পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
যেমন ভাবিয়েছে ভোটের ভারতকে। মুম্বইয়ের বাসিন্দাদের। কিন্তু দেয়ালচিত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরনে কেন সামরিক পোশাক? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কে না জানে, এবারের ভোটের শেষবেলায় এসে প্রধানমন্ত্রীর ভোট-প্রচার পুরোপুরি নিরাপত্তানির্ভর হয়ে উঠেছিল। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সেনা হত্যার পর যেদিন বালাকোটে সার্জিকাল স্ট্রাইক হল, প্রচারের অভিমুখ উন্নয়ন ও বিকাশের রাস্তা ছেড়ে সেই দিন থেকেই ধাবিত দেশের নিরাপত্তার দিকে। সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর থেকে সরাসরি ভোট চাওয়া শুরু হয়েছিল দেশের সেনাবাহিনীর নামে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তো দেশের সেনাবাহিনীকে ‘মোদির সেনা’ বলে হুঙ্কার করতেও ছাড়েননি। শিল্পী হয়তো এই কারণেই মোদিকে সেনা-পোশাকে মুড়েছেন। শিল্পীর হয়তো মনে হয়েছে, মোদির মোকাবিলায় সর্বভারতীয় স্তরে যদি কোনও দল থাকে, তা রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস। তাই মোদির বিরুদ্ধে রাহুলকে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু সেই গ্রাফিতিতে দুই নেতার দড়ি-টানাটানিতে ভারত কেন দুভাগে ভাগ? হয়তো শিল্পীমন বলতে চেয়েছে, এই দুই নেতার হাতে পড়ে দেশ ও জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে! শিল্পীমন যাই বলুক না কেন, ওই শিল্প আপনাকে ভাবাতে বাধ্য। হয়তো তাই এই গ্রাফিতি দেখেই এএফপির চিত্রসাংবাদিক ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা ঝলসে উঠেছিল। যে গ্রাফিতি অর্থ আদৌ স্পষ্ট নয়। আপনি ভাবতে পারেন আপনার মতো করেই। ভাবতে পারেন অন্য ভাবেও। আর প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে কি ভোটের ভারতে সকলের নজর এড়িয়ে মুম্বই ঢুঁ মেরেছিলেন ‘ব্যাঙ্কসি’ নিজেই?
ইতিহাস বলে, নব্বইয়ের দশকে ব্রিস্টলের কুখ্যাত বার্টন হিল এলাকার দেওয়ালগুলি ভরে যাচ্ছিল অদ্ভুত সব গ্রাফিতি দিয়ে। যেমন রঙের ব্যবহার, তেমনই অভিনব বিষয়। অন্যসব গ্রাফিতি থেকে একে সহজেই আলাদা করা যেত। গ্রাফিতিতে স্প্রের বদলে স্টেনসিলের ব্যবহার হয়তো সেই প্রথম। কেউ জানতো না, এই গ্রাফিতিগুলি কার আঁকা। তবে একটি ছদ্মনাম ব্রিস্টলের কালোজগতে সবাই জানতেন। রবিন ব্যাঙ্ক’স। নামটি দ্ব্যর্থক। ইংরেজি শব্দ রবিং যার অর্থ দাঁড়ায় ডাকাতি। আর ব্যাঙ্ক বলতে আমাদের চিরপরিচিত লেনদেনের ব্যাঙ্ককেই বোঝায়। এই রবিন ব্যাঙ্ক’স নামটিই পরে বদলাতে বদলাতে ব্যাঙ্কসিতে পরিণত হয়। ব্যাঙ্কসির আসল পরিচয় এখনও কেউ জানেন না। তবে কিছু সাক্ষাৎকার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানা যায়। যাঁর শুরুটা হয়েছিলেন ডেব্রিড ক্রুর গ্রাফিতি শিল্পীদের অংশ হিসেবে। সেই নব্বইয়ের দশকে। ব্যাঙ্কসি তখন কিশোর। সেই বয়সেই জীবনের অনেক অন্ধকার পর্ব দেখা হয়ে গিয়েছে। জন্মস্থান বার্টন হিল এলাকায় মারামারি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লেগেই থাকত। এরই মধ্যে তিনি তাঁর কাজ করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তাঁর দেখা হয় ব্রিস্টলের বিখ্যাত আলোকচিত্রী ও চিত্রপ্রদর্শনী উদ্যোক্তা স্টিভ ল্যাজারিডসের সঙ্গে। তিনি ব্যাঙ্কসির কাজের ব্যবসায়িক দিকটি প্রথম দেখতে পান। তাঁর কাজ বিক্রি করতে শুরু করেন। পরে লন্ডনেও কাজ শুরু করেন এবং অচিরেই গোটা ব্রিটেনে তাঁর কাজের তুলনা হতে থাকে জ্যঁ মিশেল বাস্কিয়াৎ এবং কিথ হ্যারিংয়ের মতো তারকা শিল্পীদের সঙ্গে। ব্যাঙ্কসির