বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
ঝড় বিধ্বংসী হলেও তা ক্ষণস্থায়ী। তবে, থেকে যায় ঝড়ের প্রভাব ও স্মৃতি। যে কোনও বিধ্বংসী ঝড়ের পর মিস্ত্রির চাহিদা আকাশ ছোঁয়। ধ্বংসস্তূপ সরানো থেকে পুনর্নিমাণ সব ক্ষেত্রেই দরকার মিস্ত্রির। শুধু পার্থিব ঝড়ের ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝার পরও মিস্ত্রির চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া ঝড়ের পর রাজ্যজুড়ে মিস্ত্রি জোগাড়ে নেমেছে বিজেপি। শাসক দলের ‘নেগেটিভ ভোট’ আর জাতীয়তাবোধের ধাক্কায় সাফল্যের নৌকা তীরে ভিড়লেও ২০২১ সালে লড়াইটা বেশ কঠিন তা ‘কেশব ভবন’ খুব ভালো করেই জানে। কারণ ২০২১ সালের ভোটে বালাকোট থাকবে না। কাটমানি ইস্যুতে তৃণমূলের বহু মাতব্বরের গলায় লেগেছে ‘বকলেস’। তার উপর তৃণমূল যদি কৌশলে ‘কাটমানি নেতা’দের শোকেস থেকে গোডাউনে পাঠিয়ে দিতে পারে, তাহলে বিজেপির লড়াইটা আরও কঠিন হবে।
লড়াইটা কঠিন হবে বুঝেই সংগঠনে মন দিয়েছে বিজেপি। শুরু হয়েছে ‘সদস্যতা অভিযান’। দল না বাড়লে ক্ষমতা দখল করা যায় না। তাই শুরু হয়েছে ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি। আর সেখানেই বেধেছে বিপত্তি। তবে ক্ষমতা দখল, আর এলাকা দখল এক নয়। ক্ষমতা দখলে লাগে মানুষের সমর্থন, আর এলাকা দখলের হাতিয়ার বোমা, বন্দুক ও মস্তান। ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে মানুষই সম্পদ। আর এলাকা দখলে দাগিরা হয়ে ওঠে ‘দলের সম্পদ’। ‘দলের সম্পদরা’ চটজলদি রেজাল্ট দেয় বলে দলে তাদের দাপটও মারাত্মক। ভোট রাজনীতিতে সাফল্যই শেষ কথা হওয়ায় ‘দলের সম্পদ’দের গুরুত্ব অসীম। ইতিহাস সেকথাই বলে। ২০০০ সালে সিপিএমের কেশপুর, গড়বেতা, চমকাইতলা পুনর্দখলের সময় অন্তত তেমনটাই দেখা গিয়েছিল। গ্রাম দখল অভিযানে
সামনে থাকত কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা দুষ্কৃতীরা। তাদের হাতে থাকত লং রেঞ্জের রাইফেল। সেই রাইফেলে অনেক দূর থেকে বিরোধীদের দখলে থাকা গ্রামের ‘যোদ্ধা’দের শুইয়ে দেওয়া যেত। লড়াইয়ের দিনগুলিতে মস্তানদের পিছনে পিছনে ঝাণ্ডা নিয়ে যেতেন ক্যাডার ও নেতারা। গ্রাম দখলের পর গাছের মগডালে বেঁধে দেওয়া হতো লাল ঝাণ্ডা। সেই ঝাণ্ডার আস্ফালনই বুঝিয়ে দিত, গ্রামের মালিক সিপিএম।
শাসক বদলায়, ক্ষমতা বদলায়, কিন্তু এলাকা দখলের কৌশল বদলায় না। তাই মানুষের ভোটে জিতেও শাসকদল ভিত শক্ত করতে প্রশ্রয় দেয় সেই ‘দলের সম্পদ’দেরই। মানুষ হয়ে যায় গৌণ। এই একই ভুল শাসকদল সর্বত্র করে। বারে বারে করে। কারণ ক্ষমতার দম্ভ মানুষের বিবেচনা শক্তিকে শুষে নেয়। তবে, ‘দলের সম্পদ’দের সঙ্গে ভোটারদের সম্পর্কটা অনেকেটা গণিতের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের মতোই। একজন বাড়লে, অন্যজন কমে। দলে মস্তানদের আধিপত্য বাড়লে জনগণ সরে যায়, আবার মস্তান নির্ভরতা কমলে জনসমর্থন বাড়ে। এর অন্যথা হয় না।
টানের বাজারে জোগাড়েও কর্নিক হাতে নিয়ে রাজমিস্ত্রি হয়ে যায়। আবার কেঁট আলু, দাগি আলু, এমনকী পচা আলুও বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। অনেকটা সেইভাবেই বিজেপির টানের বাজারে সিপিএম আর তৃণমূলের দাগি, পচারা গেরুয়া শিবিরের রাজা, উজির হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই মুহূর্তে বিজেপিতে সংগঠকের বড়ই প্রয়োজন। কারণ ‘আবেগের সমর্থন’ আর মেঘ অনেকটা একই রকম। যে কোনও সময় ভেসে ভেসে এদিক থেকে ওদিকে চলে যেতে পারে। তবে, মৌসুমী বায়ুর ছোঁয়া পেলে অবশ্য সেই মেঘই বৃষ্টি হয়ে ঝরে। আর বৃষ্টি হলে রুখাশুখা মাঠও সুজলা সুফলা হয়ে ওঠে। তাই সংগঠকদের বাজার এখন তুঙ্গে।
