নিকট বন্ধু দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা। গুরুজনের স্বাস্থ্যহানি। মামলা-মোকদ্দমায় পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে থাকবে। দাম্পত্য জীবনে ভুল বোঝাবুঝিতে ... বিশদ
সোনিয়াকে বিদেশিনী আখ্যা দিয়ে যিনি একদা কংগ্রেস ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেই শারদ পাওয়ার সম্ভবত সেদিনের মিটিংয়ে থাকছেন। বহুকাল ধরে যিনি বিজেপি’র শরিক ছিলেন, সেই চন্দ্রবাবু নাইডুও আসতে পারেন। তিনি তো নিজেই এবার বিজেপি বিরোধী জোট গঠনের জন্য জোর উদ্যোগ নিয়েছেন। কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আর যে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, তাঁদের মধ্যে আছেন ডিএমকে-র এম কে স্ট্যালিন, বিজেডির নবীন পট্টনায়েক, ওয়াইএসআর কংগ্রেসের জগন রেড্ডি, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির কে চন্দ্রশেখর রাও। এছাড়া উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী ও অখিলেশ সিং যাদবকেও কংগ্রেস জোটে পেতে ইচ্ছুক। ভোটের আগে মায়াবতী ও অখিলেশ অবশ্য মহাগঠবন্ধনে কংগ্রেসকে ঠাঁই দেননি। কিন্তু রাহুল গান্ধী সে জন্য মনে অভিমান পুষে রাখতে নারাজ।
এবারের ভোটে প্রচারপর্বে সোনিয়া ছিলেন লো প্রোফাইলে। তাঁকে জনসভায় বা রোড শো-য় দেখা যায়নি। কিন্তু ভোটের পরে তিনিই সবচেয়ে সক্রিয় হবেন মনে হচ্ছে।
কংগ্রেস যখন জোট গড়ার জন্য এত তৎপর, বিজেপি কি চুপ করে বসে থাকতে পারে?
গেরুয়া ব্রিগেডের নেতারা খুব জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, গরিষ্ঠতা পাচ্ছেনই। এমন কথাও বলছেন, গতবারের চেয়ে বেশি আসন পাবেন। কেউ বলছেন ৩০০ আসন পাবেন। অন্যদিকে আবার অমিত শাহ শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে বললেন, নতুন কোনও দল যদি এনডিএ-তে যোগ দিতে চায়, তাকে স্বাগত জানাতে তিনি তৈরি। এর আগে কৈলাস বিজয়বর্গীও একবার বলেছিলেন, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বলে কিছু হয় না। এই ধরনের মন্তব্যের একটাই মানে হয়, ভোটের আগে যারা শত্রু, ভোট ফুরলে তাদের কেউ বন্ধুও হতে পারে। বিজেপি চায় এনডিএ-তে আরও দল যুক্ত হোক। কেন চায়? তাহলে কি মোদিরাও কংগ্রেসের মতো মনে করছেন, ত্রিশঙ্কু সংসদ হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ইতিমধ্যে নতুন বন্ধু খুঁজতে শুরু করেছে। যে রাজ্যটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক এমপিকে নির্বাচিত করে, সেখানে এবার গেরুয়া পার্টির অবস্থা ভালো নয়। শোনা যাচ্ছে, তারা উত্তরপ্রদেশে গতবারের চেয়ে ২০টি আসন কম পেতে পারে। পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বুঝে বিজেপি নেতারা নাকি যোগাযোগ রাখছেন অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদলের সঙ্গে। অজিত সিং অবশ্য বিএসপি আর এসপির মহাগঠবন্ধনের শরিক। অখিলেশ আর মায়াবতী তাঁকে মোটে তিনটি আসন দিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন আরও বেশি। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাই তিনি ক্ষুব্ধ। বিজেপির আশা, প্রয়োজনে অজিত সিং তাদের পাশে দাঁড়াবেন। উত্তরপ্রদেশে জাঠদের মধ্যে তাঁর ভালো প্রভাব আছে।
অনেকের ধারণা, এনডিএ যদি সব মিলিয়ে গরিষ্ঠতা না-পায়, বিজেপি নেতারা চন্দ্রশেখর রাও, জগন রেড্ডি বা নবীন পট্টনায়েককেও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন। এমনকী ডিএমকে’র স্ট্যালিনকেও জোটে টানার চেষ্টা হতে পারে।
অর্থাৎ ভোটের ফল বেরনোর আগেই নতুন নতুন বন্ধুর খোঁজে নেমে পড়েছে দেশের দুই প্রধান দল বিজেপি ও কংগ্রেস। কার কতজন বন্ধু প্রয়োজন হবে, নির্ভর করবে ভোটের ফলের ওপরে।
ভোটে কেমন ফল হতে পারে?
