পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
এবার পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের জন্মের ১২৫ বছর। ১৮৯৫ সালের ২৩ জুলাই পূর্ববঙ্গে পদ্মাপারের নারায়ণগঞ্জে তাঁর জন্ম। ১৯৫৩ সালের ২৫ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। আর দু’দিন বাদে তাঁর প্রয়াণের ৬৭ বছর।
কে এই পণ্ডিত মৈত্র?
ভারতের সংসদে বাগ্মী হিসেবে তিনজন পণ্ডিত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন—পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এবং পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। এই তিন পণ্ডিতের যেদিন ভাষণ থাকত সেদিন সংসদের চেহারা সর্বার্থে ঐতিহাসিক হয়ে উঠত। পণ্ডিত মৈত্র বয়সে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের চেয়ে বছর দেড়েকের এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে বছর ছয়ের বড় ছিলেন। দেশবরেণ্য এই দু’জনের সঙ্গেই তাঁর সখ্য ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষ সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধীজি, সর্দার প্যাটেল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সঙ্গেও।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড ভারতকে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভাঙার প্রস্তাব দিলেন। বাঁটোয়ারার চক্রান্ত মেনে নেওয়া নিয়ে কংগ্রেসের ভিতরে তখন দোলাচল—কংগ্রেস না-পক্ষে, না-বিপক্ষে! কংগ্রেস তখন কোনও রাজনৈতিক দল নয়, ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মঞ্চ। তার ভিতরে ভবিষ্যতের সমাজবাদী, কমিউনিস্ট, কট্টর মুসলিম, কট্টর হিন্দু, মধ্যপন্থী সকলেই। কংগ্রেসের এই দোলাচলের ভিতরে মদনমোহন মালব্যরা ‘কংগ্রেস জাতীয় দল’ নামে একটি উপদল গড়েছিলেন। যাঁরা ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে। ১৯৩৬ সালের নির্বাচনে সারা বাংলা থেকে কংগ্রেসের একজনমাত্র অফিসিয়াল প্রার্থী জয়ী হন। অন্যদিকে কংগ্রেসের বাকিরা পরাজিত হয়েছিলেন মালব্যের প্রার্থীদের কাছে। জয়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ঘনিষ্ঠ পণ্ডিত মৈত্র।
লক্ষ্মীকান্ত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। রসায়ন, ইংরেজি, সংস্কৃত, দর্শন ও আইন শাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। শৈশব বাল্য কৈশোর এবং যৌবনের সন্ধিক্ষণ কেটেছিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সরকারি জগন্নাথ কলেজে, কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন কলেজে। ছিলেন দুঁদে আইনজীবী। তাঁর খ্যাতি কৃষ্ণনগরের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতা ও দিল্লিতে ব্যাপ্ত হয়। তিনি ফেডারেল কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে আচমকা আইন পেশা থেকে সরে আসেন। স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর ভারতের আইনসভা তাঁর ক্ষুরধার বাগ্মিতায় ঋদ্ধ হয়েছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে স্বাধীন ভারতের জন্য প্রণীত সংবিধানে এবং শিক্ষা, খাদ্য, লবণ, স্বাস্থ্য, রেল, সড়ক ও পরিবহণ, ডাক ও তার, টেলিফোন প্রভৃতি বিষয়ক সেকালের সংসদীয় কমিটিগুলিতে। তৎকালীন বেঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের পরিচালন পরিষদ, সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজারি বোর্ড অফ এডুকেশন, দিল্লি ইউনিভার্সিটি কোর্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট, অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ টেকনিক্যাল এডুকেশনসহ একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রিহ্যাবিলিটেশন ফিনান্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তিনি ছিলেন প্রথম চেয়ারম্যান।
