বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
একটি বিধানসভার ভোটের মাঝে পুরভোট, পঞ্চায়েত ভোট, লোকসভার ভোট প্রভৃতি হচ্ছে। সেসব ভোটেও দল এবং সরকারের অস্বচ্ছ ভাবমূর্তির স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে। পরবর্তী বিধানসভার ভোটের কথা মাথায় রেখে শাসক দল এবং সরকারের সতর্ক হওয়ার কথা। তবু, দল এবং সরকারের অভ্যন্তরের বেচাল প্রভাবশালীদের কিছু করতে পারছেন না শীর্ষকর্তাটি। দলের একাংশের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে আমলাদের একটি অংশ ব্ল্যাকমেল করেন, যার অর্থ আরও বেশি বেশি দুর্নীতিতে শাসকের ডুব দেওয়া। এই অন্যায়ের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়া তো কল্পনাতীত!
ট্রাডিশন ভাঙার সাহস দেখালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮ জুন কলকাতায় পুর কাউন্সিলারদের নিয়ে দলের তরফে একটি মিটিং ডাকা হয়েছিল। তৃণমূল সুপ্রিমো কোনও রাখঢাক না-করে সেখানে চাঁচাছোলা ভাষায় নির্দেশ দেন, যাঁরা কমিশন খেয়েছেন অবিলম্বে ফেরত দিন। একইসঙ্গে দলনেত্রীর হুঁশিয়ারি ছিল, এই নির্দেশ অমান্য করলে দোষীদের দল থেকে তাড়িয়ে ছাড়বেন। তাঁর সাফ কথা, দলে চোরেদের কোনোমতেই রাখবেন না। স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম কোনও মুখ্যমন্ত্রী রাজনীতির গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসলেন না। আর্থিক দুর্নীতির প্রশ্নে তিনি প্রথম আঙুল তুললেন নিজের দলের নেতাদের বিরুদ্ধে! তিনি কি ভাবলেন না, যা বললেন রাজনীতির মঞ্চে তার গুরুত্ব কতখানি। তাঁর এই কথার ভিতর যে স্বীকারোক্তি আছে সেটাকেই হাতিয়ার করতে এবার মরিয়া হবে বিরোধীরা? ইতিমধ্যেই তৃণমূলের ভিতর থেকে বলা শুরু হয়ে গিয়েছে, দিদি এ কী করলেন! এমনকী দলের এক এমপি এজন্য বেশ ক্ষোভের সঙ্গে প্রকাশ্যে তাঁর আশঙ্কার কথাও শুনিয়েছেন।
এসব কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিটা সবসময় অন্যরকম। তিনি চ্যালেঞ্জ নিতেই পছন্দ করেন, তবে কোনও ছোটখাটো চ্যালেঞ্জ নেওয়া তাঁর ধাতে সয় না। কংগ্রেসে থাকার সময় হাইকম্যান্ডকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন নির্ভয়ে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেছেন। একাধিক ভোটে কংগ্রেস অথবা বিজেপির সঙ্গে জোট করেছেন। সেই জোট ভেঙেওছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। লোকসভায় একেবারে একা, নিঃসঙ্গও হয়েছেন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে অগ্নিবর্ষী আন্দোলন করেছেন। আমরা, সাধারণ মানুষ, প্রতিবারই ভেবে নিয়েছি, তিনি ‘ভুল’ করছেন। দলের অতি ভক্ত সমর্থকদেরও অনেকে তার অতিরিক্ত কিছু ভাবতে পারেননি। কিন্তু বাস্তবটা হল—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ফিরে এসেছেন রূপকথার পাখির মতোই!
আসলে, তাঁর আপাত ভুলগুলি সবসময়ই এক-সে-এক মাস্টার স্ট্রোক (এই উপলব্ধির কথা অতীতে একাধিকবার এই স্থানে লিখেছি)। তিনি এবার যে চ্যালেঞ্জটি নিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে তাঁর অতীতের সব চ্যালেঞ্জকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এবারেরটিও ‘আপাত ভুল’ না কি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা মিথ্যা করে দিয়ে ‘ব্লান্ডার’ হয়ে উঠবে তা দেখার জন্য আমাদের পরবর্তী বিধানসভার ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
তবে, তাঁর কৌশলী রাজনীতির ধারা বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয় যে তিনি মুখ ফসকে এত বড় কথাটি বলেননি—যাতে বিজেপির দ্রুত এগতে সুবিধা হয় কিংবা জীবন্মৃত সিপিএম একটু অক্সিজেন পেয়ে যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সচেতনভাবেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন বলে মনে হয়। পুর কাউন্সিলারদের নিয়ে ওই মিটিং ডাকার উপলক্ষ ছিল দলে শুদ্ধকরণের বার্তা দেওয়া। লোকসভার ভোটে এরাজ্যে বিজেপির বিস্ময়কর উত্থানের খবরটিই প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছে। ওইসঙ্গে চাপা পড়ে গিয়েছে আর-একটি সত্য—নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়ির মধ্যেও রাজ্যের শাসক দলের ভোট কমেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু, সেটা গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছে তৃণমূল অনেকগুলি আসন হারানোয়। ভোট-বৃদ্ধি এমপি-বৃদ্ধির নিশ্চয়তা দেয় না। এর পিছনে থাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জোট-রাজনীতির সত্য।
