বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
নির্দয় মৃত্যু
এনসেফেলাইটিসের মহামারী বিহারে মুজফ্ফরপুরে জেলায় এখনও পর্যন্ত ১১৭টি প্রাণ নিয়েছে, এই প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম অনুসারে, ওই জেলার ১০৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সবগুলি এবং একমাত্র কমিউনিটি হেলথ সেন্টারটির রেটিং ছিল পাঁচের (৫) মধ্যে শূন্য (০)—কারণ, মূল্যায়নের জন্য যে দিকগুলির পূরণ বাধ্যতামূলক ছিল সেগুলি তারা পূরণ করেনি—যেমন মেডিক্যাল অফিসার, নার্স/মিডওয়াইফ প্রভৃতি। অসুস্থ শিশুগুলিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুজফ্ফরপুরের শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পিডিয়াট্রিক ইউনিটে, সেটি পিডিয়াট্রিক আইসিইউ হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য যেসব শর্তপূরণ হওয়া দরকার ছিল তা পূরণ করা হয়নি। এই ঘটনার দায় কে নেবেন? কেউ নেবেন না, সুতরাং আমরা দুষব ছোট সাদা সুস্বাদু ফল লিচুটাকে! ডাক্তাররা বলেছেন যেসব বাচ্চা রাতের খাবার খাবার খায়নি, লিচু খেয়ে কেবল তারাই অসুস্থ হয়েছে! এবং দয়া করে বলুন, ওই বাচ্চারা রাতের খাবার কী কারণে খায়নি? কারণ তারা গরিব এবং খাবার পায়নি। এর থেকে বড় বিপর্যয় এবং বেদনা আর কী হতে পারে? (২০০৮ থকে ২০১৪ সালের মধ্যে এনসেফেলাইটিসে মৃতের সংখ্যা ৬০০০।)
গুজরাতের ভদোদরার নিকটবর্তী এলাকার ঘটনা। দিন কয়েক আগে, একটি হোটেলের সেফটিক ট্যাঙ্ক সাফাই করতে নেমে সাতজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এই ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা এই যে প্রথম ঘটল এমন নয়, এবং পরিতাপের বিষয় যে, এটাই শেষ ঘটনা হল বলেও আশা করতে পারি না। সেফটিক ট্যাঙ্ক সাফাই কোনও রকেট সায়েন্স নয়: এই কাজের জন্য অনেক মেশিন পাওয়া যায় এবং কেরলের একটি নতুন সংস্থা এই কাজের উপযোগী একটি ইন্ডিয়ার ভার্সন মেশিনও (বন্দিকুট) বার করেছে। যখন মানুষকে দিয়ে সেফটিক ট্যাঙ্ক এবং স্যুয়ারেজ সিস্টেম সাফাই করা ছাড়া উপায় থাকে না, সেখানে বিশেষ ধরনের পোশাক, মুখোশ এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এই জরুরি সরঞ্জামগুলি দুষ্প্রাপ্য নয় এবং গুজরাতের অন্যতম ধনী জেলা ভদোদরা প্রশাসনের আর্থিক সামর্থ্যের বাইরেও নয়—তবু, সাতজন গরিব মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেওয়া হল। (২০১১-২০১৮ সালের ভিতরে ভারতের সব রাজ্যে এইরকম মৃত্যুর যতগুলি খবর নথিভুক্ত হয়েছে, তা থেকে সর্বমোট ১১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।)
হৃদয়বিদারক অবহেলা
আর-একটি অবিশ্বাস্য হৃদয়বিদারক পরিসংখ্যান হল: দিল্লিতে পথদুর্ঘটনায় রোজ গড়ে চারজনের মৃত্যু হয়। আপনি ধরে নিতে পারেন, আগামীকালও জনা-চারেক লোকের এইভাবে মৃত্যু ঘটবে। তার পরের দিন আরও চারজন মরবে। মৃত্যুর গড়পড়তা হিসেবটা এইরকমই চলতেই থাকবে। শুধু এক দিল্লিতেই এই অবস্থা। অথচ, সারা পৃথিবীতে সারা বছরে বিমানদুর্ঘটনায় মোট মৃত্যু যা ঘটে তা এর সামান্য এক ভগ্নাংশমাত্র! তা’হলে আমরা কেন বিমানভ্রমণে নিয়মের কড়াকড়ি করে সড়কপথে ভ্রমণে যত ছাড় দিয়ে বসে আছি? (২০১১-২০১৭ সালের ভিতরে দিল্লিতে পথদুর্ঘটনায় ১২,৭২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।)
আপনি কি কখনও দিল্লির বারাপুলা ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে গিয়েছেন—এটি দিল্লি সরকারের পূর্ত বিভাগের একটি ‘গর্ব’ এবং এটি নির্মাণ করতে অনেক বছর সময়ও নেওয়া হয়েছিল? ফ্লাইওভারটা গড়পড়তা—ডিজাইন এবং এর উপর দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা মিলিয়ে গড়পড়তাই—কিন্তু নির্মাণের গুণমান যদি বলেন তো জঘন্য। শুধু ফ্লাইওভারের দু’ধারের প্যারাপেটের (কিনারা বরাবর নিচু পাঁচিল) দিকে তাকান দেখবেন কী পরিমাণ ফাটল, ভেঙেচুরেও পড়ছে কোথাও কোথাও, উচ্চতাও সব জায়গায় সমান নয়, স্ল্যাবগুলি সব জায়গায় ঠিকমতো জোড় খায়নি, প্লাস্টার এবং রং যা হয়েছে সেও ভয়ানক খারাপ এবং, সব মিলিয়ে কুচ্ছিত। তার পরেও এই ফ্লাইওভার সমস্ত প্রকার কোয়ালিটি টেস্টে পাশ করেছে, ঠিকাদারকে তাঁর প্রাপ্য টাকা মেটানো হয়েছে (এবং ধরে নেওয়া যায় যে তিনি আপ্যায়িতও হয়েছেন) এবং সেটির উদ্বোধন হয়েছে ২০১০ সালে। মেরামতির জন্য এটা যে বন্ধ করে রাখতে হবে সে আর বেশিদিন নেই।
