দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
সিবিএসই-র মত বড় পরীক্ষায় (যুগ্মভাবে) প্রথম হবার পরে স্বাভাবিক ভাবেই সংবাদ মাধ্যমের সম্মুখীন হয় উত্তর প্রদেশের মুজফ্ফরনগরের করিশমা আরোরা। এবং অবশ্যাম্ভাবী ভাবেই একটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে করিশমার দিকে—“ভবিষ্যতে কি হতে চাও তুমি?” এমন ঝকঝকে ফল করা মেয়েটি বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্রী হলে তার উত্তর ‘ডাক্তার’ কিংবা ‘ইঞ্জিনিয়ার’-এর মধ্যে ঘুরপাক খাবার সম্ভাবনাই ছিল চোদ্দ আনা। আইআইটি-র মত শীর্ষমানের প্রযুক্তির শিক্ষাকেন্দ্রে কিংবা এইমস-এর মতো চিকিৎসা-বিদ্যা শিক্ষার তাবড় প্রতিষ্ঠানে পড়বার সুযোগ পাবার জন্যে অনেকসময় বাঁধন-ছাড়া পাগলামি দেখে অভ্যস্ত আমাদের সমাজ-জীবন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরীক্ষা-সফল ছাত্রদের কাছ থেকে বিজ্ঞানের কোনও বিষয়ে গবেষণা বা পড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশের মত উত্তরও আসে বটে। ক্বচিৎ কখনও উচ্চ-পদাধিকারী সরকারি প্রশাসক (আইএএস/আইপিএস/আইএফএস) হবার ইচ্ছেও প্রকাশ করে ফেলে ছাত্রটি। আর আর্টসের ছাত্র হলে উত্তরগুলি সাধারণত গবেষক, শিক্ষক, বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি হবার ইচ্ছার মধ্যে ঘুরতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এটাই দস্তুর।
যেমন, একই সঙ্গে প্রথম হওয়া অন্য ছাত্রীটি যেমন যোগ দিতে চেয়েছে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে। প্রশাসনের উচ্চপদে আকর্ষণীয় জীবন হাতছানি দেয় নিশ্চয়ই। তবু, করিশমা আরোরা কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানায়, সে হতে চায় কত্থক ডান্সার। নৃত্যশিল্পী।
পরীক্ষায় দুর্দান্ত ফল করা এই ছাত্রগুলি তো মেধাবী, সপ্রতিভ। পৃথিবীটা এদের হাতের মুঠোয়। তারা যেখানে হাত দেবে, সোনা ফলা উচিত সেখানেই। অন্তত সেই প্রত্যয়টা তাদের মধ্যে না জাগলে তো তাদের শিক্ষাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গতানুগতিকতার ঊর্দ্ধে উঠে জীবনকে দেখা তো এদেরই মানায়। তবু প্রতি বছর যে সমস্ত মেধাবী ছেলেমেয়ে ভালো ফল করে চলে বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা প্রশাসক হওয়াটাই কি তাদের জীবনের ইচ্ছে আর উদ্দেশ্য? এতটা বুড়োটে ইচ্ছে হতে পারে বাচ্চা বাচ্চা স্কুলের ছেলেমেয়েগুলোর? একটা বছর আঠারোর স্কুলের ছেলে বা মেয়ে কতটা জানে ইঞ্জিনিয়ারের দৈনন্দিন কাজের প্রকরণ? কতটা বোঝে একজন শীর্ষ-প্রশাসকের কাজের চাপ আর দায়বদ্ধতা? কতটা উপলব্ধি করে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাজের দায়ভার? এই সমস্ত ভারী ভারী ইচ্ছেগুলি তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নয়তো? অভিভাবকের প্রত্যাশার রাঙতার মোড়কে নিজেদের ইচ্ছেগুলিকে কি মুড়িয়ে রাখছে এরা? কোথায় যায় এদের পাখি হয়ে গান গাইবার স্বপ্ন, কিংবা ফড়িং হয়ে নাচবার আকাঙ্ক্ষা? যাচ্ছেতাই এই ইচ্ছেগুলি কি আর এদের তাড়িয়ে ফেরে না? কবি হবার স্বপ্ন কি আর দেখে না আজকের ঝকঝকে কৈশোর? মঞ্চের আলো-আঁধারিতে হাজার দর্শকের সামনে অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকে না এদের কারও? এদের কেউ চাঁদের পাহাড়ে যেতে চায় না শঙ্করের মত? আঠেরো বছর বয়স মানেই যে মায়াবী স্বপ্ন, অটল প্রত্যয়, আর দুর্দমনীয় ইচ্ছা ভেসে ওঠে চোখের সামনে, সেগুলি কি বিশ্ব-সংসার থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে? ফেলুদা কিংবা ব্যোমকেশ হয়ে রহস্য সমাধানের ইচ্ছেগুলি কি শুকিয়ে গিয়েছে আজকের সমাজে?