এই নিয়ে নানা সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে।
একটি সম্ভাবনা হল, বিজেপি একা ২৫০ বা তার চেয়ে কিছু বেশি আসন পাবে। তাহলে আর নতুন বন্ধু প্রয়োজন হবে না। এনডিএ-তে এখন যে ক’জন শরিক আছে, তাদের নিয়েই বিজেপি সরকার গড়ে ফেলতে পারবে। ধরে নিতে হবে, মোদি বালাকোটে বিমান আক্রমণ চালিয়ে দেশবাসীকে খুশি করতে পেরেছেন। কৃষকদের দুর্দশা, বেকারত্ব, নোটবন্দি, জিএসটি-র ফলে দুর্ভোগ, এসব নিয়ে ভোটাররা মাথা ঘামাননি।
সেক্ষেত্রে মোদি ফের প্রধানমন্ত্রী হবেন। শোনা যাচ্ছে, অমিত শাহ মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন। সম্ভবত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি তাঁকে দেওয়া হবে। আরএসএস তাই চায়। কিন্তু মন্ত্রী হলে অমিত শাহ কি বিজেপির সভাপতির দায়িত্ব সামলাতে পারবেন? অবশ্য তিনি যদি ওই পদে থাকতে চান, তাহলে সঙ্ঘের আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁর বদলে অপর কে সভাপতি হতে পারেন, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরে।
বিজেপি যদি ২২০ থেকে ২৩০-এর বেশি আসন না পায়, তখন কী হবে?
এনডিএ-র শরিকরা একবাক্যে বলবে, মোদির ভুলভাল সিদ্ধান্তের জন্যই ভোটার বিমুখ হয়েছে, সুতরাং তাঁকে আর প্রধানমন্ত্রী করার দরকার নেই।
আরএসএস অবশ্য তাঁকে সরাতে চাইবে না। এই অবস্থায় অমিত শাহরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন যাতে আরও কয়েকটি দলকে তাঁদের সমর্থনে পাওয়া যায়।
বিজেপি যদি ১৪০ থেকে ১৬০-এর মধ্যে আসন পায়?
তাহলে নিশ্চিতভাবেই মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা জলাঞ্জলি যাবে। যতই নতুন বন্ধু আসুক, দিল্লিতে সরকার গড়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। বিজেপিকে বসতে হবে বিরোধী আসনে।
কংগ্রেসের দিক থেকে কী কী সম্ভাবনা আছে?
সম্ভাবনা এক: কংগ্রেস একাই ১৫০-এর বেশি আসন পেল। তার মানে ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের মতো যেসব রাজ্যে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি, সেখানে ভালো ফল করতে হবে রাহুল গান্ধীর দলকে। ধরে নিতে হবে, কংগ্রেস সভাপতি এতদিনে পরিণত রাজনীতিক হয়ে উঠেছেন। বিজেপি বিরোধী কোয়ালিশনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
সেক্ষেত্রে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন?
এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে। বিরোধী শিবিরের অনেকেই প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কংগ্রেস অবশ্য আগেই বলে রেখেছে, প্রয়োজন হলে তারা প্রধানমন্ত্রীর পদটি অন্য দলকে দিতে রাজি। কিন্তু অন্যান্য দলও সেই উদারতা দেখাবে কি না বলা শক্ত।
সম্ভাবনা দুই: কংগ্রেস ১১০ থেকে ১৩০-এর মধ্যে আসন পেল।
তাহলেও দেশের প্রাচীনতম দলটির আসন সংখ্যা হবে অবিজেপি দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তারা তখনও বিজেপি বিরোধী কোয়ালিশনে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি জানাবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, মায়াবতীর বিএসপি বা অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি রাহুলের নেতৃত্ব মানতে চাইবে কি না বলা শক্ত। যদিও ডিএমকে, আরজেডি বা ন্যাশনাল কনফারেন্সের মতো দল তখনও কংগ্রেসের পাশে দাঁড়াবে। বামপন্থীরাও হয়তো রাহুলকে সমর্থন করবে।
সম্ভাবনা তিন: কংগ্রেস ৭৫ থেকে ১০০টা আসন পেল।
তখন ধরে নিতে হবে কংগ্রেসের হাল খারাপ। গতবছর তাদের কয়েকটি রাজ্যে ভালো ফল হয়েছিল বটে কিন্তু তা থেকে জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আন্দাজ করা যায়নি। বিজেপি হারানো জমি ফিরে পেয়েছে। রাহুল গান্ধী এখনও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা নন। রাফায়েল কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রচারে ভোটাররা কান দেননি। সুতরাং রাহুলকে আরও পাঁচটি বছর সংসদে বিরোধী বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে হবে।
এমনও হতে পারে, তখন কংগ্রেস হাইকম্যান্ড রাহুলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে নবাগত প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে। দলকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর নাতনির ওপরেই বেশি ভরসা রাখবে।
২০১৯ সালে ভারতের ভোটদাতারা ঠিক কী মতপ্রকাশ করেছেন, তা জানার জন্য বৃহস্পতিবার অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আপাতত যতরকম সম্ভাবনার কথা ভাবা গিয়েছে, তার বাইরে অন্য কিছুও হতে পারে।
ভারতের ভোট রাজসূয় যজ্ঞের মতোই বৃহৎ। ভোটারের সংখ্যা ৯০ কোটি। গোটা ইউরোপ মহাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় যত লোক বাস করে, এদেশে ভোটারের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। ২০১৪ সালে ভোটের পর নির্বাচন কমিশন হিসাব দিয়েছিল, মোট ৪৬৪টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। প্রার্থী হয়েছেন মোট ৮২৫০ জন। ২০১৯ সালে প্রার্থীর সংখ্যা নিশ্চয় বেড়েছে। এইরকম একটা বিশাল ভোট প্রক্রিয়ার শেষে কী ফলাফল হতে পারে, আগে থেকে অনুমান করা দুঃসাধ্য কাজ। সে জন্য এক্সিট পোল প্রায়ই এদেশে ব্যর্থ হয়। এক্সিট পোলে দেখা যায় একরকম, ভোটের ফলাফল হয় সম্পূর্ণ আলাদা।
একটা ব্যাপার এর মধ্যেই স্পষ্ট। যে-ই ক্ষমতায় আসুক, তাকে খুব কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। গত পাঁচ বছরে কৃষকদের আয় বিশেষ বাড়েনি। তাঁরা চাইবেন নতুন সরকার কিছু সুরাহা করুক। দেশে বেকারত্ব গত কয়েক দশকের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। নোটবন্দিতে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ওইসব শিল্পেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কাজ করেন। তাঁদের অনেকে কাজ হারিয়েছেন। নতুন সরকার এলে কর্মহীনরা চাইবেন প্রচুর চাকরির সুযোগ তৈরি হোক।
আরও সমস্যা আছে। দেশের রপ্তানি কমছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। মোট জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হারও বিশেষ আশাপ্রদ নয়। মাত্র ৬.৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপি বৃদ্ধির হারকে সাত শতাংশের উপরে নিয়ে যেতেই হবে। নইলে উন্নয়নের গতি হয়ে পড়বে মন্থর।
এতগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করা খুব শক্ত কাজ।
আর একটা কথা বলার আছে। ভোটের ফলাফল যা-ই হোক, যেন শান্তি বজায় থাকে। গত এক মাসে রাজ্যের নানা জায়গায় মারপিট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকী প্রাণহানিও ঘটেছে।
তার ওপর কিছুদিন আগে কলকাতায় অমিত শাহের রোড শো-কে কেন্দ্র করে যা ঘটে গেল, তা রীতিমতো লজ্জার। বাংলার নবজাগরণের যিনি পুরোধা পুরুষ, সেই বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে হাত দিতে সাহস পেল দুষ্কৃতীরা। সেই সাতের দশকের পরে এমন কলঙ্কিত দিন রাজ্যে আর আসেনি।
পশ্চিমবঙ্গে অতীতেও রাজনৈতিক হানাহানিতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই ট্রাডিশন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।