কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। দূর ভ্রমণের সুযোগ। অর্থ প্রাপ্তির যোগ। যে কোনও ... বিশদ
গান্ধীজির কর্মজীবন ক্ষমতার রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজ ও তার নেতৃত্বের সাত্ত্বিক আচরণের উপর তিনি উনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ প্রেরিত, অহংকার ও বিকারের ভিত্তিতে চলা দেশের মধ্যকার এবং বিশ্ব রাজনীতি কে তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। সত্য, অহিংসা, স্বাবলম্বন এবং যে-কোনও মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তিতে ভারতের জনজীবন গড়ে উঠুক, দেশ এবং মানবতার জন্য এটাই তার স্বপ্ন ছিল। গান্ধীজির নিজের জীবন তার এই ভাবনার মূর্ত রূপ হয়ে উঠেছিল।
১৯২২- এ গান্ধীজি বন্দি হওয়ার পর নাগপুর শহর কংগ্রেস এক সভার আয়োজন করেছিল। সেই সভায় বক্তা রূপে ড. হেডগেওআর ‘পুণ্যপুরুষ’ বিশেষণে গান্ধীজিকে অভিহিত করে বলেছিলেন যে, গান্ধীজির কথা ও কাজের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। নিজের ধৈর্য এবং চিন্তাধারার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন যে শুধু গান্ধীজির গুণ কীর্তন করলেই গান্ধীজির আরাধ্য কাজ এগবে না। গান্ধীজির অনেক গুণ নিজেদের জীবনে অনুসরণ করলেই তা গান্ধীজির কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পরাধীনতা জাত দাস মানসিকতা যে কত ক্ষতিকর গান্ধীজি তা জানতেন। সেই মানসিকতা মুক্ত, শুদ্ধ স্বদেশী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের বিকাশ এবং আচরণের এক স্বপ্নীল চিত্র তিনি ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই সময় বিশ্বের সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো পার্থিব উন্নতির বলে বিজয়ী পাশ্চাত্য জগৎ, তাদের জীবন পদ্ধতি ও শৈলী, ক্ষমতা বলে শিক্ষাকে বিকৃত করে আর্থিক দৃষ্টিতে সকলকে নিজেদের আশ্রিত তৈরি করার চেষ্টা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। এরকম সময়ে গান্ধীজির এই প্রয়াস ‘স্বত্বের’ ভিত্তিতে জীবনের সমস্ত দিকগুলি সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সফল প্রয়োগ । কিন্তু দাস মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা না ভেবে চিন্তে পশ্চিমি সমস্ত বিষয়কেই প্রামান্য মনে করে নিজেদের পূর্বজ, পূর্ব গৌরব এবং পূর্বসংস্কারকে হীন ও হেয় মনে করে অন্ধ অনুকরণ ও চাটুকারিতায় মেতে ওঠেন। তার বিরাট প্রভাব আজ ভারতবর্ষের দিশা এবং দশায় প্রতিফলিত। অন্য বহু দেশে সমকালীন মহান ব্যক্তিরা গান্ধীজির ভারত-কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে কিছু অংশ গ্রহণ করে নিজেদের দেশের চিন্তাধারাকে ঋদ্ধ করেছিলেন। আইনস্টাইন তো গান্ধীজির মৃত্যুতে বলেছিলেন যে, আগামী প্রজন্মের পক্ষে এটা বিশ্বাস করাই কঠিন যে এরকম কোনও ব্যক্তি এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এরকম পবিত্র আচরণ এবং বিচারধারা গান্ধীজি নিজের জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের সামনে রেখেছিলেন।
গান্ধীজি ১৯৩৬ সালে ওয়ার্ধার কাছে আয়োজিত সংঘ শিক্ষা বর্গে এসেছিলেন। পর দিন ডাক্তারজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ গান্ধীজির বাসস্থানেই হয়েছিল। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর বিস্তৃত চর্চা এবং প্রশ্ন-উত্তর এখন প্রকাশিত হয়েছে। দেশ বিভাজনের রক্তরঞ্জিত সময় দিল্লিতে তার বাসস্থানের কাছাকাছি এক শাখায় উনি এসেছিলেন। শাখাতে তাঁর বৌদ্ধিক হয়েছিল। এর বর্ণনা ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালের ‘হরিজন’-এ ছাপা হয়েছিল। সংঘের স্বয়ংসেবকদের অনুশাসন এবং তাঁদের মধ্যে জাতপাতের বিভেদ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত দেখে গান্ধীজি প্রসন্ন হয়েছিলেন।
‘স্ব’-এর ভিত্তিতে ভারতের পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখা এবং সামাজিক সমতা ও সমরসতার সম্পূর্ণ পক্ষপাতী, নিজের কথাকে স্বয়ং আচরণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা, সমস্ত মানুষের জন্য আদর্শ পূজ্য গান্ধীজিকে আমাদের সকলেরই দেখা, উপলব্ধি করা ও সেইমতো আচরণ করা উচিত। তাঁর এসব সদগুণের কারণে গান্ধীজির চিন্তাধারার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিও তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ক্ষেত্রে প্রতি দিন সকালে এক স্ত্রোত্রম-এর মাধ্যমে আমাদের দেশের মহান ব্যক্তিদের পরম্পরা স্মরণ করার প্রথা সংঘ স্থাপনার সময় থেকেই আছে । ১৯৬৩ সালে তাতে কিছু নতুন নাম যুক্ত করা হয়। ইতিমধ্যে পূজনীয় গান্ধীজির তিরোধান হয়েছিল। তাঁর নামও এতে যুক্ত হয়। বর্তমানে এটিকে ‘একাত্মতা স্তোত্রম’ বলে। সংঘের স্বয়ংসেবক প্রতিদিন সকালে ‘একাত্নতা স্তোত্রম’-এ গান্ধীজির নাম উচ্চারণ করার মধ্য দিয়ে উপরোক্ত গুণসম্পন্ন তার জীবনকে স্মরণ করে।
তাঁর আবির্ভাবের ১৫০-তম বর্ষে তাঁকে স্মরণ করে আমাদের সকলের সংকল্প করা উচিত যে তাঁর পবিত্র, ত্যাগময় এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ জীবন তথা ‘স্ব’ ভিত্তিক জীবন অনুসরণ করে আমরা বিশ্বগুরু ভারতকে গড়ে তোলার জন্য নিজেদের জীবনকেও ত্যাগ ও সমর্পণের গুণে সমৃদ্ধ করি।