সংকল্প ও রূপায়ণ
উপরের এই ঘটনাগুলির একটিতেও—আপনি না অন্যদের কথা ভাবতে পারবেন—না বলতে পারবেন যে কোথাও নীতিগত ব্যর্থতা ছিল। প্রত্যেকটি সরকারের পলিসি হল—হাসপাতাল নির্মাণ করা, তার স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্ত দিক সাজিয়েগুছিয়ে তোলা; মানুষকে দিয়ে সাফাই (ম্যানুয়াল স্কাভেনজিং) চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া; ট্রাফিক সংক্রান্ত নিয়মকানুন বলবৎ করবে এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে; শহর নগর প্রভৃতিকে উচ্চমানের পরিকাঠামোসহ সৌন্দর্যায়ন ঘটাবে; এবং এই যুগে আরও যা যা দরকার তারা করবে।
আইনসভা অথবা এক্সিকিউটিভ (অর্থাৎ মন্ত্রীরা) নীতিপ্রণয়ন করেন এবং, স্বভাবতই, তাঁরা চান যে সেই নীতি যথাযথভাবে রূপায়িতও হবে। কিন্তু সংকল্প এবং রূপায়ণের মধ্যে ব্যবধান যেটা সে দুস্তর। কেন? এটা আমাদের বলতে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু অবশ্য করে বলাই দরকার: সরকারের (the Government with a capital G—আমরা এখানে ‘বড়’ সরকার বলব) ভিতর আর একটি সরকার (the Government with a small g—আমরা এখানে ‘ছোট’ সরকার বলব) আছে। এখানে ‘ছোট’ সরকারটি ‘বড়’ সরকারটিকে, একইসঙ্গে জনগণকে ব্যর্থ করে দিয়েছে, অনন্ত ভারতের ক্ষেত্রে কথাটি খাটে।
দু’টি বিপরীত দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এটা বোঝাতে পারি। ডিমনিটাইজেশন বা বিমুদ্রাকরণ ছিল পলিসিগত দিক থেকে এক বিরাট ভুল (পলিসি ব্লান্ডার); এমন পলিসি নিতে যেসব মন্ত্রী প্ররোচনা দিয়েছিলেন এবং তা ‘বড়’ সরকারকে দিয়ে কার্যকর করিয়েছিলেন, তার দায়টাও তাঁদের অবশ্যই নিতে হবে। অন্যদিকে, পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) একটি দারুণ পলিসি। এই জিএসটি যদি বিমুদ্রাকরণের মতোই দুর্ভোগের কারণ হয়ে থাকে তবে তার দায়টা ‘ছোট’ সরকারটির উপরেই বর্তায়।
‘স্বচ্ছ ভারত’ একটি দারুণ পলিসি, কিন্তু রাজ্যের এবং গ্রামের খোলা স্থানে শৌচকর্ম (ওডিএফ) সম্পর্কে স্টেটাস রিপোর্টে যে মিথ্যে পরিসংখ্যান প্রদান সেটা হল ‘ছোট’ সরকারের জোচ্চুরি। ‘উজ্জ্বলা’ও একটি ভালো পলিসি, কিন্তু বছরে তিনটি করে রিপ্লেসমেন্ট সিলিন্ডার দেওয়ার যে ব্যবস্থা সেটা হল ‘ছোট’ সরকারের একটি ব্যর্থতা।
আমরা কিন্তু ভোটটা দিই ‘বড়’ সরকারের কথা মাথায় রেখে। তার ভিতরে এই যে ‘ছোট’ সরকারটি তার উপরে মানুষের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। তাকে বাছাই করা ও নিয়োগ করা, তার প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, পোস্টিং, অ্যাপ্রাইজাল অথবা প্রমোশন প্রভৃতি কোনও ব্যাপারেই আমাদের করণীয় কিছু থাকে না। এইভাবে আমরা চলতে পারি না। এই ‘ছোট’ সরকারটাকে আমরা অবশ্য করে আমূল বদলে ফেলব। ঠিক যেভাবে আমরা ‘বড়’ সরকারটাকে এবং তার ভোগদখলদারদেরকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুরস্কৃত করে অথবা শাস্তি দিয়ে থাকি, আমাদের অবশ্যই একটি উপায় বার করতে হবে যাতে একইভাবে পাঁচ বছর অন্তর অথবা তারও আগে ‘ছোট’ সরকারকে এবং তার ভোগদখলদারদেরকে পুরস্কৃত করতে অথবা শাস্তি দিতে পারি।
আজ আমরা যে প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি সেটা পলিসি তৈরি সংক্রান্ত নয়। চ্যালেঞ্জটা একেবারেই হল—দক্ষতার সঙ্গে, অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের সঙ্গে এবং সুচারুরূপে পলিসির রূপায়ণ।