পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
এসব থাকলে যেটা হবে তা হল সর্বদা সরকারের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না। আমার কাছে সবথেকে আদর্শ হল গ্রামবাসীরা যদি নিজেদের ভালোর জন্য পারস্পরিক সহায়তায় নিজেরাই জোট বাঁধে। ভেদাভেদ ভুলে কী করলে গোটা গ্রামের উন্নতি ও মঙ্গল হবে, সেটা উপলব্ধি করে নিজেরাই পরিশ্রম করলে দেখা যাবে উন্নতির আলো। গান্ধীজির ওই বার্তার ৮২ বছর পর আমাদের রাজনৈতিক দল কিংবা সরকার এরকম কোনও আদর্শ গ্রাম কি উপহার দিতে পেরেছে? গান্ধীজি এই নিবন্ধের শেষে লিখেছিলেন, সবথেকে হতাশার বিষয় হল মানুষের অগ্রবর্তী হয়ে কিছু করার প্রতি অনীহা। শহুরে গবেষক, রং বে-রং দলীয় সমর্থক, রিসার্চ স্কলার, নেতানেত্রীর ভক্ত এবং দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশোদ্ধার করা জাতি নয়, গান্ধীজির এসব বার্তার প্রকৃত অনুসরণকারী ভারতের অসংখ্য গ্রামের নিরক্ষর মানুষের দল। আমরা যখন তিন তালাক থেকে ৩৭০ নং নিয়ে প্রচুর মাতামাতি করছি তখন রাজস্থানের প্রত্যন্ত কয়েকটি গ্রামে একটি বিপ্লব চলছে।
২০১২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৬টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন হীরা। রাজস্থানের বাঁশওয়াড়া জেলার সেওয়ানা গ্রামের হীরার সন্তানেরা প্রত্যেকেই কন্যা। বাঁশওয়াড়ার এইসব গ্রামের সবথেকে দুঃখজনক একটা প্রবণতা হল এখানে ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়স হওয়ার পরই গৃহবধূরা বৃদ্ধা হয়ে যান, মানসিক রোগীর লক্ষণ দেখা যায় এবং আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। কেউ সফল হন। কেউ হন না। স্থায়ী কোনও অসুস্থতায় ঘরের বাইরের খাটিয়ায় বাকি জীবন কেটে যায় শয্যাশায়ী হয়ে। যাই হোক। হীরার পরপর পাঁচটি কন্যাসন্তানের পর যখন গত ডিসেম্বর মাসে ষষ্ঠ সন্তান প্রসব হল, তখন তাঁকে বলা হয়নি কী সন্তান হয়েছে। তিনি কয়েকবার প্রশ্নও করেন। কিন্তু কারও কাছে জবাব না পেয়ে যখন শুনলেন শাশুড়ির কণ্ঠে উচ্চস্বরে কান্না, তখন বুঝলেন এবারও কন্যা। তিনিও কাঁদতে লাগলেন। স্বামীও। প্রতিটি সন্তানের পরই পাশের গ্রামের এক সাধুর কাছে যাওয়া হয়। তিনি পরবর্তী সন্তানধারণের সম্ভাবনা জানার পর একটি মন্ত্রঃপূত নারকেল দিয়ে থাকেন। সেটা ফাটিয়ে খেতে হয় নির্দিষ্ট দিনে।
সেই সাধু অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বলেছেন, হীরা তুই তোর মায়ের থেকেও বেশি অভিশপ্ত। তোকে মনে হয় কিছু করা যাবে না। হীরার মায়ের চার মেয়ে। সুতরাং হীরার মাকে হীরা হারিয়ে দিয়েছে। এই কাহিনীগুলি এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায় অথবা চলতে থাকে। কিন্তু রাজস্থানের ওয়াকা গ্রামের ক্লাস এইট পাশ কল্পনা নামের এক রাওয়াল জাতির মেয়ে অন্যরকম ভাবলো। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে তিনটি মাটির কলসি মাথায় নিয়ে জল আনার সময় কুয়োর অদূরে বসে কাঁদছিল হীরা। তাঁকে সান্তনা দিচ্ছিলেন আরও কয়েকজন নারী, যাঁদের প্রত্যেকের কন্যাসন্তান হওয়ায় উপেক্ষা আর অত্যাচারই জোটে। এই মহিলাদের বলা হয় কৃষিমজুরি করে মেয়ের বিয়ের টাকা জমানো শুরু করতে। কারণ যে মা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে তাঁরই দায় সেই মেয়ের বিয়েতে খরচ করার। এভাবে পরিশ্রম, স্বল্প পুষ্টি, প্রতি বছর সন্তান গর্ভে ধারণ করা, পুত্রসন্তান জন্ম না দেওয়ার কারণে বদনাম এবং তারপর ডিপ্রেশন। এই চক্রে গ্রামের পর গ্রাম বধূরা অসুস্থ অথবা মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে যান। এই নারীরা সারাবছর কৃষি কিংবা ১০০ দিনের কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করেন এবং প্রতি বছর নতুন করে গর্ভবতীও হন। কল্পনা এই মেয়েদের কাঁদতে দেখে একটি শপথ নিয়েছিল। ২৫ জন গ্রাম্য মহিলা একটি কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে গঠন করলেন ‘তাজো পরিবার’ নামক কর্মসূচি।
