কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। দূর ভ্রমণের সুযোগ। অর্থ প্রাপ্তির যোগ। যে কোনও ... বিশদ
স্বাভাবিক প্রজ্ঞা থেকেই গান্ধী ১৯০৯ লেখা তাঁর বই হিন্দ স্বরাজ এ বলেছিলেন অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন এবং বস্তুবাদের ফল দেশের পক্ষে ভাল হবে না। নদী ও জলদূষণের যা এখন এক ব্যাপক চেহারা নিয়েছে, তার বিপদ সম্পর্কে তিনি বহু আগে থেকেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। অতিরিক্ত ফলনের আশায় জমির স্বাভাবিক উর্বরতা শক্তিকে অস্বীকার করে বেশিমাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহারের বিপদ যে আমাদের কৃষি উৎপাদন তো বটেই জল ও জমির বিরাট বিপদ ডেকে এনেছে তা এখন আমরা রোজকার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝছি।
পরিবেশ কথাটার সঙ্গে সচেতন কথাটা বলা এখন প্রায় একটা অনিবার্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গান্ধীজি দেখেছিলেন, আদিবাসী ভূমিপুত্ররা তো বটেই, গরিবরাও পরিবেশের ক্ষতি কম করেন। পরিবেশ সচেতনতা যেন তাঁদের একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। গাছের ফল, নদীর জল, মাছ, ক্ষেতের ফসল সবকিছুই তাঁরা ব্যবহার করেন নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী। গান্ধীর ভাষায়, তাঁরা বিশ্বাস করেন পৃথিবীর সম্পদগুলি সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। ভাগ করে দিতে হবে সবার মধ্যে। এখানেই গান্ধীর ভাবনার সঙ্গে মার্কসের ক্ষমতা অনুযায়ী দেওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নেওয়ার তত্ত্ব মিলে যায়। কিন্তু ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’র মতোই বিত্তবান মানুষ, শিল্পপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির লোভ এই ভাবনাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। এমন ঘটতে পারে বুঝেই বাপু সাবধানবাণী করেছিলেন সমবণ্টনই দারিদ্র্য দূর করতে পারে। একজন সবটা নিয়ে নিলে আরেকজন বাঁচবে না। এখন সেটাই ঘটছে। জল-বায়ু-দূষণের বিপদ স্পর্শ করেছে বিত্তবানদেরও। ধনী দেশগুলিও পরিবেশ দূষণের শিকার। শিল্পোন্নত পৃথিবীতে এখন দূষণ সবচেয়ে বেশি। শহরের দূষণ স্পর্শ করেছে গ্রামকে।
গান্ধীর দর্শনের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হল তিনি কোন কিছুকেই খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখেননি, দেখেছেন একটা সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে। জল-স্থল-অন্তরীক্ষে বিরাজমান প্রাণীকুলের একটা বড় অংশকে প্রায় শেষ করে আনার পর মানুষের এখন তাঁর শিক্ষা মনে পড়েছে। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর সব প্রাণীদেরই মানুষের মতো বাঁচার অধিকার রয়েছে। মানুষকে তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই বাঁচতে হবে। আমাদের ধর্ম, লোকাচার, লোককথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ঠিক এই কথাটাই বলেছে। সেখানে আমরা গান্ধীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিরই প্রতিফলন দেখি। খুব স্পষ্ট করেই তিনি জানিয়েছেন, জল-জমি-বাতাস পৃথিবীর কোনোকিছুই মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নয়। আমরা যে অবস্থায় এটা পেয়েছি ঠিক সেই অবস্থাতেই এসব শিশুদের হাতে তুলে দিতে হবে আমাদের।
আজকের পরিবেশবিদরা গান্ধীর পরিবেশ ভাবনাকে বলছেন হিউম্যান ইকোলজি বা মানবিক বাস্তুতন্ত্র। যা মানুষের সঙ্গে তাকে ঘিরে থাকা পরিবেশের সম্পর্কের কথা বলে। আমরা দেখতেই পাচ্ছি, আমাদের ভালোমন্দ সব কাজেরই প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। বনবিনাশ, জলাজমি ভরাট করে ইমারত বানানো ইত্যাদি নিজেদের অপকর্মের ফল ভোগ করছি আমরা নিজেরাই। পরিবেশ সংরক্ষণে সচেষ্ট নাহলে আমরা বিপন্ন হব। সেই কবে বাপু বলে গিয়েছেন, পৃথিবী মানুষের প্রয়োজন মেটানোর মতো সবকিছুই যথেষ্ট পরিমাণে দিয়েছে, কিন্তু তা মানুষের লোভ মেটানোর জন্য নয়।