রাজনীতিতে মৌসুমী বায়ুর কাজটা করে সংগঠকরাই। সেই কারণেই সংগঠকদের এত চাহিদা। তাতে কেঁট হোক, পচা হোক বা দাগিই হোক, গায়ে সংগঠকের ছাপটা থাকলেই হল। সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেন না তৃণমূল ও সিপিএমের সুযোগ সন্ধানীরা। কারণ তাঁরা ভাবছেন, আকাশে যে মেঘ জমেছে তাতে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। সেই কারণেই লেগেছে হুড়োহুড়ি। বিশেষ করে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকা প্লেয়াররা তো পায়ে বল ছোঁয়ানোর জন্য মরিয়া। তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে প্রকৃতি কেমন যেন খামখেয়ালিপনা শুরু করেছে। দামি দামি যন্ত্রের সাহায্য নিয়েও আবহাওয়াবিদদের দেওয়া পূর্বাভাস মিলছে না। আবহাওয়াবিদরা হয়তো বলছেন, সারাদিন বৃষ্টি হবে। অথচ সকাল থেকে রোদে কাঠ ফাটছে। আবার উল্টোটাও হচ্ছে। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে যাচ্ছে। তাই পূর্বাভাসে মানুষ আর আগের মতো ভরসা রাখতে পারছে না। সব সময় যেন মনের মধ্যে কেমন একটা কিন্তু-কিন্তু ভাব থেকেই যাচ্ছে।
মেঘের সঙ্গে মৌসুমী বায়ুর সংযোগ স্থাপন হবে কি না, সেটা সময়ই বলবে। তবে মস্তান, দাগি, পচাদের ভিড় বাড়লে দলের ইমেজ যে কেরোসিন হতে পারে সেটা বিজেপির অনেকেই আশঙ্কা করছেন। আর তা হলে মুখ থুবড়ে পড়বে ‘মিশন-২০২১’। সেই জন্যই ‘সবারে করি আহ্বান’ গানে অনেকে আপত্তি জানিয়েছেন। তবে এব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছেন আসানসোলের সংসদ সদস্য তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। সম্ভবত দলের মধ্যে আপত্তি জানিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না বুঝেই তিনি দুম করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন একটি ‘ভয়েস মেসেজ’। দুর্গাপুরের ‘চিন্তন শিবিরে’র আগের দিন ওই ‘ভয়েস মেসেজে’ তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, দল বাড়াতে হবে ঠিকই। তবে তৃণমূলের নেতাদের নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ঘোর আপত্তি আছে। কারণ তৃণমূলের নেতারাই বিজেপি কর্মীদের উপর অত্যাচার চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন। শুধু আপত্তির কথা জানিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, তিনি যোগদান প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
চিন্তন শিবির বিজেপি নেতাদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ চিন্তন শিবিরের দ্বিতীয় দিনে দুর্গাপুরে প্রকাশ্য সভায় তৃণমূল নেতার যোগদানকে কেন্দ্র করে তুমুল অশান্তি হয়। ‘সুশৃঙ্খল’ পার্টির কর্মী সমর্থকরা সভাস্থলে চেয়ার ভেঙে নেতাদের কাজের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মীদের বক্তব্য, যারা এতদিন বিজেপি কর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে, লুটপাট চালিয়েছে, তাদের দলে নিলে চলবে না। গেরুয়া শিবিরের আদি কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, যাদের উপর রেগে মানুষ তাদের দলকে সমর্থন করেছে ফের তারাই যদি ‘বিজেপির মুখ’ হয়ে যায় তাহলে কেন বিজেপিকে চাইবে?
