরকার উল্লেখযোগ্য ভর্তুকি দেয় তেলের উপর। অপরিশোধিত তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যত বাড়ে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারে বৃদ্ধি পায় পেট্রল-ডিজেলের দাম। এর সঙ্গে জুড়েছে আন্তর্জাতিক সমস্যা। অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ড্রোন হামলায় ইরানের সেনাকর্তার মৃত্যুতে রীতিমতো চাপানউতোর শুরু হয়েছে। এই ঝামেলায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে অপরিশোধিত তেলের দাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই যার প্রভাব পড়বে এদেশের পেট্রল-ডিজেলের মার্কেটে। কারণ, ভারতে যে পরিমাণ তেলের প্রয়োজন, তার ৮৪ শতাংশই আসে আমদানি থেকে। ইতিমধ্যে গত তিন মাসে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৫৮ থেকে ৬৯ ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। এই আন্তর্জাতিক টালমাটাল পরিস্থিতি বজায় থাকলে যা আরও বাড়বে।
সরকার এখন কী করতে পারে? তেল কোম্পানিগুলিকে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা সরকার দিল না। সংস্থাগুলিকেই বলল, আন্তর্জাতিক বাজারের উপর ভিত্তি করে আপনারা দাম কমান বা বাড়ান। কিন্তু তাতে কেন্দ্রীয় নজরদারি থাকবে। অর্থাৎ, কোনও সংস্থা বাজারের সঙ্গে সামঞ্চস্য না রেখে দাম বাড়ালে সরকার তাকে চেপে ধরতে পারবে। এবার যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি কেন্দ্র তেল কোম্পানিগুলিকে দিচ্ছে, সেটাই খরচ হবে পরিকাঠামোগত উন্নয়নে। বা কোনও শিল্পক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে। তেলের দাম যদি কমে, তার সরাসরি প্রভাব হিসেবেই মূল্যবৃদ্ধি কমবে। তখন ব্যাঙ্কগুলি পারবে সুদের হার কমাতে। অর্থাৎ কম সুদের হারে ঋণ দিতে। তাতে বিনিয়োগ বাড়বে, উৎপাদন ক্ষেত্র চাঙ্গা হবে এবং তার সঙ্গে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এটা একটা উপায় হতে পারে মন্দা থেকে বেরনোর। যতদিন না এমন কিছু সম্ভব হচ্ছে, ততদিন সরকারকে দেখতে হবে যাতে পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের সহ্যের সীমার বাইরে না চলে যায়। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো অত্যন্ত সাধু উদ্যোগ। কিন্তু এর ফল এখনই পাওয়া যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে বছর শেষের জন্য। ট্যাক্স একধাক্কায় কমিয়ে দেওয়ায় সংস্থাগুলি যে বেশি লাভ করবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু তাতেও যে উৎপাদন বাড়বে বা নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কর্পোরেট ট্যাক্সে কিন্তু দেশ চলে। ব্যক্তিগত ট্যাক্সে নয়। কাজেই ৫ শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স কমে যাওয়া মানে দেশের রাজস্বে বড় ঘাটতি। বরং বাজারে কোনও শিল্পের ওঠানামার উপর নির্ভর করে সেই সংক্রান্ত জিএসটি বা অন্যান্য শুল্কের হারে বদল আনলে সুরাহা পাওয়া যেতে পারে। আর সাধারণ মানুষের আয়করে যদি মোদি সরকার ছাড় দেয়, তা মানুষের কাছে বিশল্যকরণীর মতো হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি কি তা করবেন? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ, লোকসভা ভোটে সদ্য জয়ের পর আরও শক্ত জমিতে পা রেখেছেন তিনি। আগামী পাঁচ বছর নিশ্চিন্ত। এরপর যদি কোনও বিষয় মোদিকে টলাতে পারে, তা হল একের পর এক বিধানসভা ভোটে বিজেপির ধাক্কা খাওয়া। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লির ভোট। তারপর বছরখানেক সময় পাওয়া যাবে।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার। তার আগে অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি আর একটা কিছু মাস্টার স্ট্রোক দেবেন। কারণ, শুধু পাকিস্তান দিয়ে যে বিধানসভা ভোটগুলিতে শিকে ছিঁড়বে না, তা বিজেপি বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছে। বাকি রইল ধর্মীয় মেরুকরণ। এই ইস্যু অবশ্যই এখনও জ্বলজ্যান্ত। এবং দেশের নানা প্রান্তে সাফল্যের সঙ্গে গেরুয়া শিবির এই ইস্যু প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। ভারতে এই প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পাবেন। অথচ এই নরেন্দ্র মোদিই নাকি কথায় কথায় মহাত্মা গান্ধীকে স্মরণ করেন! সেই মহাত্মা গান্ধী, যিনি ৬ থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সব শিখেছিলেন। ধর্ম ছাড়া। এপাশ ওপাশে যা দেখতেন, শুনতেন সেখান থেকেই কিছু না কিছু কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। এসব করতে গিয়ে ‘ধর্ম’ বিষয়টির এক অন্য মানে করেছিলেন তিনি। তাঁর কাছে ধর্ম বলতে ছিল আত্ম উপলব্ধি বা আত্মিক জ্ঞান। অবশ্যই প্রধানতম কারণ হল, গান্ধীজি এখনও পাবলিকের কাছে গ্রহণযোগ্য। অন্তত ছবি টাঙিয়ে দেওয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তো বটেই!
তাই ধর্ম নিয়ে গান্ধীজির মতামত যাই থাকুক না কেন, স্বচ্ছতা অভিযানে অন্তত তাঁকে আদর্শ খাড়া করে দেশ ও দশের প্রিয় হওয়ার মাস্টারস্ট্রোক মোদি তাঁর প্রথম ইনিংসেই দিয়েছিলেন। আসলে এই কাজটা তিনি ভীষণ ভালোভাবে পারেন... একটা বিষয়ের থেকে অন্যটিকে আলাদা করে রাখতে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং মহাত্মা গান্ধী, দু’জনকেই গুরুত্ব দেবেন। অথচ দু’জনের আদর্শগত বিরোধ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার প্রসঙ্গ তুলবেন। কিন্তু তাঁর সর্বধর্ম, আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের আকাঙ্ক্ষাকে সযত্নে এড়িয়ে যাবেন। আচ্ছে দিনের কথা বলবেন। কিন্তু মানুষের সমস্যা, নিত্যযন্ত্রণা যে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখবেন।
কিন্তু আর কতদিন? মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় যদি এখনও না আসে, তাহলে কবে আসবে সেই ‘আচ্ছে দিন’। যখন নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর বিজেপি সরকার দেশের অর্থনীতি নিয়ে সত্যিকারের কিছু করার কথা ভাববেন... দেশবাসীর পাশে থেকে নিত্যযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা অন্তত করবেন।