প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ হল, ১৯৯৭ সালে আঁকা একটি বড় পরিসরের দেওয়াল অঙ্কন। নাম ‘দ্য মাইল্ড মাইল্ড ওয়েস্ট’। এঁকেছিলেন ব্রিস্টলের স্টোক্স ক্রাফটে। এই ছবির উদ্দেশ্য ছিল এক আইনজীবীর বিজ্ঞাপন ঢেকে দেওয়া। বিষয় ছিল, একটি টেডি বিয়ার তিনজন পুলিসের দিকে মোলোটভ ককটেল ছুঁড়ে মারছে। ব্যাঙ্কসির কাজে এরকম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সবসময়ই লক্ষ্য করা গিয়েছে। তাঁর কাজে আবেগ ও বাস্তবতা উঠে আসে। বরাবর তাঁর কাজে উস্কানি দেন উচ্চ মধ্যবিত্ত, বিত্তশালী সমাজকে। কিন্তু কী অদ্ভুত! তাদের কাছেই তিনি উচ্চমূল্যে নিজের শিল্প বিক্রি করেন।
তিনি এখনও পর্দার আড়ালেই। তাঁর দেওয়াল চিত্র এখন ইংল্যান্ডের বাইরে ভিয়েনা, স্পেন, আমেরিকা এবং ফ্রান্সের দেওয়ালে আলোড়ন তুললেও তাঁর গোপনীয়তা রক্ষা করে ‘পেস্ট কন্ট্রোল’ নামে এক সংগঠন। যারা তাঁর কাজের সত্যতাও নিশ্চিত করে। ব্যাঙ্কসির ব্যাপারে যা জানা যায়, তার সবই তাঁরই দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। এর সত্যতা নিশ্চিত করার আপাতত কোনও উপায় নেই। বাঙ্কসি পিৎজা খেতে পছন্দ করেন, তবে পিৎজার স্বাদ বাড়াতে এর উপরে যে বিভিন্ন উপাদানের স্তর দেওয়া হয়, সেটা তিনি পছন্দ করেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়নি। তাঁর একটা সোনার দাঁত আছে। তাঁর একটা দাঁত রুপোর। আর আছে কানে একটা রুপোর মাকড়ি। তিনি একজন নৈরাজ্যবাদী, নাকি পরিবেশবাদী। যিনি এসইউভি গাড়ি নিজেই চালিয়ে ঘুরে বেড়ান এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কেউ নিশ্চিত নন, তিনি ১৯৭৮ বা ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে জন্মেছিলেন নাকি ইয়টে। তিনি একজন কসাইয়ের সন্তান বা হয়তো একজন গাড়িচালক কিংবা হাসপাতাল কর্মীর সন্তান। তিনি মোটাসোটা নাকি কঙ্কালসার। কেউ বলবেন, ব্যাঙ্কসি কাজ-পাগল, আত্মমগ্ন। কেউ আবার বলবেন, কিছুদিন ধরে তিনি লন্ডনে বাস করছেন। আর তা না হলে শোরেডিচ, তারপর হোক্সটন। সবই ধারণা! তবে কয়েকজন তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। শেষ ২০০৩ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকার সাইমন হ্যাটেনস্টোন তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। সাইমনের বর্ণনায়, ব্যাঙ্কসি দেখতে ২৮ বছরের এক শ্বেতাঙ্গ, পরনে রঙচটা জিন্স আর টি-শার্ট। তিনি নাকি দেখতে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত গানের দল ‘দ্য স্ট্রিটস’-এর মাইক স্কিনারের মতো। ২০০১ সালে স্প্রে রঙে ব্রিটেনজুড়ে তাঁর স্বাক্ষর দেখা যায়। নিজেকে তিনি ‘উপদ্রবকারী’ হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করেন।
দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলো যেহেতু ক্ষণস্থায়ী, তাই মাঝে মাঝে তিনি নিজের ছবিগুলো দিয়ে তার সঙ্গে কিছু লেখা জুড়ে বই আকারে প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম তিনটি বই হচ্ছে এক্সিসটেনসিয়ালিজম, ব্যাংগিং ইওর হেড অ্যাগেইনস্ট আ ব্রিক ওয়াল ও কাট ইট আউট। তাঁর ওয়াল অ্যান্ড পিস বইটি প্রকাশ করেছে র্যানডম হাউজ এবং বইটি আড়াই লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। মোনালিসার মুখে হলুদ রঙের একটি স্মাইলি, ক্রাইম সিন টেপ দিয়ে ঘিরে থাকা চারণভূমির ছবি তিনি ছদ্মবেশ নিয়ে টানিয়ে দিয়েছিলেন লুভ্যর ও টেট মিউজিয়ামে। সেবার নাকি ট্রেঞ্চকোট আর মুখে দাড়ি লাগিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়েছিলেন ব্যাঙ্কসি। সেই ব্যাঙ্কসি এবার ভোটের ভারতে? মুম্বইয়ের দেওয়ালে?
