ব্যবসা সূত্রে উপার্জন বৃদ্ধি। বিদ্যায় মানসিক চঞ্চলতা বাধার কারণ হতে পারে। গুরুজনদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন ... বিশদ
কিন্তু এত করেও কি শান্ত স্বাভাবিক কাশ্মীরের সর্বাঙ্গ সুন্দর ছবিটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা গেল? প্রমাণ কি দেওয়া গেল যে দেখে যাও, ৩৭০ ধারা হটিয়ে সন্ত্রাসকে পুরোপুরি জব্দ করা গিয়েছে? পরখ করো, সন্ত্রাসহীন কাশ্মীরকে। উল্টে সামনে এল নতুন সমস্যা। কাশ্মীরি-অকাশ্মীরি বিরোধ। বিদ্বেষ। ভিনরাজ্য থেকে কাজের টানে যেসব শ্রমিক কর্মচারী কাশ্মীরে আছেন তাদের উপর একটা আক্রোশ। আর সেই বিদ্বেষের মূল কারণ, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর একটা ধারণার সৃষ্টি হয় যে ভিনরাজ্যের লোকজন এবার কাশ্মীরের স্থাবর সম্পত্তি কিনে তার মালিক হতে পারবেন। এতদিন তা হতো না। কিন্তু নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার পর উপত্যকার জমি কেনায় আর কোনও বাধা রইল না। এতে সাধারণ কাশ্মীরিরা গোটা উপত্যকার জনসংখ্যা ও জনভিত্তির পরিবর্তনের আশঙ্কায় ভীত হয়ে উঠছে। তারই জেরে বিগত ১৪ অক্টোবর থেকে একের পর এক কাশ্মীরের বুকে ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের উপর বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। ষষ্ঠ ঘটনাটি ঘটল গত মঙ্গলবার। শেষটায় বাঙালিদের উপর। এই নিয়ে গত আড়াই সপ্তাহে মোট ১১ জন অসহায় শ্রমিক ও ট্রাক ড্রাইভার প্রাণ হারালেন। গত ১৪ অক্টোবর প্রথম ঘটনাটি ঘটে এক নিরীহ ট্রাক ড্রাইভারের হত্যা দিয়ে। তাঁর নাম ছিল মহম্মদ শরিফ। শরিফ রাজস্থানের লোক, কাজের আশায় কাশ্মীরে ডেরা বেঁধেছিলেন। এরপর ১৬ অক্টোবর পাঞ্জাবের চিরঞ্জিত সিং ও চণ্ডীগড়ের শেঠি কুমার সাগর জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান। ২৩ অক্টোবর হত্যা করা হয় মহম্মদ ইলিয়াস ও জাহিদকে। দু’জনেই রাজস্থান থেকে কাশ্মীরে কাজ করতে গিয়েছিলেন। এরপর গত সোম ও মঙ্গলবার ফের ভিনরাজ্যের শ্রমিকরা প্রাণঘাতী হামলার শিকার হলেন। এই ঘটনা ঘটল ইউরোপীয় প্রতিনিধিদলের সফরের মধ্যেই। সব মিলিয়ে এপর্যন্ত ভিনরাজ্যের শ্রমিক হত্যার ঘটনা সংক্রামিত হতে শুরু করেছে। আর ভয়টা সেখানেই। এর থেকেই স্পষ্ট, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির পর কাশ্মীরে জঙ্গিরা নতুন পথ বেছে নিয়েছে। জন্ম নিয়েছে নতুন ধরনের ঘৃণা ও আক্রোশের। যার সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত অপহরণ করে নৃশংসভাবে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ অসহায় শ্রমিকের নির্মম হত্যা। এই ঘটনা আরও একবার জানান দিল ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃত সমাধান হতে পারে না। উল্টে তা আরও বড় সমস্যার জন্ম দিতে বাধ্য। আর তা ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। কাজে যাওয়া অসহায় পরিবারগুলোর কী দোষ? পেটের দায়ে এদেশের যেকোনও স্থানে একজন নাগরিক যেতে পারেন। কাজ করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গেও ভিনরাজ্যের বহু শ্রমিক কাজ করছেন। সংবিধানই দেশের প্রত্যেক নাগরিককে এই অধিকার দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের এই নয়া সাংবিধানিক পরিবর্তন সেখানকার অসহায় শ্রমিকদের সেই অধিকারই কি কেড়ে নিতে চলেছে?
এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভিনরাজ্যের প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক কাশ্মীরে এই মুহূর্তে কর্মরত। মূলত পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও রাজস্থানের শ্রমিকরা কাশ্মীরে কর্মরত। অথচ পরিবারগুলো ভয়ঙ্কর এক বিপন্নতা ও আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কখন কার উপর আক্রমণ নেমে আসে কেউ জানে না। ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বার বার বলছেন, এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের অর্থই না কি কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ এক কথায় খতম করা। এবার ভূস্বর্গে শুধুই উন্নয়ন শুরু হবে। আপাতত মোদি সরকারের সেটাই লক্ষ্য। সেই মতো গত ১ নভেম্বর সরকারিভাবে পূর্ণরাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর ভেঙে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্মও হয়ে গিয়েছে। দুজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর শপথ নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু কাশ্মীর কি স্বাভাবিক হয়েছে। সেখানকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কি ভালো আছে? অজানা আশঙ্কা ও আতঙ্ক মানুষের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে। আর নিরাপত্তাহীন বিপন্ন জীবন তাকে বিপথে যেতে বাধ্য করে। কাশ্মীরে নতুন করে সেই অধ্যায়ই শুরু হচ্ছে না তো?
