পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
রিপোর্ট কার্ডে নির্বাচন কমিশনের প্রাপ্তি স্রেফ ‘গড়পড়তা’। আমাকে যেটা অবাক করেছে তা হল—বিভিন্ন রাজ্যের জন্য বিভিন্ন ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলব—তামিলনাড়ুতে রোড শো, গাড়ির কনভয় এবং হোর্ডিংয়ের অনুমতি ছিল না; শহর ও নগরগুলিতে পোস্টার এবং দেওয়াল লিখন নিষিদ্ধ ছিল; ব্যয়-বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা ছিলেন খামখেয়ালি; ধারণাগত ব্যয় (নোশনাল এক্সপেনডিচার) ব্যাপারটিকে একটি হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, দিল্লিতে এবং উত্তর, পশ্চিম এবং পূর্ব ভারতের নির্বাচনী কেন্দ্রগুলি বস্তুত হোর্ডিং ও পোস্টারে ছয়লাপ ছিল। রোড শো এবং সুদীর্ঘ কনভয় বের করাটাই নিয়ম ছিল। অকল্পনীয় বিপুল খরচ-খরচার বহর নজরে পড়লেও সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকদের টিকি দেখা যায়নি। আমি অবাক হচ্ছি, নিয়মকানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই যে ব্যাপক বৈষম্য—নির্বাচন কমিশন এটাকে ‘জাস্টিফাই’ করবে কীভাবে?
মিডিয়া: কোনটি?
প্রিন্ট এবং ভিস্যুয়াল মিডিয়া পক্ষ নিয়েছিল। বেশিরভাগ সরকারের পক্ষ নিয়েছিল ভয়ে অথবা ভক্তিতে—ভয়টাই মূল। কেউ কেউ বিজেপির সহযাত্রীতে পরিণত হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ মনে রাখেনি যে লোকসভার জাতীয় নির্বাচনটা হল সরকারের পাঁচ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার একটি পরীক্ষা। খুবই সামান্য সংখ্যক খবর কাগজ এবং চ্যানেল বিজেপি সরকারের সমালোচনা করার বা তাদের ‘রেকর্ড’ জনসমক্ষে তুলে ধরার সাহস দেখিয়েছে। ধন্যবাদ অনলাইন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে—দেশজুড়ে অসাধারণ বিতর্কের পরিবেশটা তারাই তৈরি করেছিল। চনমনে বিতর্কের এটাই প্রভাব যে—আবছাভাবে যেটাকে ‘আন্ডারকারেন্ট’ বলা যায়—এটাই এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করে দেবে।
সমস্ত ইস্তাহারই উপেক্ষিত হয়েছিল—এমনকী সেসবের রচয়িতারাও সেটা করেছেন; ব্যতিক্রম একটি। বিজেপির ইস্তাহারের ভিত্তিতে প্রচারে অনীহা ছিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতিগুলির কথা বারংবার প্রচারে এনেছেন, বিশেষত ‘ন্যায়’, কৃষকদের বিষয়গুলি এবং চাকরির কথা প্রতিটি জনসভায় বলেছেন।
নিরুদ্দিষ্ট ছিল অর্থনীতি
বিজেপি প্রচারের গোড়ায় ‘গিয়ার’ বদলে নিয়েছিল। ‘আচ্ছে দিন’-এর কথা ভুলক্রমেও উচ্চারিত হয়নি। ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতিগুলি বিজেপির জন্য এক বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’, পুলওয়ামা-বালাকোট এবং জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ হল স্রেফ একটা ক্রস-বর্ডার অ্যাকশন বা সীমান্ত টপকে হানা—যা দিয়ে পাকিস্তানকে কোনোরকমে নিরস্ত করা যায়নি। পুলওয়ামার ঘটনাটি হল একটি বিরাট গোয়েন্দা ব্যর্থতা ((ইন্টেলিজেন্স ফেলিয়োর)। আর, বালাকোট হল একটি রহস্যে মোড়া ব্যাপার। মোদিজির ‘জাতীয়তাবাদ’-এর যুক্তি দেশকে দু’ভাগ করেছে—‘‘আপনি কি আমার পক্ষে অথবা আপনি কি আমার বিরুদ্ধে?’’ এবং, আপনি যদি মোদিজির নীতির বিরোধী হয়ে থাকেন তবে আপনি একজন ‘জাতীয়তা-বিরোধী’ মানুষ। এই মাপকাঠিতে, ২০১৯-এ যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তাঁরা ‘জাতীয়তা-বিরোধী’ বলেই গণ্য হবেন এবং আমরা হয়ে উঠতে পারি মুখ্যত জাতীয়তা-বিরোধী একটি জাতি!
