কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
এদিকে ভোট মিটতেই আঠারোর বাদ্যি বাজিয়ে কার্যত দখল যুদ্ধে নেমে পড়েছে বিজেপি। একদিকে গেরুয়া ঢেউ আছড়ে পড়ছে রাজ্যের নানা প্রান্তে। তৃণমূলের সবুজ পার্টি অফিস রাতারাতি রং পাল্টে গেরুয়া ধারণ করছে, রং পাল্টানো নিয়ে ধস্তাধস্তি মারামারি রক্তারক্তি হচ্ছে, মন্ত্রীর সামনে আঙুল উঁচিয়ে চলছে প্রতিবাদ, গো-ব্যাক স্লোগান, পুরসভার চেয়ারম্যানের টেবিল চাপড়ে ফেটে পড়ছে জমানো ক্ষোভ, ব্যারাকপুর কাঁচরাপাড়া ভাটপাড়ায় গেরুয়া দাপটে সন্ত্রাসের তাপ ঝলসাচ্ছে, শাসক তৃণমূলের হাত ছাড়িয়ে গোটা পুরসভা চলে যাচ্ছে গেরুয়া কব্জায় এবং আরও কত কীই না হচ্ছে! সংশ্লিষ্ট এলাকায় এতদিনের প্রবল প্রতাপ তৃণমূলকেও মাঝেমধ্যে কেমন যেন একটু অসহায় অস্থির দেখাচ্ছে! অন্যদিকে, ভোটফলে অভূতপূর্ব সাফল্যের পর পদ্মদলে ‘চাণক্য’ শিরোপা পাওয়া মুকুল রায়ের কার্যক্রম নিয়েও যেন একটা কী হয় কী হয় ভাব ছড়িয়েছে। রাজ্য রাজনীতির মহলে তো বটেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও ‘এর পর কে, কোনও রথী না কোনও মহারথী’—নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। তার ওপর মুকুল রায় অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের তরফে দফায় দফায় যে সব চেতাবনি উড়ে আসছে—তৃণমূলের মন্ত্রী বিধায়ক কাউন্সিলার নেতা উপনেতা ছোটনেতাদের গেরুয়া ধারণের যে লম্বা অপেক্ষা-লিস্টের কথা বলা হচ্ছে এবং সর্বোপরি রাজ্য বিধানসভা ভোট এগিয়ে এনে পদ্মশাসন কায়েমের যে সম্ভাবনা গণপরিসরে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে রাজ্যের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বস্তরেই কৌতূহল উত্তেজনা উদ্বেগ যে ক্রমবর্ধমান তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
মানতেই হবে, এসবের সম্মিলিত চাপে যথেষ্ট অস্বস্তিতে শাসক তৃণমূলও। আর তাতে আশ্চর্যেরও কিছু নেই। বলতে কী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে এমন রাজনৈতিক আলোড়ন, শাসকের সঙ্গে এমন জোরালো টক্কর তো এককথায় সত্যিই নজিরবিহীন। মুকুল রায়ের দলভাঙানোর কৌশলও একদিক থেকে শাসকদলকে বেশ অসুবিধেয় ফেলছে। অর্জুন সিং কি তাঁর মতো কয়েকজন দল ছাড়লে এত বড় একটা দল বিশেষত যার সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জননেত্রী—তার বিশেষ কিছু যায় আসে না। বাস্তবিকই তাই। কিন্তু, বিজেপির ১৮ প্রাপ্তি ও এই দলবদলুদের উদাহরণ করে মমতা বিরোধীরা যে বোঝাতে শুরু করেছেন, এ হল তৃণমূলরাজের ওপর রাজ্যবাসীর অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ! তাঁরা এবার বিকল্প চাইছেন। এমন বোঝানোতে যাঁরা বুঝবেন তাঁদের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা যেতেই পারে। কেননা, লোকসভা ভোট এবং রাজ্য বিধানসভা ভোট যে প্রকৃতিগতভাবে আলাদা এবং দুই ক্ষেত্রে একই ভোটদাতার মানসিক বিচারবুদ্ধিও যে একভাবে কাজ করে না—সেটা অতীতে কিন্তু প্রমাণিত। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা-আবেগ ভোটে কংগ্রেসের রেকর্ড আসনে জয়ের পর অনেক বোদ্ধাই ভেবেছিলেন ১৯৮৭ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামেদের হটিয়ে ফের একবার কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াবে, ১৯৭২ সালের কলঙ্ক মুছে পশ্চিমবঙ্গে আবার কংগ্রেস-রাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়নি। ১৯৮৪ লোকসভা ভোটে পূর্ববর্তী লোকসভার ১২ আসন ও প্রায় ৫ শতাংশ ভোট খুইয়ে মাত্র ২৬ আসন এবং ৪৭.৬ পাওয়া সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামেরা ২৫১ আসন ও ৫৩ শতাংশ ভোটের বিপুল ক্ষমতা নিয়ে ফিরে এসেছিল ১৯৮৭-র বিধানসভায়! তবে, এই বোঝানোর ভবিষ্যৎ ফলটিকে সন্দেহ করতেই হয়! এবং এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, বরং সন্দেহ করে ভুল করা ভালো, সন্দেহ না করে ভুল করা মারাত্মক— এই তত্ত্ব মানাটাই বিধেয়। কেননা, মহাপুরুষেরা বলেছেন, মানুষের মন, বিচলিত হইতে কতক্ষণ!