সেই থেকে এই মহিলারা সময় করে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন আর বিভিন্ন পরিবারের স্বামী শাশুড়িদের বোঝাচ্ছেন কেন কন্যা ও পুত্রসন্তানের মধ্যে বিভেদ না করে মেয়েদের সমানভাবে শিক্ষা দিলে কতটা লাভ। আর এভাবে পাঁচটি ছটি সাতটি সন্তানের জন্ম না দিয়ে একটি বা দুটিতেই সীমাবদ্ধ রাখলে সুখী সংসার হবে। সেই তাজো পরিবার কর্মসূচিকে আটকানোর বহু চেষ্টা হয়। বহু অত্যাচার হয় এঁদের উপর। কিন্তু পিছু না হটে এই গ্রাম্য মহিলারা শক্তি সঞ্চয় করেই চলেছেন। সরকারের দ্বারস্থ না হয়েই এঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দাঁতে দাঁত চেপে। তাঁরা দেখলেন একটি করে নতুন গ্রামে যাচ্ছেন, আর সেই গ্রামের দু তিনজন মেয়ে যোগ দিচ্ছেন এগিয়ে এসে। সম্প্রতি এঁদের একটি বৈঠকে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের নানারকম সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের কী অভিমত? এইট পাশ কল্পনা ‘তাজো পরিবার’ কর্মসূচির প্রধান। তিনি হেসে বলেছেন, আমরা কেউ জানি না...জানার সময় নেই আসলে...এটা জানি আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে।
ওড়িশার কোরাপুটের ৭১ বছর বয়সি কমলা পূজারি প্রতিদিন ভোরে উঠে স্নান করে উঠোনে পুজো সেরে আগের রাতের জলে ভেজানো ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। এরপর হাঁটা। কমলার চোখ রাস্তায় থাকে না। থাকে রাস্তার পাশের ক্ষেতে, গ্রাম্য বাড়ির অঙ্গনে কিংবা একটুকরো রান্নাঘর সংলগ্ন বাগানে। রাসায়নিক আর পেস্টিসাইড ব্যবহার করে করে ভারতের গ্রামে গ্রামে ধান কিংবা অন্য ফসলের বহু বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কমলা পূজারির কাজ হল যখন যেখানে যে ফসল দেখলেন সেটারই বীজ জোগাড় করে নিলেন। আর সেটা জমিয়ে ফেললেন। এভাবে বীজ জমাচ্ছেন কমলা পূজারি। একটি থেকে দুটি বীজ। তিনটি থেকে কুড়িটা বীজ। কমলা পূজারির বাড়িতে হাজার হাজার বোতলে বীজ রাখা আছে। গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন আর বিরল প্রজাতির বীজ দিয়ে চাষিদের বলেন পেস্টিসাইড আর কেমিকেল ব্যবহার করলে সব বীজ একদিন নষ্ট হবে। শুধুই বীজ কিনতে হবে বড়লোক ব্যবসায়ী কোম্পানির থেকে। কমলা পূজারি হাঁটছেন এখনও। বীজ সংগ্রহ করতে। নেমে পড়ছেন কাদামাঠে, নেমে পড়ছেন অর্ধেক জলমগ্ন পুকুরে। কমলা পূজারি হেঁটে চলেছেন। ভারতের নিজস্ব বীজ বাঁচাতে। আজ গোটা ভারত থেকে বিদেশ থেকে বিজ্ঞানীরা আসেন কোরাপুটের গ্রামে। কমলা পূজারির কাছে বীজ দেখতে। কমলা পূজারির মাটির বাড়িতে এক অভিনব সম্ভার। ভারতের বীজব্যাঙ্ক! কমলা পূজারি কারও উপর ভরসা করে বসে নেই। তিনি নিজের কাজ নিজে করছেন।
ভারতের অর্থনীতি একটা সময় সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল কৃষির উপর। সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে সেই অর্থনীতি এখন নির্ভর করে ইণ্ডাস্ট্রি আর সার্ভিস সেক্টরের উপর। ভারতের জনসংখ্যার বিপুল অংশ একসময় গ্রামে থাকত। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের জনসংখ্যা ক্রমেই এখন শহরমুখী। কেন? কারণ গ্রামীণ অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের কিনারায় উপনীত হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট একটি সমীক্ষা করেছে। সেটির নাম অল ইন্ডিয়া রুরাল ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন।