অর্থনীতি বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল—মান্য রিপোর্টগুলি এবং অফিসিয়াল তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির হতেই, কেননা তাতে সরকারের মিথ্যের ঝুলি ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছিল। যখন প্রধানমন্ত্রী প্রচার করছেন এবং অর্থমন্ত্রী ব্লগ লিখছেন তখন দেশের অর্থনীতি ডুবছে (দ্রষ্টব্য: ‘‘অর্থনীতি ‘ডেঞ্জার জোন’-এ প্রবেশ করেছে’’ শিরোনামে আমার লেখা বিশেষ নিবন্ধ/ ১৩ মে ‘বর্তমান’)। গত সপ্তাহে আরও দুঃসংবাদ ছিল। ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ ম্যানুফ্যাকচারিং গ্রোথ ছিল নেগেটিভ এবং পরের মাসেও তা ইতিবাচক হয়নি। বাজারের সূচকে সেনসেক্স এবং নিফটি টানা ন’দিন পতন রেকর্ড করেছে। ডলার-টাকার বিনিময় হার ৭০.২৬ টাকা ছুঁয়েছে। স্বচ্ছ ভারত, উজ্জ্বলা এবং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (পিএমওয়াই) থেকে মানুষের প্রাপ্তির বিষয়ে খবর-কাগজগুলি যে প্রতিবেদন ছেপেছে তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে টাইট দেওয়ার পর ভারত তেলসংকটে পড়ে গিয়েছে, এমনকী দামও বেড়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ভিতর শুল্কযুদ্ধ তীব্র হয়েছে—তার ফলে ভারতের বহির্বাণিজ্য ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জনসভায় ভাষণের মান পরিষ্কার নেমে গিয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে নেটজুড়ে এলোপাথাড়ি কুভাষা এবং অভিধা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, যেসব বক্রোক্তি বা পরোক্ষ ইঙ্গিত করা হচ্ছে তাও অসংসদীয়! ‘গণতন্ত্রের চপেটাঘাত’ আক্ষরিক অর্থে প্রধানমন্ত্রীকে চপেটাঘাতের হুমকি ছিল। একটি মহাভারতীয় চরিত্র সম্পর্কে যে পরোক্ষ ইঙ্গিত করা হয়েছিল ব্যাখ্যা করলে গালাগালি দাঁড়ায়। নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে সবই তিনি অপরাধ হিসেবে নিয়েছেন এবং ভিকটিমদের নিয়ে শিকারক্রীড়া খেলেছেন, কিন্তু বাস্তবটাকে মানেননি যে তাঁরই কারণে ভিকটিমদের এক দীর্ঘ ধ্বংসরেখা আঁকা হয়েছে।
মোদিজির নানা দিক
প্রচারের অন্তিম লগ্নে, মধ্য গ্রীষ্মে অপ্রত্যাশিতরকম মেঘ ফেটে পড়ার মতো, অপরিকল্পিত হাস্যরসবর্ষণ হল। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঋণ স্বীকার করি। প্রচারের তিক্ততা কাটিয়ে দিয়েছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তাঁর বিস্ময়কর প্রতীতিগুলি। প্রথমটা ছিল বালাকোটে আঘাত হানা নিয়ে। মোদিজি বলেছিলেন, ‘‘খারাপ আবহাওয়ার কারণে এক্সপার্টরা এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন, কিন্তু আমি বললাম যে ব্যাপক মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ এবং বৃষ্টি আমাদের পক্ষে ভালো হতে পারে, আমাদের কার্যকলাপ ওদের র্যাডারে ধরা পড়বে না। এটা আমার কাঁচা জ্ঞান। তখন আমি বললাম, পুরো মেঘাচ্ছন্ন, অতএব এগিয়ে যান আপনারা।’’
লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা স্মরণ করে মোদিজি বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করি ১৯৮৭-৮৮ নাগাদ ... আমি আদবানিজির একটি ছবি তুলেছিলাম এবং দিল্লিতে পাঠিয়েছিলাম (ট্রান্সমিটেড)। আদবানিজি তো অবাক! এবং, জিগ্যেস করেছিলেন, ‘আজ আমার রঙিন ছবি কীভাবে পাওয়া গেল?’’’
বিজ্ঞান বিষয়ে মোদিজির পরাবস্তুবাদী (সুররিয়াল) অভিজ্ঞতাগুলি নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের কৃপা। ২০১৪ সালে মোদিজি কথিত আরও একটি কাহিনী আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া হল—‘‘ভগবান আমাকে কালার মিক্সিং ও ম্যাচিংয়ের ‘সেন্স’ দিয়েছেন। যেহেতু আমি ‘গড-গিফটেড’, তাই আমি সবকিছুর ভিতর ‘ফিট’ করে যাই।’’
ভারতের নির্বাচনের উপর ভগবান নজর রেখেছেন।