কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। দূর ভ্রমণের সুযোগ। অর্থ প্রাপ্তির যোগ। যে কোনও ... বিশদ
তবে, এই রসিকতার পিছনে একটা সত্যিও কি নেই! ইতিমধ্যেই তো খবর ছড়িয়েছে যে বিগত বছরগুলোর
মতো এবারও, রাজনীতির যাবতীয় টানাপোড়েন বিতর্ক অস্বস্তি
উড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো উদ্বোধনের ময়দানে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বা রাজ্য-রাজনীতির অন্য দিকপালেরাও পুজো উদ্বোধনের দৌড়ে আছেন বটে তবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের ফারাকটা এবারেও যোজন যোজন। পাশাপাশি, দিল্লি, মুম্বই বা দেশের অন্য রাজ্য থেকেও এইসময় যে বিশিষ্ট অতিথি-অভ্যাগতবৃন্দ পুজোর উদ্বোধন বা সেরা নির্বাচনের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আসেন এবং এবারও আসছেন, তাঁদের সেলেব দ্যুতিতে সংশ্লিষ্ট মণ্ডপে আড়ম্বর গরিমা, কৌতূহলী মানুষের ভিড় বাড়বে সন্দেহ নেই, কিন্তু জনপ্রিয়তায় এবারও সকলকে টেক্কা দেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এমনটাই আশা করছেন পুজোর উদ্যোক্তা থেকে সাধারণ মানুষজন। এই যদি হয় বাস্তব তাহলে রসিক মানুষ ওটুকু মজা তো করতেই পারেন, তাই না?
তবে, ওয়াকিবহালেরা বলছেন, পুজো উদ্বোধন বা জনপ্রিয়তার নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে অবধারিতভাবেই থাকবেন পদ্মশিবিরের মধ্যমণি দিলীপ ঘোষ। কয়েক বছর আগে রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিল করে সাড়া ফেলে দেওয়ার পর শেষ লোকসভা ভোটে ১৮ আসনের চমক বিজেপি রাজ্যশিবিরের সভাপতি দিলীপ ঘোষকে কেবল প্রধান মুখ হিসেবেই তুলে ধরেনি, দলের সদস্য সমর্থককুলে তাঁকে এক মহানেতার শিরোপায় ভূষিত করেছে। সেই সুবাদে বিরোধী নেতা দিলীপ ঘোষের আকর্ষণ যে রাজনীতির পরিসরের বাইরেও যথেষ্ট ছড়িয়েছে তাও আজ কেউ খুব অস্বীকার করেন না। ফলে পুজো উদ্বোধনের মঞ্চে উদ্যোক্তাদের কাছে অন্যদের তুলনায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যে অধিক হবে তা বলাই বাহুল্য। এখন এই গ্রহণযোগ্যতার বলে শাসক তৃণমূলের বাদবাকি নেতা-মন্ত্রীদের তিনি কতটা টেক্কা দিতে পারেন তা দেখার জন্য বাংলার কমপিটিশনপ্রিয় জনতা যে উদ্গ্রীব সেটা পথেঘাটে আড্ডা আলোচনা থেকে বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। সুরসিক বন্ধুর সংযোজন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে লাগাতার গরম গরম তরজা, রোখাচোখা বাক্যবাণ দিলীপ ঘোষের যে যুদ্ধং দেহি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে সেটা শান্ত-শিষ্ট ভক্তিমাধুর্যমণ্ডিত পুজোর আসরে কেমন দেখায় তা দেখার কৌতূহলও পাবলিক মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক নয়। বাঁধতেই পারে। সবমিলিয়ে তাই অনেকেই বলছেন পুজোর লড়াইয়ের পাশাপাশি এবার মহোৎসবে মুখ্য আকর্ষণের ক্রম তালিকায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যতিরেকে বাদবাকিরা উদ্বোধন-সংখ্যার লড়াইতে কে কোন পজিশন দখল করেন তা দেখার উৎসাহ আতিশয্য ক্রমশ সাধারণজনের মধ্যে প্রবলতর হচ্ছে।