সেই সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে ভারতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ পরিবারের সংখ্যা ২২ কোটি। আর এই ২২ কোটি পরিবারের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে কৃষির সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এরকম পরিবার ১০ কোটি। বাকি ১২ কোটি পরিবার কৃষির সঙ্গে যুক্তই নয়। আর ওই সার্ভে অনুযায়ী গ্রামীণ পরিবারের মাসিক গড় আয় ৮০৫৯ টাকা। এর মধ্যে গড়ে ৩৫০৪ টাকাই আসে দিনমজুরি থেকে। ১৯০৬ টাকা গড় আয় হয় সরকার কিংবা বেসরকারি কোনও কাজ থেকে। আর মাত্র ১৮৩২ টাকা গড় আয় কৃষি থেকে। সুতরাং কৃষি থেকে আয় কমছে। গ্রাম থেকে মানুষ চলে যাচ্ছে সেমি আরবান শহরে। ভারতের গ্রামীণ চরিত্র বদলে যাচ্ছে। আর এই কারণেই আমাদের সরকার বেসিক বিষয়গুলি নিয়ে আর ভাবিত নয়। কৃষি উন্নয়নের একটা প্লাস্টিক প্লাস্টিক উন্নয়নের ভাবমূর্তি প্রকাশ করা হয় সাবসিডি বা সহায়ক মূল্য দিয়ে। যা সমস্যার সমাধান নয়। কারণ ভারতের কৃষিকে আসলে কিনে নিচ্ছে তাবৎ কর্পোরেট। ভারতজুড়ে ক্যাশ ক্রপ আর কর্পোরেট ফার্মিং চলছে। জলের সাপ্লাই কিনে নিয়েছে কর্পোরেট। নদী, পাহাড়, অরণ্যের অধিকার চলে যাচ্ছে মাল্টিন্যাশনালের কাছে। তামিলনাড়ুর থুটুকোড়ি জেলায় একটি বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল সংস্থার ইউনিটের বিষবর্জ্য গোটা জেলার বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে সমস্ত ভূগর্ভস্থ জল ও মাটির উর্বরতা দূষিত করে দিয়েছিল। গ্রামবাসীদের বিশুদ্ধ পানীয় জল আনতে যেতে হয় ৫ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু আবার নতুন করে কপার ইউনিট করার অনুমতিও পেয়েছে সেই সংস্থা। প্রতিবাদে ২০ হাজার গ্রামবাসী দিনের পর দিন অবস্থানে বসেছিল জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে। আবেদন ছিল ওই কপার কারখানা যেন না হয়। তাহলে চাষবাস বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবর্তে গুলি চালায় পুলিস। ১৪ জন মারা যান।
সেই সংস্থাটি কত দামে জল পেয়েছে? ১০ টাকায় ১ হাজার লিটার। গ্রামবাসীকে কত দামে জল কিনতে হয়েছে? ১০ টাকার ২৫ লিটার। গ্রামবাসীরা ফেসবুকে প্রতিবাদ করেননি। রাস্তায় নেমেছেন, গুলি খেয়েছেন। আমরা কি একদিনও আলোচনা করেছি? এই মুহূর্তে ১৬টি রাজ্যের ১০ লক্ষ আদিবাসী যে আন্দোলনটি করছে নিজেদের ভিটেমাটি ও জঙ্গল বাঁচাতে আমরা কি আদৌ সেটা নিয়ে চিন্তিত? কেউ জানি না কোথায় কী কর্মসূচি চলছে কোল ভিল গোন্দ আদিবাসীদের? আমরা নিজেদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করি না। ক্ষুদ্র গণ্ডিতে কোনও সমস্যা সমাধানে নিজেরা একটা কিছু করার শপথ নিয়ে অগ্রসরও হই না।
আমরা অনেক দূরের কাশ্মীর, অযোধ্যা, বালাকোট নিয়ে ভয়ানক উদ্বিগ্ন। কিন্তু কেন? রাষ্ট্রশক্তি ওটাই চায়। নিজেদের দৈনন্দিন সমস্যা ভুলে দূরের আলোছায়া মেশা ঘটনা নিয়ে যাতে জনগণ মেতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ পল্লীপ্রকৃতি গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘‘বিধাতা তো তেত্রিশ কোটির ভার আমাদের হাতে দেননি? তিনি শুধু একটি প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কী করছ?’ যে কার্যক্ষেত্র তোমার, সেখানে তুমি নিজেকে সত্য করেছো কিনা?’’ রাজস্থানের কল্পনা, কোরাপুটের কমলা পূজারিরা সেটাই করছেন। আমরা নয়!