কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
এসব কথার পরিপ্রেক্ষিত যে অবশ্যই মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনা, তা নিশ্চয় বুদ্ধিমান পাঠককে বুঝিয়ে বলতে হবে না। মধ্যরাতে সেখানে চমক। একমাস ধরে চলা টানটান সিরিয়ালের ক্লাইম্যাক্স এবং কুর্সিদখল আমরা দেখলাম। এই ঘটনা মহারাষ্ট্র সহ দেশের মানুষকে আরও একবার বুঝিয়ে দিল রাজনীতিকদের কাছে ক্ষমতা দখলই আসল মধু। নীতির কথা বলে যখন দলনেতারা ভোটভিক্ষা করেন, সেটা তাঁদের মুখোশ আর মাঝরাতের কুনাট্যটাই আসল সত্যি। ভোর হওয়ার আগেই সাঙ্গ কর খেলা। দখল কর কুর্সি। রাতের অন্ধকারেই হোক ক্ষমতা দখলের গেরিলাযুদ্ধ। হাঃ হাঃ হাঃ। যাত্রাপালা হলে শহপগ্রহণের পর এমনই হতে পারত দেবেন্দ্র ফড়নবিশের সংলাপ।
একমাসের টানটান সিরিয়াল বৈকি! অথচ একমাস আগে যখন হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রের ফল প্রকাশিত হল, দেখা গেল বিজেপি এককভাবে কোথাও ক্ষমতাদখলের মতো জায়গায় নেই। অনেকেই মনে করেছিলেন, মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনার সরকার হবে। কেননা সেখানে ঘোষিত জোট। সঙ্কটের কোনও প্রশ্নই নেই। বরং মাথাব্যথার কারণ হতে পারে হরিয়ানা। কিন্তু সেখানে সঙ্কট তৈরি হল না। অমিত শাহের সুপার ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে গেলেন জননায়ক জনতা পার্টির নেতা দুষ্যন্ত চৌতালা। দশটি আসনে জয়ী হয়ে তিনি বিজেপিকে সরকার গড়তে সাহায্য করলেন এবং নিজে উপ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন। উল্টোদিকে মহারাষ্ট্রে খুব সহজেই সরকার গড়া হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু ফল ঘোষণার পর রাত পোহাতেই বেঁকে বসল শিবসেনা। তারা দাবি করল। আমরা আধাআধি ভাগ চাই। আড়াই বছর মুখ্যমন্ত্রী হবেন বিজেপির কেউ। আর বাকি আড়াই বছর মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি থাকবে শিবসেনার হাতে। নরমসরম রাজনীতিক উদ্ধব হঠাৎই ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য নাছোড় হয়ে উঠলেন। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব থ্যাকারেকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন তিনি এতটা আগ্রাসী নন। হঠাৎ কী এমন হল যে তিনি এমন মরিয়া হয়ে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি দখলের জন্য। শিবসেনার অন্দরের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের ঝুলিতে আছে অনেক গোপন কথা। সেসব ছড়াচ্ছে মহারাষ্ট্রের অলিতে গলিতে। ফলপ্রকাশের পরই হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠেন উদ্ধব থ্যাকারের স্ত্রী রশ্মি থ্যাকারে। তিনিও দীর্ঘদিন রাজনীতিকে অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। একটা সময় শিবসেনায় সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। বালাসাহেব-পরবর্তী সময়ে দলের নিয়ন্ত্রণ কার দিকে যাবে? ছেলে উদ্ধব, নাকি ভাইপো রাজ? রাজ অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন। দলের কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। আর উদ্ধবের রাজনীতিতে তেমন মন নেই জাঙ্গল ফোটোগ্রাফি করে বেড়ান। বিভিন্ন দুর্গে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলেন। সেটাই তাঁর ভালোলাগার জগৎ। কিন্তু রশ্মি সেদিন প্রভাব খাটিয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলেন উদ্ধবের দিকে। শিবসেনা ভাঙল। রাজ থ্যাকারে নতুন দল গড়লেন। রশ্মি একজন রাজনীতিক হিসেবে গড়ে তুলতে লাগলেন উদ্ধবকে। বালাসাহেবের অনুগতদের বেরতে দিলেন না রাজের দিকে। নিজে আড়ালেই থেকে গেলেন। কিন্তু শিবসেনার সকলেই জানেন আড়ালে থাকলেও তিনি দলের একজন বড় নীতিনির্ধারক। রাজনীতির অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গিয়েছে তাঁর অনায়াস পদক্ষেপ। দলের সবাই তাঁকে ডাকেন ‘বহিনি-সাহিব’ বলে। কিন্তু আসলে তিনি দ্বিতীয় ‘মা-সাহিব’। প্রথম মা ছিলেন বাল থ্যাকারের স্ত্রী মীনা থ্যাকারে। আর এখন তিনিই দ্বিতীয় মা। বহুক্ষেত্রেই দল তাঁর নীতি অনুসরণ করে চলে। ফলপ্রকাশের পর থেকেই দলের সমস্ত রাশ তাঁর হাতেই। তিনিই ঠিক করছেন কী হবে, কার সঙ্গে দল কথা বলতে হবে ইত্যাদি। তিনিই প্রথম আড়াই বছর করে ক্ষমতা দখলের কথা বলেন। বিজেপি তা অস্বীকার করলে রশ্মিই ঠিক করেন, পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসবেন তাঁর স্বামী উদ্ধব থ্যাকারে। এর জন্য যে সংখ্যার দরকার, তা নেওয়া হবে কংগ্রেস ও এনসিপির কাছ থেকে। দলের সকলকে বলে দেওয়া হল, প্রেসের কাছে কেউ মুখ খুলবেন না। যা বলার একা সঞ্জয় রাউতই বলবেন। সঞ্জয় দলের খুবই বিশ্বস্ত, অনুগত। ঘটনার দু’দিন আগে মাত্র তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্ল্যস্টি হয়েছিল। সেই অবস্থায় দলের নির্দেশে নেমে পড়লেন তিনি। কেন্দ্রে বিজেপি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন শিবসেনার অরবিন্দ সাওয়ান্ত। রশ্মির কাছে এটা ছিল ‘নাউ অর নেভার’। তিনি বুঝেছিলেন মহারাষ্ট্রে বিজেপিকে ধাক্কা দিয়ে ক্ষমতা দখল করে শিবসেনার এক নম্বর হয়ে ওঠার এটাই মোক্ষম সময়।
শুরু হয়ে গেল সরকার গড়ার নানা নাটক। দু’পক্ষই তৎপর হল। কিছু খেলা চলল প্রকাশ্যে, আবার কিছু খেলা চলল গোপনে। সাধারণ মানুষ তার কিছুটা জানতে পারল আর কিছুটা জানতে পারল না। কিন্তু যেভাবে কুর্সি দখল নিয়ে গেম চলতে লাগল, তাতে ভোটাররা কার্যতই অসন্তুষ্ট। বিভিন্ন দলের মধ্যে আলোচনা যেটুকু চলতে লাগল, সবটাই দলীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। মানুষ যে সমীকরণ দেখে ভোট দিয়েছিলেন। ভোটের পর সেই সমীকরণ বজায় রাখার ইচ্ছে বা মানসিকতা কারও দেখা গেল না। পক্ষের ভোট এবং বিরোধী ভোট জট পাকিয়ে ফায়দা তুলে ক্ষমতা দখলের সেই পুরনো খেলা চলতেই লাগল। যাঁরা পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা অপমানিত হলেন। যাঁরা বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরাও অপমানিত হলেন। অথচ কী আশ্চর্যের কথা, এসব মান-অপমান, অভিমানের হিসেব কষার সময় রাজনীতিকদের নেই।
আমরা দেখছি ঘটা করে শিবসেনা, কংগ্রেস, এনসিপি আলোচনার পর আলোচনা করেই চলেছে। যাঁরা মাছ ধরেন তাঁরা বলেন, বড়সড় মাছকে বেশি ছিপে খেলাতে যেও না। কখন যে ছিপ ছিঁড়ে পালিয়ে যাবে, কেউ জানতেও পারবে না। মহারাষ্ট্রেও সেটাই হল। শারদ পাওয়ারকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা অনেক আগেই শিবসেনাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির দিকে হাতের তির ছুঁড়ে দেওয়ার পর শিবসেনার আর কিছুই করার ছিল না। সে নিজেই ক্রীড়নক হয়ে গিয়েছিল। অনেকেরই মনে আছে দিন কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শারদ পাওয়ারের বৈঠকের কথা। মুখোমুখি শুধু দু’জন। পাওয়ারের দলের মাস্টার স্ট্রোক মারার কথাটা রটেছিল সেদিন থেকেই। কেননা সেদিন সেই মিটিং থেকে বেরিয়ে পাওয়ার বলেছিলেন, ‘আমাদের আলোচনা হয়েছে কৃষি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে।’ আশ্চর্য, এমন একটা মিটিং হল, অথচ সেখানে পাওয়ারের দলের কেউ নেই। মোদির সঙ্গেও কেউ ছিলেন না। এমনকী কৃষি নিয়ে আলোচনায় ডাকা হয়নি দেশের কৃষিমন্ত্রীকেও। অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল। কেননা পাওয়ার রাজনীতিতে এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি কখন যে কী বল করবেন, কেউই জানেন না। তার আগে সংসদের অধিবেশনের শুরুতে মোদি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন দুটি দলের। নবীনের বিজেডির এবং শারদের এনসিপি’র। এমনও হতে পারে যে তখন গোপনে বিজেপি শিবিরের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং অন্যদিকে মিটিংয়ের পর মিটিং চলছে শিবসেনার সঙ্গে। এসব কি তবে সময় নষ্টের খেলা ছিল?