কিন্তু, জনতার এই উৎসাহ আগ্রহে বাদ সাধতে কি উঠেপড়ে লাগল বৃষ্টি! ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিন পড়েছে কবেই। এখন কোথায় ঝলমলে রোদ্দুরে তুলো মেঘ ভাসা নীল আকাশ থাকবে, তা না, দেখলে মনে হচ্ছে ভরা শ্রাবণ! ঘন কালো আবার কখনও ধোঁয়াটে ধূসর একটা আকাশ, সারাদিনরাত কলকাতা সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে দফায় দফায় অঝোর ঝরে চলেছে, থামা নেই! পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে পুজোর চার দিন রেহাই পাবে কিনা তা নিয়েই তো ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অফিসও জোর দিয়ে তেমন কিছু এখনও বলতে পারছে না! অন্তত, শুক্রবার এই লেখা যখন লেখা হচ্ছে তখনও সেরকম কিছু শোনা গেল না! শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে? তবে অনেকবার এমনও হয়েছে, পঞ্চমী অব্দি যে আকাশ মুখ ভার করে রইল মাঝে মধ্যেই ভাসাল, সেই আকাশটাই ষষ্ঠীর ভোরে ভোল পাল্টে এক্কেবারে ঝকঝকে সুন্দর হয়ে দেখা দিল! সেই নীল শরতের আকাশ, পুজোর গন্ধ আর ঢাকের শব্দে জমে গেল উৎসবের আমেজ, আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে ফুটল হাসি। এমনটা এর আগে অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু এবার?!উদ্যোক্তা থেকে সাধারণ উৎসবমুখর মানুষ—সকলের মনেই এখন ওই একটি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সংশয়ের দোলাচল। কুমোরটুলির মতো রাজ্যের পটুয়াপাড়াতেও কোথাও কোথাও সে দোলাচালের অস্বস্তি। প্রতিমায় শেষ তুলির টান দেওয়ার লগ্নে যদি বৃষ্টিজল বিপত্তি বাধায় তবে সে অস্বস্তি তো স্বাভাবিক। এমনিতেই প্রতিমা তৈরিতে নতুন প্রজন্মের অনীহা পটুয়াপাড়ার ভিতরে ভিতরে একটা সমস্যা বাড়িয়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও যেটুকু আছে সেটুকু উজাড় করে দিয়ে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমে নিষ্ঠায় লাভালাভের চিন্তা ভুলে বাঙালির সবচেয়ে বড় সবচেয়ে মহিমাময় এই উৎসবকে বছর বছর সফল করে চলেছেন তাঁদের যাবতীয় শ্রম যদি অকালবর্ষণে বিপন্ন হয়ে পড়ে তবে সমস্যার ভার যে আরও ভারী হয় তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
তার উপর রাজ্য-রাজনীতিতে যা শুরু হয়েছে সেটাও তো পুজো উৎসবের মরশুমের পক্ষে খুব স্বস্তিদায়ক নয়। এতদিন কিছু হল না হঠাৎ পুজোর একেবারে মুখে দুই আইপিএস অফিসারকে সারদা-নারদা কাণ্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তৎপর হল সিবিআই। একজন গ্রেপ্তার হলেন অন্যজন বেপাত্তা। আর সিবিআইয়ের এই তৎপরতা নিয়ে অনিবার্যভাবেই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধী বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে জোর তরজা শুরু হয়ে গেল। রাজ্যে এনআরসি লাগু করা নিয়ে ইতিমধ্যে এমনিতেই রাজনীতির হাওয়া গরম হয়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে কোনও অবস্থাতেই এনআরসি করতে দেবেন না। আর তার পাল্টা রাজ্যে এনআরসি করতে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও তাঁর সহযোগীরা একরকম চ্যালেঞ্জই নিয়ে বসেছেন! শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটা সময় বলবে। কিন্তু পুজোর সময় সারদা-নারদা এনআরসি এবং অবশ্যই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবুল সুপ্রিয়র সাম্প্রতিক ব্যাপারটা নিয়ে বাংলায় যে চাপা রাজনৈতিক উত্তাপ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তাতে পুজোর আনন্দে যে কিছুটা হলেও বেসুর বেজেছে তাতে সন্দেহ কী? গতকাল মহালয়ার দিনটিতেও রাজনীতি রেহাই দিল না। কী আশ্চর্য!