ধর্ম সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভারতভাগের বিরুদ্ধে তিনি বার বার সোচ্চার হয়েছেন। দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের দুর্দশা তাঁকে যন্ত্রণাকাতর করে তুলেছিল। শরণার্থীদের পুনর্বাসনের সমস্ত উদ্যোগে তাঁকে শামিল হতে দেখা গিয়েছে। বাঙালি শরণার্থীদের প্রতি বঞ্চনা বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাতে লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র তাঁর দলের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে তুলোধনা করতেও কখনও ভয় পাননি। ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ লোকসভায় অর্থ বিলের উপর ভাষণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘তাঁদের (পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু) সম্পর্কে এখানে কেউ কিছু বলে না। কারণ তাঁদের দুর্দশা সম্পর্কে এখানে কোনও প্রচার নেই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের অবস্থা এমনই যে সেখানে তাঁদের আত্মসম্মান নিয়ে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ... অর্থ বিলে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা মানুষের জন্য কোনও বরাদ্দ নেই! অর্থ বিলে ‘বাস্তুহারা’ কথাটির যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত মানুষগুলি তার বাইরে কি না পরিষ্কার জানতে চাই। ... এই সভার জানা দরকার যে পূর্ব পাকিস্তানে যে ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু আছেন তাঁরাও আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য তাঁরাও বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অথচ, আজ তাঁরা নৈরাশ্যের সঙ্গে দেখছেন যে দেশের একটা অংশের মানুষ স্বাধীনতার মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছেন আর অন্য অংশের মানুষ আঘাত অপমান নিপীড়ন ভোগ করছেন।’’
নেহরু মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সেদিন এই বক্তৃতা মন দিয়ে শুনেছিলেন। আমরা জানি, পরে শ্যামাপ্রসাদ পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অবর্ণনীয় দুর্দশার প্রতিবাদ জানিয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে শরণার্থীত্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়লে লক্ষ্মীকান্তও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কাশ্মীরে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুতে তিনি এতটাই আঘাত পান যে তার মাত্র একমাস পরই লক্ষ্মীকান্তের মৃত্যু হয়।
কংগ্রেসে সুভাষ-বিরোধী চক্রান্তের কট্টর সমালোচক ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ছেড়ে আসার পর তাঁর প্রস্তাবিত দলের নাম ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ রাখার পরামর্শ লক্ষ্মীকান্তই দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে যাঁরা প্রগতিশীল তাঁরাই নেতাজির নতুন দলে আসবেন ধরে নিয়ে তিনি ওইরকম নাম দিয়েছিলেন। জেলের ভিতর থেকে গভর্নরের উদ্দেশে লেখা নেতাজির ‘শেষ চিঠি’তেও লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের প্রস্তাবের উল্লেখ রয়েছে।
জন্ম পূর্ববঙ্গে হলেও পিতৃসূত্রে তিনি শান্তিপুরের ছেলে। সমাজসংস্কারে তাঁর ভূমিকা ছিল বিরাট। স্থানীয় এলাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর অবদান নদীয়া জেলাবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও একটি কারণে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষিত হলে নদীয়া জেলার একাংশে (যেমন শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ প্রভৃতি) পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিল! আজকের নদীয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল। পণ্ডিত মৈত্র তা মেনে নিতে পারেননি। এই অন্যায় সিদ্ধান্ত রদের দাবি নিয়ে তিনি একাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলিষ্ঠভাবে দরবার করেছিলেন। সারা দেশ দেখল, দ্রুততার সঙ্গে নদীয়ার আলোচ্যমান অংশটি ভারতভুক্ত হয়ে গেল। সেই অনুযায়ী ১৮ আগস্ট শান্তিপুরসহ বাকি অংশে ভারতের জাতীয় পতাকা ওঠে।
১৯৪৯ সালের ১৮ নভেম্বর ভারতের সংবিধান চূড়ান্তরূপে গৃহীত হওয়ার দিন পণ্ডিত মৈত্র গণপরিষদের অধিবেশনে এক স্মরণীয় ভাষণ দেন। তার এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই সংবিধান আমাদের লিবার্টি সুনিশ্চিত করেছে, কিন্তু লিবার্টিকে লাইসেন্সে পরিণত করার পথ বন্ধ করেছি। আজ আমাদের আত্মবিশ্নেষণ আত্মপরীক্ষার সময়। আজই, এখন থেকেই, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সংবিধানে দেওয়া ব্যবস্থাগুলি কার্যকর করা যায়। যেমন আমরা প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার দিয়েছি। কিন্তু অশিক্ষা দূর না-হলে এই ভোটাধিকার আশীর্বাদের পরিবর্তে অভিশাপ হয়ে উঠবে।’’
পণ্ডিত মৈত্রের জন্মের এই পুণ্য মুহূর্তে ভাবতে হচ্ছে না কি তাঁর দূরদর্শিতা কতখানি ছিল! ভোটসর্বস্ব সংকীর্ণ রাজনীতিতেই আমাদের সমাজজীবন অভিশপ্ত হয়ে উঠছে না কি?