এর মধ্যে উঠে আসছে অনেক অজানা তথ্য। রামদাস আটওয়ালে ইতিমধ্যেই শারদ পাওয়ারের দিকে একটা টোপ ছুঁড়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এনডিএতে আসুন। অনেক উপহার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’ অনেকে কানাঘুষো করে বলছেন, আগামীদিনে পাওয়ার-কন্যা সুপ্রিয়া সুলে যদি কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়ে যান, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভিতরে ভিতরে নাকি খেলা সেদিকেই এগচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এই খেলায় অজিত পাওয়ার নাকি বোড়ে। আসল খেলা পাওয়ারেরই হতে পারে। বহুযুদ্ধের, বহু ওলোটপালোটের ঘোড়া হলেন পাওয়ার। অজিত রাতারাতি ডিগবাজি খেলেন আর পাওয়ার তার কিছু জানতে পারলেন না, এটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মহারাষ্ট্রে কোন গাছের পাতা কখন পড়ল, তার খবরও চলে আসে পাওয়ারের কাছে। আর এমন অতর্কিত চালে পাশা উলটে দেওয়ার ইতিহাস পাওয়ারের আছেই। সেটা ১৯৭৮ সাল। তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বসন্তদাদা পাতিল। উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নাসিকরাও তিরপুরে। আর এই সরকারের মন্ত্রিসভায় শ্রমমন্ত্রী ছিলেন শারদ পাওয়ার। কাকপক্ষী টেরও পেল না, একদিন হঠাৎ করে দান পালটে সরকার ফেলে পাওয়ার হয়ে গেলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অনেকেই বলছেন, এখন সেই খেলাই পাওয়ার ভাইপোকে দিয়ে খেললেন নাতো!
এই পুরো সিরিয়ালের নায়ক কে তা অবশ্য জানা গেল না! তবে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে হেরে গেলেও আশা ছাড়ছেন না রশ্মি থ্যাকারে। তিনি অপেক্ষায় থাকছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, পাঁচ বছর অনেকটাই সময়। এর মধ্যে ফের পাশার দান উল্টে যেতে পারে। উদ্ধবকে মহারাষ্ট্রের কুর্সিতে বসানোর পণ করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত যাব’।
অনেকেই বলেন, অমিত শাহের বিরুদ্ধে খেলতে যেও না। কূটনীতি এবং পাওয়ার পলিটিক্সে তাঁকে হারানো খুব শক্ত। মহারাষ্ট্র জয় করে তিনি সেটা আবার সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। তবে মহারাষ্ট্রে বিজেপিকে এবার অনেক বেশি সতর্ক হয়ে খেলতে হবে। কেননা খেলাটা এখন সেয়ানে সেয়ানে। বিজেপির একটা ভুল পদক্ষেপ ফের বাজি উল্টে দিতে পারে। অজিত পাওয়ারের জেলে ঢোকানোর হুঙ্কার বাস্তবে ঘটবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। আর পাওয়ার সবকিছুর আড়ালে থেকে হয়তো বলবেন, খেলো খেলো আই অ্যাম ওয়াচিং।