ব্যবসা সূত্রে উপার্জন বৃদ্ধি। বিদ্যায় মানসিক চঞ্চলতা বাধার কারণ হতে পারে। গুরুজনদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন ... বিশদ
কিন্তু সবকিছু যদি জাতীয়তাবাদের মোড়কে সরকার চালিয়ে দিতে চায়, সেটা তখন অনেকসময় হয়ে ওঠে বড় প্রতিবন্ধকতা। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পক্ষে বহু মানুষের সমর্থন রয়েছে। কাশ্মীরের বাইরে যে বিরাট ভারতবর্ষ রয়েছে, সেখানে বৃহত্তর অংশই মনে করে এই মুহূর্তে আর কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার প্রয়োজন নেই। আমরা মুখে বলব কাশ্মীর ভারতেরই অবিভক্ত অংশ, আবার বাড়তি সুবিধা দিয়ে মানসিকভাবে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে রাখব, এটা দিনের পর দিন চলতে পারে না। তাই কেন্দ্র গত ৫ আগস্ট যখন কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করল তখন দেশের মানুষ তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতার সীমারেখাটাকে মুছে ফেলা গেল। এবার ভূস্বর্গ হয়ে উঠবে আরও সুন্দর। তুষারের উপর থেকে মুছে যাবে রক্তের আলপনা। জঙ্গিদের ডেরা চূর্ণ হয়ে যাবে। সাধারণ, নিরীহ কাশ্মীরিরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। কিন্তু যতদিন দিন যেতে লাগল, ততই দেখা গেল স্বপ্ন দেখাটা ভুল ছিল। মুক্ত তো হলই না। উপরন্তু কাশ্মীর লৌহনিগড়ে হয়ে গেল অবরুদ্ধ। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, যথেষ্ট খাবার নেই, গ্যাস নেই, যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। এমনকী মানুষের বাইরে বেরনোর অধিকারটুকুও ছিল না। সড়কে, পথে, গলিতে শুধু সেনাদের বুটের শব্দ। রাজ্য থেকে বেরনো বন্ধ এবং ঢোকাও বন্ধ। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে আওয়াজ উঠল।
অর্থাৎ দেখা গেল উদ্দেশ্য সফল হলেও সরকারের পথ ভুল। কাশ্মীরের মধ্যে কী হচ্ছে কেউ জানে না। সরকার নিজে যা খবর দিচ্ছে, তাই প্রকাশ্যে আসছে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে কাশ্মীর খুব সুন্দর আছে। কিন্তু বাস্তবে হয়তো খুব সুন্দর নেই। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ ভালো নেই।
আমাদের মনে আছে শাহরুখ খানের সেই ছবিটা। ‘মাই নেম ইজ খান’। সেখানে শাহরুখের একটা অসাধারণ সংলাপ ছিল। ‘আমার পদবি খান। কিন্তু আমি জঙ্গি নই।’ সুতরাং মনে রাখা দরকার কাশ্মীরে জঙ্গিরা ঘাঁটি গেড়ে ভারতে অশান্তি পাকানোর চেষ্টা করছে, এটা যেমন সত্যি, তেমনই কাশ্মীরের ভিতরেও একটা ভারত-বিরোধী চক্র সক্রিয় এটাও সত্যি। কিন্তু সব কাশ্মীরিই জঙ্গি বা জঙ্গিদের মদতদাতা নন।
প্রতি বছর আমাদের বাড়িতে আসেন ফারুকভাই। পুজোর আগেই এই শহরে তিনি চলে আসেন। আর এই শহর ছেড়ে চলে যান মার্চ-এপ্রিলে। ফারুক বলেন, ‘আমি ছ’মাস কলকাতার আর ছ’মাস কাশ্মীরের।’ গত চল্লিশ বছর ধরে আসছেন ফারুক। সেই ছোট থেকে। তখন আসতেন বাবার হাত ধরে। তাঁর বাবা অসুস্থ হওয়ায় গত বছর এই শহরেই ফারুকের বাবার অপারেশন হয়। ফারুক বলেন, ‘এই কলকাতাও আমার নিজের শহর। ভারতের আর কোথায় আমি এত নিশ্চিন্তে থাকতে পারি না। এই শহর অতিথিকে সম্মান জানাতে জানে।’ শাল, সোয়েটার ইত্যাদি শীতপোশাকে ভরা থাকে তাঁর গাঁটরি। একটা একটা করে চাদর, সোয়েটার খুলে দেখান। ছড়িয়ে পড়ে সুন্দর একটা গন্ধ। সেই সব পশমিনার মধ্যে যেন তুষারশুভ্র উপত্যকার গন্ধ মাখা থাকে। মনে হয়, যেদেশে এগুলো তৈরি হয়, সেদেশ কখনও নিরানন্দে থাকতে পারে না। অসাধারণ নম্র ব্যবহার ফারুকের। বারবার আমাদের বলেন, ‘একবার আসুন। আমার অতিথি হলে খুব আনন্দ পাব। আপনাদের সব ঘুরিয়ে দেখাব।’ একথা ফারুক সকলকেই বলেন। দেওয়ালির আগে ঝোলা থেকে প্যাকেটভর্তি উপহার বের করে দেন। সোনালি আখরোটের মতোই ফারুকের মন। হৃদয় উজাড় করে কথা বলেন ফারুক। তাঁর কথায় কাশ্মীরের ছবিটা ফুটে ওঠে। ফারুক বলেন, ‘ওখানে অনেক খারাপ লোক আছে। আবার ভালো লোকও আছেন। তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশি। আজ ওখানে সবাইকে জঙ্গি হিসাবে দেখা হয়। ভারতের একজন সৎ নাগরিকের কাছে এটা যে কত বড় অপমান তা বলে বোঝানো যাবে না।’
কাশ্মীর উপত্যকায় লক্ষ লক্ষ ফারুক আছেন, যাঁরা অপমানিত এবং পরিস্থিতির শিকার। অথচ কাশ্মীরের যে চকচকে ছবিটা তুলে ধরা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। সেই সত্যিটাকে প্রকাশের জন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাছা বাছা প্রতিনিধিদের কাশ্মীরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কোমর বেঁধে সরকার নেমেওছিল। কিন্তু শেষটা সম্পূর্ণ সুন্দর হল না। চিত্রনাট্যের শেষ অংশে লেগে গেল রক্তের দাগ। বড় দগদগে সেই রক্ত। সেই রক্ত উন্মোচিত করে দিল অনেক সুপ্ত সত্যকে। কাশ্মীর কেমন আছে, মানুষ জানতে চায়। উপত্যকা থেকে সমস্ত জঙ্গিকে নিকেশ করা হোক। মানুষ এটাও চায়। কিন্তু কাশ্মীরের ভারতপ্রেমী সৎ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হোক এটা এদেশের মানুষ চান না। যে ছবিটা বাঁধিয়ে রেখে প্রচারের চেষ্টা হচ্ছিল, সেটা আর থাকল না। উপত্যকায় পাঁচ বাঙালি শ্রমিকের হত্যাকাণ্ড বুঝিয়ে দিল কাশ্মীর আছে কাশ্মীরেই। এস ওয়াজেদ আলির কথা ধার করে বলা যায়, কাশ্মীরে সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। কোথাও তার এতটুকু বদল হয়নি।
একটা প্রবাদ আছে, চূড়ান্ত ক্ষমতা চূড়ান্ত স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। এই আপ্তবাক্য বহুলাংশেই সত্যি হয়। এখানে যেন তা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে। গণতন্ত্রে বিরোধীদেরও একটা মর্যাদা আছে। যতই তারা হ্রাস হতে থাকুক, গণতন্ত্র তাদের পাশেও থাকবে। সেই শক্তিহীন বিরোধীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাও এক ধরনের ছদ্ম-স্বৈরতন্ত্র। কাশ্মীরের ভালো চায় সকলেই। সেই সত্যকে সামনে রেখে সকলকে নিয়ে সরকারের এগিয়ে যাওয়া উচিত। একক সিদ্ধান্তে সেনাশক্তির নিগড়ে কাশ্মীরকে বাঁধতে চাইলে তার পাল্টা প্রতিঘাত আসতে পারে। সেটাই দেখিয়ে দিল কাশ্মীর। বোঝা গেল আরও সাবধানী হতে হবে। সীমান্তের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতেই হবে। সামনেই শীত। সীমান্তের ওপারে ওৎ পেতে আছে জঙ্গিরা। তাদের প্রতিহত করতেই হবে। জঙ্গিদের থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে এবং সাধারণ নিরীহ কাশ্মীরিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারলে তবেই শন্তি ফিরবে ভূস্বর্গে। সেটা ঠিক মতো করতে পারাটাই সরকারের কাজ। একটা সুন্দর জঙ্গিমুক্ত কাশ্মীরের দিকেই তাকিয়ে মানুষ।