আর এবার এ রাজ্যের লোকসভা ভোটে বিজেপির অভূতপূর্ব সাফল্যের পিছনে এই বিচলিত মন মানুষের ভূমিকা কতটা গুরুতর তা তো পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত। বিগত লোকসভার চেয়ে যে ২২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে বিজেপি আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে তার মধ্যে কটা তাঁদের নিজস্ব ভোট মানে গেরুয়া শিবিরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, কমিটেড? বুকে হাত দিয়ে কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, মুকুল রায় থেকে শুরু করে দিলীপ ঘোষ কেউই খুব জোর দিয়ে বলতে পারবেন না। বরং, সাধারণ ধারণা দাঁড়িয়েছে এই যে মূলত সিপিএমের বামমনস্ক ভোট (সিপিএমের ভোট কমেছে ২২ শতাংশ) এবং সঙ্গে কংগ্রেসের হতাশ ভোট (ভোট কমেছে ৪.৫ শতাংশ) আর তৃণমূলের সামান্য কিছু বিভ্রান্ত ভোট (তৃণমূলের ভোট ৬ শতাংশ বেড়েছে জেনেও) মিলেমিশেই ওই ২২ শতাংশের বিকাশ। অর্থাৎ, অবিজেপি ভোটে বাজিমাত করেছে বিজেপি। কিন্তু, তারপর? তারপরই শুরু হয়ে গেছে তোলপাড়। বারাকপুর, নৈহাটি, কাঁচরাপাড়া থেকে কোচবিহার জঙ্গলমহলের নানা জেলা মায় কলকাতা ও তার সন্নিহিত এলাকায় শাসক তৃণমূলের সঙ্গে সমানে সমানে শক্তি প্রদর্শনে নেমে পড়েছে গেরুয়াবাহিনী। আমাদের রাজ্যে অবশ্য, ভোট পরবর্তী এই সন্ত্রাস একটা রীতি রেওয়াজের মতো।
কিন্তু সমস্যা হল, যে নির্বাচনটা গেল সেটা দেশের সরকার গড়ার নির্বাচন এবং সেখানে যাবতীয় হিসেবপত্তর উল্টে দিয়ে প্রায় নজিরবিহীন জয় পেয়েছে বিজেপি এবং মোদিজির নেতৃত্বে দেশে একটা জবরদস্ত সরকার কায়েম করেছে। সেই সরকারে পশ্চিমবঙ্গের ১৮ আসনের অভাবিত সাফল্যও নিশ্চয়ই আলাদা সমীহ পাবে। আপাতত দু’জন মন্ত্রী ভবিষ্যতে বেড়ে যেতেও পারে সংখ্যায়। কিন্তু, এ রাজ্যে বিজেপির মূল লক্ষ্য তো বিধানসভা। নিয়ম মোতাবেক ২০২১ সালে বিধানসভার ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ হওয়ার কথা। মাঝে আছে কলকাতা সমেত রাজ্যের পুরসভাগুলোর নির্বাচন। ভোটে ভোটে সময়ের ব্যবধান রাজনৈতিক প্রস্তুতির দিক থেকে দেখলে খুব বেশি নেই। এমন পরিস্থিতিতে নবজাগ্রত বিজেপি এ রাজ্যে যে চড়া সুরে তাদের রাজনীতির তার বেঁধেছে তা ওই অবিজেপি ভোটের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে তো? বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে নৈহাটি, কাঁচরাপাড়ায় বা রাজ্যের অন্যত্র গেরুয়া নিশান ওড়ার পরে পরিস্থিতির যে অগ্নিগর্ভ রক্তঝরা সন্ত্রস্ত রূপ দেখা যাচ্ছে, তা নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের বলিষ্ঠ সূচক