তবু, তৃণমূল নেত্রী দলের এই আপাত পরাজয়ের গুরুত্ব স্বীকারসহ নিশ্চয় দেখেছেন—বাংলার ২৭টি গ্রামীণ লোকসভা আসনের মধ্যে ১৫টি বিজেপি ছিনিয়ে নিয়েছে। বিজেপি যতগুলি বিধানসভা আসনে এগিয়ে গিয়েছে তার মধ্যে গ্রামীণ আসন শ’খানেক! স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে—কন্যা, ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক, প্রবীণ নাগরিক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, বেকার, সংখ্যালঘু প্রভৃতির জন্য এত যে কাজ করা হল, এত যে রাস্তাঘাট, হাসপাতাল তৈরি হল—দল সেসবের ডিভিডেন্ড পেল না কেন? অনুসন্ধান করতে গিয়ে দল জেনেছে, কাজ হয়েছে বটে ওইসঙ্গে আর্থিক দুর্নীতিও হয়েছে বিস্তর। তাতে অভিযুক্তদের একাংশ দলেরই জনপ্রতিনিধি, নেতা প্রভৃতি; আছেন সরকারি কর্মী আধিকারিকদেরও একাংশ। স্বভাবতই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—গরিবের জন্য বরাদ্দ সরকারি অর্থ নয়ছয়ের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
তাঁর রাজনীতির ধরন যাঁদের মুখস্থ তাঁরাই জানেন, এমন চ্যালেঞ্জ শুধু তাঁর পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। এটাকে যাঁরা ঘোলা জলে মাছ ধরার মওকা ভাবছেন, তাঁরা ভুলই করছেন। মানুষ কিন্তু শুধু তৃণমূলকে আতশকাচের নীচে রাখেনি, একই আতশকাচের নীচে বিজেপি এবং তার বন্ধুদেরও রেখেছে। অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টাকে মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটাকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে পারে। জবাব দেওয়ার বেলা মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে, তা এই ভোটেই সদ্য দেখেছি আমরা। অতএব, নষ্টামি করার আগে ২০২১ সালের কথাটিও সব দলকে মাথায় রাখতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অঙ্গীকার শুনিয়েছেন, তার আন্তরিকতা কিছুটা প্রমাণ করতে পারলেই বিরাট ব্যাপার। ঘোষণা কার্যকর করার সূচনা যেটা হয়েছে, ফেলনা নয়। অদূর ভবিষ্যতে কিছু রাঘব বোয়ালের সাদা কলারে টান পড়লে অবাক হবেন না।
এতে একদিকে, দলের ভিতরের গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লরা সমঝে যাবেন। অন্যদিকে, তাঁদেরকে সামনে রেখে যেসব সরকারি কর্মী-আমলা ব্ল্যাকমেল করার কূটনীতি নিয়ে চলেন, তাঁরাও জিভটা ছোট করতে বাধ্য হবেন। সে-খবর বাতাসে ভাসবেই। মানুষের চঞ্চল মন ফের তৃণমূলের দিকে ফিরতে শনি মঙ্গলবার দেখবে বলে মনে হয় না।
মনে রাখতে হবে, এবার লোকসভার ভোটে বিজেপি একজন মান্য নেতা দিতে পেরেছিল। কংগ্রেস এবং তৃতীয় শক্তির মধ্যে সেটারই অভাব ছিল এবং বিরাট। নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরোধীদের দিশাহীনতাই চওড়া তফাত গড়ে দিয়েছিল। সেই রাজপথেই নরেন্দ্র মোদির বিজয়রথ ছুটে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভার ভোটে একই পার্থক্য গড়ে দেওয়ার সামর্থ্য আছে একটিমাত্র দলের এবং একজনমাত্র নেতার। বলা বাহুল্য, নাম দু’টি হল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই, তৃণমূল সুপ্রিমো দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের চাল দেওয়ার পর বিজেপির পক্ষে যে-কোনও অসতর্ক পদক্ষেপই কিন্তু বিপজ্জনক। সবচেয়ে কাল হতে পারে তৃণমূল ত্যাগীদের বিজেপিতে নির্বিচারে অভ্যর্থনার হিড়িক। একদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মমতার লড়াই বানচাল করার ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হতে পারে। অন্যদিকে, প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে বিজেপির নীতির রাজনীতির বড়াই।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। একটি নমুনা। তাঁর খনিমন্ত্রী কে ডি মালব্য দশ হাজার টাকা দাবি করে এক শিল্পপতিকে চিঠি লিখেছিলেন, ভোটে এক দলীয় প্রার্থীর জন্য। খবর পেয়ে নেহরু ডেকে পাঠান মালব্যকে। মালব্য অভিযোগ মেনে নিতেই নেহরু বললেন, ‘‘এবার তো আপনাকে পদত্যাগপত্র দিতে হবে!’’ অগত্যা মালব্য ঘণ্টা কয়েকের ভিতর তাঁর পদত্যাগপত্র লিখে দিয়েছিলেন।
রাজনীতিকে বিস্মৃতির সেই অতল থেকে নীতির সরণিতে তুলে আনতে পারবেন কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? বঙ্গবাসী, এমনকী দেশবাসী আজ সত্যিই তৃষ্ণার্ত!