কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
অবশ্য তফাৎ যে একেবারেই হয়নি এমন বলছি না। হয়েছে, নিশ্চয়ই হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলায়, তো ভোটফলের দিনের পরিবেশ বদলাবে না—তাই কখনও হয়! স্বাধীনতার পর যত দিন গিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে রেষারেষির উগ্রতা অসহিষ্ণুতা যত বেড়েছে ততই যে তার নেতিবাচক প্রভাবে ভোট উৎসবের আবহে লেগেছে হিংসা-দ্বেষ, সংশয়-বিস্ময়, আশঙ্কা-উদ্বেগের ছোঁয়া, তাতে সন্দেহ কী! ভোটের দিন ফলাফল প্রকাশের সময় ততটা না হলেও তারপর বহুক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে হিংসার বাতাবরণে ঢেকে যাচ্ছে অনেক এলাকা— আর তার জেরে ‘ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস’ বলে একটা কথা এখন দৈনন্দিন রাজনীতি থেকে সাধারণের মহল, মিডিয়া সর্বত্রই চালু হয়ে গেছে। তবে, তার আঁচ এখনও সব জায়গা সবকিছুকে গ্রাস করতে পারেনি—এই রক্ষে! সাধারণভাবে আমজনতাই বলুন, কি রাজনৈতিক শিবিরের সহিষ্ণু নেতাকর্মী—সকলেই এখনও ভোটফলের দিনটাকে আবেগ উত্তেজনায় ঠাসা একটা রাজনৈতিক উৎসবের দিন হিসেবেই দেখতে চান, দেখেনও। তার মধ্যে কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়ার চূড়ান্ত অপ্রীতিকর ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম—অন্তত আমরা তো তাই বলতে চাই। বলতে চাই এই কারণেই যে, এখনও বাংলার রাজনীতি-সচেতন মানুষ প্রতিদিনের জীবনে শান্তি সংহতিকেই অগ্রাধিকার দেন, ভোটের সময় বা ভোটফলের দিনে অনিবার্য বাড়তি উত্তাপ-উত্তেজনা সত্ত্বেও প্রত্যাশা করেন শান্তি আমন সৌহার্দ সম্প্রীতি। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে এমন কিছুতেই বলা যাবে না। মঙ্গলবার রাতেও মহানগরীর পথে সাধারণজনের মুখে শুনেছি—ভোটফলে যাই হোক, ভালো মন্দ যা-ই ঘটুক ভাই, উৎসবের মেজাজটি যেন বজায় থাকে গোটা বাংলায়। এবং আমি বলছি, এই প্রত্যাশা কেবল সাধারণ মানুষের নয়, এ রাজ্যের শাসক-বিরোধী উভয় দলের অনেক নেতাকর্মী সমর্থকেরও। তার প্রমাণও মিলছে।
বঙ্গবাসীর এই প্রত্যাশা শেষ অবধি কতটা পূরণ হবে জানি না। তবে অশান্তির ইন্ধন ছড়ানোর একটা চেষ্টা যে কিছু এলাকায় চলছে তার খবর বাতাসে ভালোমতোই উড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও নানান বিপজ্জনক উস্কানি উড়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য, আমাদের বিশ্বাস নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিস প্রশাসনের যৌথ সক্রিয়তা ও কঠোর নজরদারিতে ওই অশুভ শক্তি আজকের ভোট উৎসবে বিশেষ বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না। তবে সাবধানের মার নেই যেমন সত্যি, তেমনি মারেরও কি সাবধান আছে? বাংলার সাধারণ গেরস্ত ঘরের চিন্তাটা সেখানেই। কারণ, সকলেই বলছেন, এবারের ভোটটার রকমসকম বড় আলাদা। বড় কড়া তারে বাঁধা। দেশের ক্ষেত্রে তো বটেই, বাংলার ক্ষেত্রেও এবারের ভোটের সুর চলনবলন মোদি-মমতার ধারালো তরজায় নজিরবিহীনভাবে চড়া, মারমুখী। বাংলার ভোটের সেই চড়া সুরকে আরও চড়িয়ে দিয়েছে ভোট শেষের জনসমীক্ষার ফলগুলি। সব সমীক্ষার এক রা—মোদিজি ফিরছেন। টেনেটুনেই হোক, কি আরামসে দ্বিতীয়বারের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে চলেছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। সেই সঙ্গে আর একটা ব্যাপারেও একমত সব পোল—বাংলাতেও বাড়ছেন মোদিজি। লক্ষণীয়ভাবে বাড়ছেন। অর্থাৎ বিজেপি’র আসনগত বলবৃদ্ধি ঘটতে যাচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই এই জনসমীক্ষার ফলগুলি জাতীয় রাজনীতির বিরোধী শিবিরগুলিতে যেমন, তেমনি বাংলার