হিসেবে চিহ্নিত হতেই পারে কিন্তু বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষজনের কাছে নতুন দলের সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পাঠাচ্ছে তো!? মনিরুল ইসলামের মতো বিতর্কিত তৃণমূলীকে দলে নেওয়ার পর হাওড়ার বিজেপি প্রার্থী রন্তিদেব সেনগুপ্ত প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও অসন্তোষ আড়াল করেননি। ফলে, মনিরুল ইসলামের পদ্মসফর শেষপর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হল না। এতে বীরভূমের সাধারণ মানুষের কাছে একটা ভালো বার্তা হয়তো গেল। কিন্তু, সেইসঙ্গে রাজ্য বিজেপিতে মুকুল রায় বিজয়বর্গীয়দের সঙ্গে দিলীপ-রন্তিদেবদের দলীয় লাইনগত বোঝাপড়ার ঘাটতিটাও কি উঠে এল না? প্রশ্নটা কিন্তু তুলছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের আরও বক্তব্য, মনিরুলের সাম্প্রতিকে তেমন কোনও সক্রিয়তাই তো ছিল না, যা ছিল সব অতীতে ছিল। কিন্তু বর্তমানে বারাকপুর নৈহাটি ভাটপাড়ায় যা চলছে তা তো ভয়ঙ্কর! সে ব্যাপারে বিজেপি নেতৃত্ব নীরব কেন!? তাহলে কি বিজেপিতেও আসন জেতাটাই সব! পরবর্তীতে সেই জয়ের জোরে যা ইচ্ছে করা যায়!
অবিজেপি ভোটকে বিজেপিতে স্থায়ী করে আগামী বিধানসভা যুদ্ধে কিছু করে দেখাতে হলে কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব অবিলম্বে খুঁজে দিতে হবে আম জনতাকে। কেননা, বিজেপির সবচেয়ে বেশি সমর্থন মিলেছে বাম-মনস্কদের কাছ থেকে। সাধ করে তাঁরা বিজেপির বাক্স ভরাননি। ২০১৪ সালে বামেদের বাক্স ভরিয়েও (৩০ শতাংশ প্রায়) মাত্র ০২! সেই হতাশা আর চলতি সরকারের কাজকর্মে অসন্তোষ মিলেমিশে তাদের টেনেছে পদ্মে। অবিজেপি সেই ভোটকে পরের নির্বাচনগুলোতে পাশে পেতে হলে বিজেপির কর্মকাণ্ডে সংযম শান্তি ফেরাতেই হবে। মনিরুলের মতো কে দলে এল গেল তাতে মানুষ ভাবিত নয়। ভাবিত তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে যদি সন্ত্রাসের বাতাবরণ দীর্ঘস্থায়ী হয় আর তার জন্য অভিযোগের অধিকাংশ তির বিজেপির দিকে ধায় তাহলে ওই অবিজেপি মানুষজনের গেরুয়া বিশ্বাস শেষঅবধি কতদূর বজায় থাকবে তা নিয়ে রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞজনেরাও নিশ্চিত নন। এমন পরিস্থিতিতে বলতে কী, ওই বিপুল অবিজেপি ভোট ধরে রাখাটাই রাজ্যে বিজেপির কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভোট এগিয়ে এনে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে চাইছেন পদ্ম নেতৃত্বের একাংশ। অন্তত খবর তেমনই। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেবল
ভোট এগিয়ে এনে কি ওই চ্যালেঞ্জ জেতা যাবে?