তাহলে কি ব্যাঙ্কসিও জানেন, এই দেশের দুর্দশার কথা। কোটি কোটি কৃষক, শ্রমিক, দলিত ও আদিবাসীদের দমিয়ে রাখা কণ্ঠস্বর? জানেন, অত্যাধুনিক দুনিয়ায় এদেশে গোমাতা, গোমূত্র দিয়ে আজও চলে ব্রেইন ওয়াশ? জানেন, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া সেনাদের বিজয় নিয়ে চলে রাজনীতির উল্লম্ফন? জানেন, ছাতি ফুলিয়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে এদেশের রাজনীতিবিদরা ভোটপ্রচারে চেঁচিয়ে বলেন ‘হামারা সেনা’, ‘ঘুস কর মারেঙ্গে’? ব্যাঙ্কসি জানেন, এ দেশের কোটি কোটি বেকার তাকিয়ে রয়েছে একটা কাজের আশায়? আর বাকিরা, কাজ হারানোর ভয়ে বিনিদ্র রাত কাটান, ঘরের কোণে দলা পাকিয়ে। হয়তো সব খোঁজ রাখেন। তাই তো এই ভোটের মরশুমে মুম্বইয়ের দেওয়াল ঝলসে ওঠে দড়ি টানাটানির লড়াই। এই প্রথম।
হয়তো আগামী দিনে গোটা দেশের দেওয়ালগুলির দখল নিয়ে ব্যাঙ্কসিও হয়ে উঠবেন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের চক্ষুশূল। ব্যাঙ্কসির এই গ্রাফিতি যে সবহারার সব পাওয়ার...! কিন্তু, ব্যাঙ্কসিকে ধরবে কে? নিউ ইয়র্কার-এর লেখক লরেন কলিনসকে ব্যাঙ্কসি বলেছিলেন, ‘নিজেকে অজ্ঞাত রাখার কিছু সমস্যা আছে। একবার আমার প্রিয় এক পাবে একটা চিত্রকর্ম দিয়েছিলাম। সেটা তারা তাদের বারের উপরে ঝুলিয়ে রেখেছিল। প্রচুর মানুষ সেই চিত্রকর্মটা নিয়ে পাবের লোকজনের কাছে প্রশ্ন করত। তাই আমি দু’বছর সেদিকে যাইনি। আসলে পত্রিকায় আপনার কাজ প্রকাশিত হওয়া একটা নির্বোধের মতো ব্যাপার, যদি আপনি অন্তত নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত অজ্ঞাত থাকতে চান। আপনি কে সেটা অন্যরা জানে না, এটা আমার কাছে ভালো লাগে। আমার খোঁজে আমার ডিলারের বাবার দোকানেও পৌঁছে গিয়েছিল ডেইলি মেলের সাংবাদিকরা। লস অ্যাঞ্জেলেসে একবার আমি রাস্তায় আঁকছিলাম, সেই সময় এক গৃহহীন তরুণ কাছে এসে বলল, আপনি কি বাঙ্কসি? পরদিনই আমি লস অ্যাঞ্জেলেস ছেড়ে চলে আসি।’
সত্যিই তো, এ যুগে সবাই যখন প্রতি মুহূর্তে বিখ্যাত হতে চান, তখন ব্যাঙ্কসির মতো নিজের পরিচয় গোপন রাখা... কঠোর অনুশীলন বটে!