শাসক তৃণমূল শিবিরেও রীতিমতো উত্তেজনার সঞ্চার করেছে। কার জন্য, কী জন্য, কার দোষে এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে কাটাছেঁড়াও শুরু হয়ে গেছে বিস্তর! সমীক্ষাগুলো যে নিতান্তই সম্ভাবনার কথা বলেছে এবং অতীতে বহুক্ষেত্রেই যে এই সম্ভাবনা বাস্তবের সঙ্গে মেলেনি— সেই সত্যটি অনেকেই যেন বিস্মৃত হয়েছেন! অথচ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মোদি-বিরোধী জাতীয় শিবিরের অনেক নেতাই ফুৎকারে ওই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ওগুলো সব বানানো। জোটবদ্ধ বিরোধীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার কৌশল। এবং সেজন্যই সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, কেসিআরের মতো খানিকটা বিগড়ে যাওয়া নেতাদের বাগে আনার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ আর তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মধ্যমণি করে দিল্লিতে বৈঠক করে জোটের একতাবদ্ধতা জোরালো করায় জোর দিয়েছেন এমনকী রাহুল গান্ধীও! অন্যদিকে, অবশ্য ওইসব সমীক্ষার ফলকে ধ্রুব এবং বাস্তব ধরে নিয়ে মঙ্গলবারই বিজেপি শিবির কার্যত একদফা বিজয়োৎসব করে নিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সংবর্ধনা দিলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, আবার প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের মন্ত্রীদের সংবর্ধনা দিলেন, এনডিএ শরিক নীতীশ কুমার, রামবিলাস বা উদ্ধব ঠাকরেও সে সংবর্ধনা থেকে বাদ গেলেন না। শুধু তাই নয়, বৈঠক করে আগামী পাঁচ বছরের কর্মসূচিও ঘোষণা করে দিলেন মোদিজি। তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রাজনাথ সিং তথ্য পরিসংখ্যান ও বিপুল অর্থ ব্যয়ের আগাম তালিকা পেশ করে জানিয়ে দিলেন, এবার অসম্ভবও সম্ভব হবে! দেশে প্রগতির গতি আরও বাড়বে।
মঙ্গলবার মোদি শিবিরের নেতামন্ত্রীদের হাবভাবে স্পষ্ট তাঁরা ধরেই নিয়েছেন—ফিরছেন। এখন এই দাবি কতটা শেষপর্যন্ত বাস্তবের সঙ্গে মিলবে তা বোঝা যাবে আজ। এই পশ্চিমবঙ্গেই বা বিজেপি ঠিক কতটা এগল ৮ থেকে ২৩-এর স্কেলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল তাও চূড়ান্ত হয়ে যাবে আজ। কিন্তু, কথা হল—এই শেষ বেলার মমতাকে সামনে রেখে কংগ্রেস সমেত বিরোধীরা যে তৎপরতা দেখাচ্ছেন তা শুরু থেকে দেখালে কি আজ পদ্মশিবির এমন হালকা মেজাজে আগাম জয়োৎসব মানাতে পারত? কে জিতত কে হারত সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না কিন্তু ছিন্নবিচ্ছিন্নভাবে লড়া বিরোধীরা যদি একজোট হয়ে (আজ যেমন ২২ দলে এককাট্টা হয়ে কমিশনে নালিশ জানাতে যাচ্ছেন) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাহুল গান্ধীকে সামনে রেখে ভোট মহাযুদ্ধে নামতেন তবে কি পরিস্থিতি মোদি শিবিরের কাছে এমন অনুকূল মনে হতো? তখনও হয়তো সমীক্ষার যাবতীয় বিচারে মোদিজি এগিয়ে থাকতেন কিন্তু তাঁর শিবির এত নিশ্চিন্ত থাকতে পারত কি না তা নিয়ে অন্তত আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। তার কারণ, একদিকে যখন মোদি-অমিত শাহের মতো দুই জবরদস্ত সেনাপতি, জোটবদ্ধ এনডিএ সেনা তখন জনতার সামনে লড়াইয়ের ময়দানে ছিল সেনাপতিহীন টুকরো টুকরো একটা সেনাপতি মুখহীন বিরোধী বাহিনী, একটা ‘ফেসলেস অপোজিশন’। দেশের মানুষ তো চরণ সিং (১৭০ দিন) চন্দ্রশেখর (২২৩ দিন) ভিপি সিং (৩৪৩ দিন) মোরারজি দেশাইয়ের (২ বছর ১২৬ দিন) মতো নেতাদের প্রধানমন্ত্রিত্ব দেখেছেন, অভিজ্ঞতায় হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, কেন্দ্রে স্থিতিশীল সরকার না থাকলে কী হয়? দুর্বল বিবদমান দল ক্ষমতায় গেলে কী হয়?