মোদি ও অমিত শাহের বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতেই গত ৫ আগস্ট সংসদে ঐতিহাসিক কাশ্মীর পুনর্গঠন বিলটি পাশ হয়। আর মাত্র গত শুক্রবারই পূর্ণ রাজ্যের তকমা হারিয়ে গোটা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন পথচলা। কিন্তু এখনও দেশের সাধারণ মানুষ বিনা বাধায় কাশ্মীরে যাওয়ার ছাড়পত্র পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। নেতানেত্রীদের সুপ্রিম কোর্টের ছাড়পত্র জোগাড় করতে হচ্ছে। পরিস্থিতিটা এতই খারাপ যে আগস্টের পর থেকে বহু এলাকায় দোকানপাট, স্কুল কলেজ, অফিস কাছারি আজও স্বাভাবিক হয়নি। স্কুল খুললেও অজানা আশঙ্কায় কেউ ছেলে মেয়েদের পাঠাচ্ছেন না। দোকানপাট সকালে খুব অল্প সময়ের জন্য খুলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক দোকানে আবার স্থানীয় লোকজন ছাড়া অন্যদের জিনিসপত্রই বিক্রি করা হচ্ছে না। আর এই অন্যায় ও আশঙ্কার কারণেই উৎসব মরশুমেও ভূস্বর্গ কার্যত পর্যটকশূন্য হয়েই থেকে গিয়েছে। একেই বোধহয় বলে অঘোষিত জনতা কার্ফু। যেখানে সাধারণ মানুষ নিজে থেকেই নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখে প্রতিবাদ জানায়। সরকারি নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখানো তথা পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করার এ এক অভিনব উপায়, সন্দেহ নেই। গত তিন মাসে শ্রীনগর বিমানবন্দরে নেমেই ফিরতে হয়েছে অনেককে। পরে অবশ্য দু’একজন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ নিয়ে উপত্যকায় ঢুকেছেন। কিন্তু রাজ্যের প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা, পুত্র ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতি এখনও কার্যত অন্তরালেই। বহু ছোট ব্যবসায়ী কাজ হারিয়ে রোজগার হারিয়ে অসহায় দিনযাপন করছেন। সেই আগস্ট মাস থেকে পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে কৃষি ও হস্তশিল্পও। এই সব কাজে নিযুক্ত কৃষক, শ্রমিক, হস্তশিল্পী, রাজমিস্ত্রিরা দলে দলে এসেছে ভিনরাজ্য থেকে। এতদিন তাদের সঙ্গে কাশ্মীরের মানুষের শত্রুতা তৈরি হয়নি। কিন্তু এবার বাইরের রাজ্যের লোকেরা জমি বাড়ি সম্পত্তি কেনার আইনি অধিকার পেতে চলেছেন বলে যেই রটছে, তখনই বিদ্বেষের সৃষ্টি হচ্ছে। এই কাশ্মীরি আর অকাশ্মীরি বিভেদ ও দূরত্ব আগামী দিনে আরও বাড়তে বাধ্য। কিন্তু এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সুদূর ব্রাসেলসের একটি এনজিও ও তার প্রধান অখ্যাত ম্যাডি শর্মার আমন্ত্রণে কাশ্মীর দেখতে আসছেন একদল ইউরোপীয় প্রতিনিধি, এটাই অবাক করা ঘটনা। ব্যাপারটা মোটেই সহজবোধ্য নয়। আবার বলা হচ্ছে এটা না কি তাঁদের ব্যক্তিগত সফর! বিরোধীরা স্বভাবতই জোরালো ভাষায় প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। যদি সরকার এর সঙ্গে যুক্ত নাই থাকে তবে কার অঙ্গুলিহেলনে ‘ওয়েস্ট’ নামে ওই সংস্থার পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হল, তা চরম রহস্যাবৃত। দেশের লোকের যাওয়ার অনুমতি নেই অথচ বেমালুম কিছু বিদেশি শুধু শ্রীনগর ঘুরে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, এ বড়ই বেমানান। তার উপর একজন বিদেশি মহিলা সেই সফরের মূল আয়োজক এটাই নানা সন্দেহেরও জন্ম দিতে বাধ্য। যার পরিষ্কার উত্তর সরকারি তরফেও এখনও দেওয়া হয়নি। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে যতই ঢাক ঢোল পেটানো হোক, উপত্যকায় এখনই জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ হওয়া দূরঅস্ত! আগামী দিনে ভূস্বর্গে সন্ত্রাস নতুন চেহারায় সামনে আসবে এবং ক্রমাগত সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করবে, এই আশঙ্কাই বদ্ধমূল হচ্ছে।