অথচ আমরা দেখছি প্রয়োজন ছাড়াই মানুষ প্রকৃতি থেকে প্রাণী জগৎ সর্বত্র অবাধ লুণ্ঠন চালাচ্ছে, গোলমালটা সেখানে। মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার যে কথা তিনি বলেছিলেন, আমাদের অকারণ লোভ তা শোনেনি। তিনি বুঝেছিলেন এই বিপদ আসতে পারে, তাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন সমগ্র পরিবেশ এবং জীবজগতকে নিয়ে বাস করার ওপর। এই ভাবনাকেই আজকের চিন্তাবিদরা বলছেন হিউম্যান ইকোলজি।
যে গ্রামনির্ভর অর্থনীতির কথা তিনি বলেছিলেন তা আদতে এই ভাবনারই বিস্তৃতি। তাঁর পরিবেশ ভাবনার সঙ্গে অর্থনৈতিক চিন্তার কোনও দূরত্ব নেই। উল্টোভাবে বলা যায়, এই অর্থনীতির রাস্তা ধরতে হলে পরিবেশকে সঙ্গে নিয়েই এগতে হবে। কারণ গ্রামীণ সমাজে চাষবাস তো বটেই এমনকী কুম্ভকার, মালাকার, সূত্রধর, তন্তুবায় ইত্যাদি আমাদের দেশের প্রধান বৃত্তিজীবী সম্প্রদায়গুলির কাজকর্ম একান্তভাবেই গ্রামীণ প্রয়োজন মেটায়। পরিবেশ থেকেই এদের কাজকর্মের উপাদান ও উপকরণ আহরিত হয়। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেই বাপু গ্রাম-ভারতের উপযোগী বিকল্প অর্থনীতির পরিকল্পনা করেছিলেন। এই তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, আজকের পৃথিবীতে তা কতটা কার্যকর প্রশ্ন থাকতে পারে তা নিয়েও কিন্তু তার সামগ্রিক চেহারাটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। সমাজের প্রতিটি বর্গের মানুষদের কথা ভেবে এমন একটা গ্রামসমাজের পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন যা পরিবেশকে বজায় রেখে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী স্বয়ংসম্পূর্ণ।
তত্ত্বের দিক থেকে গান্ধীর একটা মৌলিক অবদান হল অহিংসা। সেই অহিংসাকে কেন্দ্র করে আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারে আরও বেশি পরিবেশবান্ধব। অহিংসার নীতি শুধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই নয়, তা আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরিবেশ সংরক্ষণ কথাটা ব্যবহার না করে তিনি বলেছেন পরিবেশবান্ধব বিকাশের কথা। বলেছেন, বিকাশ যেন জল-বাতাস-নদী-সমুদ্র কোন কিছুকেই ধ্বংস না করে এগোয়। তাঁর কাছে বিকাশ মানে ভূমিপুত্রদের বাস্তুচ্যুত করা নয়, জল-জঙ্গল-জমি ধ্বংস করা নয়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের অস্তিত্ব ও অধিকার স্বীকার করেই মানুষকে বিকাশের রাস্তায় হাঁটার কথা বলেছিলেন তিনি। গান্ধীভাবনা মানে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে প্রতিটি মানুষ ও প্রাণের বাঁচার একটা স্বাভাবিক পরিসর থাকবে।
দুঃখের বিষয়, গান্ধীর নামে যাঁরা লাগাতার জয়ধ্বনি দেন, তাঁরাও তাঁর উন্নয়ন ভাবনার তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। উন্নয়ন বলতে তাঁরা বুঝেছেন চওড়া রাস্তা, উঁচু ইমারত, প্রচুর কারখানা, প্রচুর গাড়ি এবং যতটা সম্ভব নদী-নালা-সবুজ ধ্বংস করা। এই উন্নয়নের গুঁতো এমনই যে তা শুনেই গরিবরা চমকে ওঠেন, ভাবেন এই বুঝি তাদের জীবন ও জীবিকায় টান পড়লো। উন্নয়ন, বিকাশ, অগ্রগতি এসব শব্দ তাদের মনে আশার বদলে তৈরি করেছে হতাশা। অথচ ব্যাপারটা হওয়া উচিত ছিল ঠিক উল্টো।
পরিবেশ আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে নতুন করে গান্ধীকে বোঝার পাঠ নিতে হবে সবাইকেই। মানে দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে পরিচয়, মানুষের সঙ্গে পরিচয়। শুধু নিজের স্বার্থ নয়, দেখতে হবে সমগ্র প্রাণীজগতের স্বার্থ, বাস্তুতন্ত্রের স্বার্থ, শিখতে হবে সবাইকে নিয়ে চলা। প্রকৃতি কিন্তু বারবার আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে মানুষের অবাধ লুণ্ঠন সে আর মানবে না। একসময় মানুষের উদ্ভাবনী ভাবনার হাত ধরে এসেছিল যন্ত্র। কিন্তু তার যথেচ্ছ অপব্যবহার আমাদের চিন্তাভাবনাকেও যান্ত্রিক করে তুলেছে। যন্ত্রবলে বলীয়ান মানুষ বীরবিক্রমে চড়াও হয়েছে পরিবেশের ওপর। সর্বংসহা প্রকৃতি বহুদিন তা সহ্য করেছে। লোভী মানুষকে রক্ষা করার দায় এখন আর তার নেই। শুরু হয়েছে প্রকৃতির প্রতিশোধ। গান্ধীর ভাবনাকে আশ্রয় করেই মানুষ আজ নতুন করে পরিবেশ বাঁচানোর পাঠ নিতে পারে।