তবে ক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মীদের আশঙ্কার জায়গাটা আরও বড়। তাঁদের ধারণা, বিভিন্ন জায়গায় অন্য দলের যে সব নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁরা বেশিরভাগই প্রচুর টাকার মালিক। টাকার জোরে একদিন তাঁরাই দলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। তারপর তাঁরাই সুযোগ বুঝে আমাদের উপর অত্যাচার চালাবেন। ঠিক এটাই হয়েছিল তৃণমূলে। তাহলে আমরা কি সব সময় পড়ে পড়ে মারই খাব? দুর্গাপুর বা আসানসোলের ঘটনা হয়তো খণ্ডচিত্র। তবে, প্রায় একই ঘটনা ঘটছে বর্ধমান, কেশপুর, গোঘাট, বীরভূম সহ রাজ্যের প্রায় সর্বত্র। সিপিএম এবং তৃণমূলের বিক্ষুব্ধরা বিভিন্ন জায়গায় বিজেপির হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।
দল বাড়ানোর জন্য একটা সময় তৃণমূল যে ভুল করেছিল, বিজেপি নেতৃত্ব রাজ্যের বহু জায়গায় সেই একই কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেখে চিন্তন শিবিরের পর বিজেপির এক প্রবীণ কর্মী বলেন, নিজেদের লোককে তৈরি করে নেওয়ার আনন্দটা যে সন্তান মানুষ করার চেয়ে কম নয়, সেটা আমাদের কেউ কেউ বুঝতে পারছেন না। এই দেখুন, চন্দ্রযান-২ নিয়ে আমাদের এত আবেগ কেন? কারণ সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে, দেশের বিজ্ঞানীরা এই চন্দ্রযান তৈরি করেছেন। সেই জন্য চন্দ্রযান-২ এর সঙ্গে গোটা দেশের মানুষের আবেগ জড়িয়ে গিয়েছে। আজ যদি এটা আমেরিকার নাসার সঙ্গে যৌথভাবে করত তাহলে কি এই আবেগ থাকত? না, কিছুতেই থাকত না। দেখুন, চন্দ্রযান-১ চাঁদে নামতে পারেনি। সেই ব্যর্থতা ভুলে গিয়ে মানুষ চন্দ্রযান-২’কে নিয়ে আবেগে ভেসেছে। কারণ নিজেদের তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আবেগ অসীম। সেই জন্যই তো নিজের গাছের টক আমও সুস্বাদু লাগে।
ওই প্রবীণ বিজেপি কর্মী বলেন, আসলে আবেগ এক ভয়ঙ্কর শক্তি। আবেগ অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। আবেগ ছিল বলেই মোহন বাগানের খেলোয়াড়রা খালি পায়ে ফুটবল খেলে বুট পরা ইংরেজদের হারাতে পেরেছিল। আবেগ ছিল বলেই এরাজ্যে প্রায় কোনও রকম সংগঠন ছাড়াই বিজেপি আজ ২ থেকে ১৮। আবেগ আছে বলেই তো মানুষ আর যন্ত্র আলাদা। তা না হলে সব এক হয়ে যেত। ভাড়াটে সৈনিকের মধ্যে আবেগ থাকে না। তাই ভাড়াটে সৈনিক এনে হয়তো সংখ্যা বাড়ানো যায়, বিরোধীদের চাপে রাখা যায়, কিন্তু যুদ্ধ জেতা যায় না। এই সহজ সত্যিটা আমাদের নেতারা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই মঙ্গল।