অথচ, আজ মোদি-বিরোধী শিবিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এমন ক্যারিশমাওয়ালা জননেত্রী ছিলেন, রাহুল গান্ধীর মতো তরুণতুর্কি ছিলেন। তবে, রাহুলের থেকে অনেকেই বলছেন অনেক বেশি কার্যকরী হতেন মমতা, তাঁর একরোখা লড়াকু ইমেজ, হার না মানা উন্নয়নকামী ভাবমূর্তি দেশের মানুষের কাছে অনেক বেশি মান্যতা পেত। শুধু তাই নয়, গুজরাত উন্নয়নের ‘মিথ’ যদি মোদিজিকে অমন অবলীলায় অমন অকাতর জনসমর্থনে ভাসিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতক পৌঁছে দিতে পারে, তবে আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার উন্নয়নের সাফল্যখচিত উজ্জ্বল বিজ্ঞাপনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও অনেকের চেয়ে অনেক এগিয়ে দিত না—কে বলতে পারে? কিন্তু, মহামতি বিরোধীরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার দূরে থাক সম্ভাবনাটা মূলেই খারিজ করে দিয়েছিলেন। ভোটফল বেরলে সেনাপতি (পড়ুন প্রধানমন্ত্রী) ঠিক করার আশ্চর্য প্রস্তাব শুনে সেদিন যাঁরা কংগ্রেস সভাপতি রাহুলের রাজনৈতিক উদারতার উদ্বাহু প্রশংসায় আকুল হয়েছিলেন আজ ফল প্রকাশের পর তাঁদের হাত কামড়াতে দেখলে অবাক হবেন ক’জন? তবে, বাংলায় কিন্তু লড়াইটা হয়েছে মুখের সঙ্গে মুখের, মোদি-মমতার। মিডিয়া কাগজে লোকমুখে তাই বিজেপি তৃণমূল নয় প্রাধান্য পেয়েছেন—মোদি-মমতা। ফলাফল যা-ই হোক, এখানে অন্তত মোদি-বিরোধী শিবিরে একজন সেনাপতি ছিলেন এবং তিনি বুক চিতিয়ে লড়েছেন শুরু থেকে শেষ অবধি। এটা মানতেই হবে।
তবে সে যা-ই হোক, এখন সব ভুলে প্রসঙ্গ এক ও অভিন্ন—ভোটফল ২০১৯। ভোটফলের জন্য দেশ জুড়ে প্রহর গণনা শুরু হয়ে গেছে। দশদিক জুড়ে উত্তেজনার পারদ চড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতিও যেন বাড়িয়ে চলেছে তার আগুনে তাপ! এ রাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং, মমতার ঘাসফুলের একাধিপত্যের এই পশ্চিমবাংলায় পদ্ম কতটা পাপড়ি মেলতে পারে তা দেখার জন্য বাড়তি রোমাঞ্চ এখন সর্বব্যাপ্ত। টানটান উত্তেজনা। এমন পরিস্থিতিতে ঘুরে-ফিরে আমাদের প্রত্যাশা সেই একটাই—শান্তি। ভোটের উৎসব যেন শান্তিতে শেষ হয়। ভালো মন্দ যা-ই ঘটুক উৎসবের মেজাজটি যেন বজায় থাকে। কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া যেন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থাকে। তার আঁচ যেন আর
কোথাও না ছড়ায়। তাই না?