অথচ, একটা সময় ছিল যখন এই মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী আর গঙ্গার ঘাটে ঘাটে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য তর্পণের মন্ত্রে এই দিনটাকে অন্য দিনগুলোর চেয়ে কেমন যেন আলাদা মনে হতো। প্রিয়জনের উস্কে ওঠা স্মৃতি আর পুজোর গন্ধ মিলেমিশে উৎসবের একটা আবেশ-আমেজ তৈরি করে দিত। বলতে কী, মহালয়ার ভোর এলেই যেন শুরু হয়ে যেত বাঙালির মহাপূজার মহোৎসব। রাজ্যে-রাজনীতির যত টানাপোড়েনই থাক, এই দিন থেকে সাময়িক বিরতিতে চলে যেত যাবতীয় বাক্-বিতণ্ডা। শাসক-বিরোধী শত্রু-মিত্র সমস্ত বিবাদ ভুলে একযোগে মেতে উঠত উৎসবে। বাঙালির মহাপুজোর সেই চিরচেনা ছবিটা কি তবে আর পাঁচটার সঙ্গে বদলেই গেল! আর তাই কি পুজোর উষ্ণতা পুজোর আবেগ এখন রাজনীতির চক্রপাক কূটকচাল উপেক্ষা করে আপন ছন্দে দুর্নিবার হয়ে উঠতে থমকায়, ইতস্তত করে এবং উৎসবপ্রিয় সাধারণ জনের মনে নিঃশব্দে নীরবে সংশয়ের বীজ বুনে দিয়ে যায়! তাই কি, প্রাণখোলা হাসি উল্লাসের উৎসবে গা ভাসিয়েও বাঙালি এখন আর পুরোপুরি স্বস্তি পায় না, তার মনের কোণে একটা কাঁটা ফুটতেই থাকে! এবং রাজ্য-রাজনীতির দাপটে এবার কি সে কাঁটার জ্বালা একটু বেশিই?! কে জানে? তবে তথ্যভিজ্ঞদের অভিমত তো তেমনই।
তবু, তার মধ্যেও পুজো এসে গেল। মহালয়ার দেবীপক্ষের উদ্বোধনের পর মাঝে আর কটামাত্র দিন। তারপরই সব ভোলানোর সেই দিনগুলো এসে পড়বে। এবং চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দেখব আমাদের বছরভরের প্রতীক্ষায় রেখে কোথায় হারিয়ে গেল দিনগুলো! আলো নেভানো প্রতিমাহীন প্যান্ডেলের বিষাদ পিছনে ফেলে আপামর বাঙালি ফের নেমে পড়বে দৈনন্দিনের কাজে। কিন্তু তার আগে বাঙালিজন আপাতত মহামায়ার আরাধনার ওই চারদিনে অপার আনন্দের প্রত্যাশায় উন্মুখ। এখন লাগাতার বৃষ্টি আর সংঘাতময় রাজনীতির প্রতিকূলতা কাটিয়ে সাধারণের সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয় সেটাই দেখার। তবে আমাদের বিশ্বাস, মহামায়ার আশীর্বাদে সব বিঘ্ন কেটে যাবে, মানুষ পুজোর চারটে দিন নির্মল আনন্দে মাতোয়ারা হতে পারবে। পারবেই।