আর দেশের অগণিত অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে বইকি। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয় না হলেও। তাদের কেউ মাস্টার, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল হতে চায়। এর মধ্যে ব্যতিক্রমী কোনও এক অমলকান্তি আবার হতে চায় একফালি রোদ্দুর। তাই সাধারণ মানের কোনও কোনও ছাত্রেরও যে এমন বেয়াড়া রকমের ইচ্ছে হবে না, তেমনটা তো নয়। তাদের কারও ছেলেবেলাতেও এমনই স্বপ্ন উঁকি মারে জোনাকি হয়ে। ইচ্ছে-ডানা উড়ে চলে সুদূর-প্রসারিত দিগন্তে। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় ভালো চাকরি, সচ্ছল রোজগারের সুযোগ বড় অল্প এই দেশে। গড়পড়তা ছেলেমেয়েদের তাই দাঁতে দাঁত চেপে সেই সীমিত সংখ্যক সুযোগের কোনও একটাকে আঁকড়ে ধরবার কৌশল আয়ত্ত্ব করবার অনুশীলন করে যেতে হয়। জীবন-ধারণের বেয়াড়া প্রয়োজনে এবং পারিপার্শ্বিকের প্রয়োজনে-প্রত্যাশায় তাদের অনেকেরই স্বপ্নগুলি ঝিমিয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে মুমূর্ষু। মারা পড়ে তাদের কৈশোরের উচ্ছ্বলতা। স্বপ্ন নিয়ে বিলাসিতা করার স্পর্ধা দেখানো কঠিন হয়ে পড়ে তাদের।
কিন্তু মেধাবী, কৈশোরের সীমান্তেই প্রায় দুনিয়া জয় করে ফেলা ছেলেমেয়েগুলোও যে কেন তাদের স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করে না, সেটাই ভাবি। তারাও যেন স্থবির সমাজের ততোধিক স্থবির মানসিকতার শরিক হয়ে পড়ে। তারই মাঝে এমন একটি মেয়ে—এক ব্যতিক্রমী মেয়ে—কতটা ধাক্কা মারতে পারে স্থবির মানসিকতার সেই প্রাচীন বন্ধ দুয়ারে? এই ব্যতিক্রমটাই কেন যে নিয়ম হয়ে ওঠে না! কত্থক নাচের তালে দুনিয়া জয় করতে চেয়েছে মেয়েটি। সেটা হল আর নাই হল, তার জীবনে ডানা-মেলা গাঙচিল হয়ে আনন্দ-আশ্চর্যের সমুদ্রে অবগাহন কে আটকায়?
এরই মাঝে আমি অবশ্য স্বপ্ন দেখি এক উজ্জ্বল সমাজের। সমাজের পরিকাঠামো আর মানসিকতার যুগ্ম উত্তরণ। কেবলমাত্র পরীক্ষা-সফল ছেলেমেয়েরাই নয়, সাধারণ মানের ছাত্র-ছাত্রীরাও সেখানে নিঃসঙ্কোচে উড়তে পারবে নিজেদের ইচ্ছে-ডানায় ভর করে। জীবিকা তাদেরকে টেনে ধরবে না। জীবন বেঁধে রাখবে না শিকল দিয়ে। প্রতিযোগিতার ইঁদুর-দৌড়ে তাদের ক্ষত-বিক্ষত হতে হবে না প্রতিনিয়ত। আর এই ওড়াটাও কিন্তু তাদের প্রতিভা সেখানে লুকিয়ে আছে বলে নয়। ডানা মেলে ওড়াতেই তাদের মুক্তি বলে। সেই ওড়াতে এক বিন্দু প্রতিভা না থাকলেও। কোনও এক স্বপ্ন-জোনাকির মোহময় আবেশে তারাও তখন হয়ে উঠবে অসাধারণ। অমলকান্তিরা যখন হবে ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের লাজুক একফালি রোদ্দুর।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত