কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
কারণ, লোকসভা ভোটযুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক রাজ্যের রাজনৈতিক বাতাবরণে একটা গুঞ্জন চলছে যে, ওই কেন্দ্রগুলোতে বিরোধীদলের প্রার্থীরা এবার জোরদার লড়াই দেবে। যাদবপুরে সিপিএম প্রার্থী বিকাশ ভট্টাচার্য, দমদমে বিজেপি’র শমীক ভট্টাচার্য কি উত্তর কলকাতায় বিজেপি’র রাহুল সিনহা নাকি এবার ভালো ভোট টানবেন। তাতে নাকি ফলাফলে এধার-ওধারও হয়ে যেতে পারে! সম্ভাবনার এই গুঞ্জনকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিকভাবেই মমতা-বিরোধী শিবির ও তার পৃষ্ঠপোষক মহলে যে কিছু ‘আশা’র সঞ্চার হয়েছে তা নির্বাচনী সভার বক্তৃতা বক্তব্য থেকে ঠারেঠোরে নেতানেত্রীরা বুঝিয়েও দিচ্ছেন। তাঁদের ওই ‘আশা’র কথায় জনমহলের একাংশের ভোট জল্পনায় কৌতূহলের নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে তা তথ্যভিজ্ঞজনেরা অনেকেই স্বীকার করছেন। ফলে আজকের ভোট মহারণে ডায়মন্ডহারবার যাদবপুর দমদমের মতো নজরকাড়া কেন্দ্রগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার বহর যে একটু বেশিই হবে, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য, সেটা এমন হাই-ভোল্টেজ ভোটযুদ্ধে একেবারে অপ্রত্যাশিতও কি? বিশেষ করে এবারের ভোটে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহের এক নম্বর টার্গেট এই পশ্চিমবঙ্গ এবং জাতীয়স্তরে দিল্লির মসনদ দখলের যুদ্ধে গেরুয়াবাহিনীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়াইয়ের ময়দান দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যে ৪২-এ ৪২ করার ডাক দিয়ে আসমুদ্র বাংলায় ঢেউ তুলে দিয়েছেন, তখন প্রতিটি আসন নিয়েই তো এমন গণকৌতূহল আগ্রহ উদ্দীপনা প্রত্যাশিত—তাই নয় কি? বাঙালি হিসেবে মা-মাটি-মানুষের নেত্রী মমতা শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর আসনে পৌঁছতে পারেন কি না তা নিয়েও তো আম-বাঙালির একটা উৎকণ্ঠা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। এবং হলফ করেই বলা যায়, এবার ফল ঘোষণার দিন বাঙালি গোটা দেশের ফলের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাবে বাংলার ফলাফল নিয়ে—৪২-এ ৪২ কতদূর সফল হল তা দেখতেই সেদিন সকাল থেকে অধীর আগ্রহ আর প্রত্যাশা নিয়ে টিভি’র সামনে বসবেন তাঁরা।
কিন্তু, তার আগে সকলেই জানতে চাইছেন—আজ কী হবে! কেমন যাবে ভোটের শেষ পর্বের দিনটা? প্রথম ছয় দফা একেবারেই ঘটনাশূন্য হয়েছে—এমন বলছেন না কেউই। এই বঙ্গের ভোটে এবারের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল ও বিজেপি’র কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সামান্য কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির মতো দুর্ভাগ্যজনক দু-একটি ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের ভোট ময়দানের পরিসর পরিধির বিশালত্ব ও যুদ্ধের তীব্রতার বিচারে সে সবকে সামান্যই বলতে হবে। এবং সেজন্যই হয়তো নির্বাচন কমিশনের কর্তারাও গত ছয় দফার নির্বাচনকে মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোকে নিতান্ত ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সত্যি বলতে কী, এবার প্রথম থেকেই বিশাল কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিসের যৌথ উদ্যোগে নিরাপত্তার বলয় যথেষ্ট আঁটোসাঁটো থাকায় বুথের ভিতরে-বাইরে সার্বিকভাবে শান্তি বজায় ছিল, মানুষ শান্তিতেই ভোট দিয়েছেন। অবশ্য, কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগও যে ওঠেনি তা নয়—তবে তা নিয়েও বড় কোনও হাঙ্গামা হয়নি। ফলে, সপ্তম দফা নিয়ে প্রথম দিকে মানুষের মধ্যে একটা নিশ্চিতিই কাজ করছিল—সকলেই ভাবছিলেন শহর মহানগরের ভোটে এবার হাঙ্গামা হুজ্জোত হবে না। মমতার পুলিস প্রশাসন এবং ভোট কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সমবেত চেষ্টায় ভোটটা শান্তিতেই হবে।
কিন্তু গত কয়েক দিনের কিছু ঘটনা মানুষের সেই বিশ্বাস যেন খানিকটা টলিয়ে দিয়েছে। চলতি ভোটযুদ্ধের শুরু থেকে প্রচারের শেষ অব্দি মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বা পদ্মদলের সভাপতি অমিত শাহের বাগ্-যুদ্ধ যাঁরা উপভোগ করছিলেন, যুদ্ধের তাপ পোহাতে পোহাতে তার ফলাফল নিয়ে তর্কবিতর্ক তরজায় মেতে ছিলেন বিদ্যাসাগরেরে মূর্তি ভাঙার ধাক্কায় উত্তাল বাংলার দিকে চেয়ে তাঁদের অনেকেই এখন রীতিমতো চিন্তায়। বিদ্যাসাগর কলেজে ঢুকে ওই মূর্তি কে ভাঙল তা নিয়ে বিতর্ক যত চড়ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নিয়ে টীকাটিপ্পনী, ক্ষোভক্রোধের ঝলকানি যত ছড়াচ্ছে তত যেন সপ্তম দফার লড়াই নিয়ে জনমনে আশঙ্কা বাড়ছে! তার ওপর রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ও কলকাতার প্রাক্তন কমিশনার রাজীব কুমারের মতো পুলিস কর্তাকে আচমকা সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পরিস্থিতি শান্ত করতে নির্বাচন কমিশন নজিরবিহীনভাবে ভোট প্রচারের সুযোগ একদিন কমিয়ে দেওয়ায় রাজনৈতিক মহলে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাবে সাধারণ জনজীবনের আশঙ্কা আরও যেন ঘনীভূত হয়েছে! অবশ্য, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। আইনের পরিধির মধ্যে থেকেই তাঁরা নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, আইনজীবী মহলের কেউ কেউ ভোট প্রচারের সময় কমিয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতাও কমিশনের সিদ্ধান্তে যে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট সেটা নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা ও গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েও বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা, ভোটপ্রচারের দিন কমানো ইত্যাদি নিয়ে রাজ্য রাজনীতির যুযুধান মহলগুলির মধ্যে উত্তেজনা যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
সে জন্য অনেকেই মনে করছেন, শেষ দফার ভোটে শান্তি বজায় রাখাই আজ কমিশনের সামনে সবচয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। কারণ, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে পরিস্থিতি এখনও যথেষ্ট উত্তপ্ত। এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে আসমুদ্রহিমাচল রাজ্যে, সমাজের সর্বস্তরে। সেই উত্তাপের আঁচ ভোটযুদ্ধের ময়দানে পৌঁছবে না এমন গ্যারান্টি কোথায়? এই আঁচ আজকের শেষ দফার ভোটে যাতে বাড়তি উত্তেজনা ছড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসন নিশ্চয়ই করবে আশা রাখি। তবে যেহেতু নির্বাচন চলাকালীন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, গুন্ডা তাণ্ডব রোখা, ভোটবাক্স ও ভোটারের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ইত্যাদির দায় পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের, সে জন্য রাজ্যের মানুষ আজ শান্তির জন্য মূলত চেয়ে থাকবেন কমিশনের সক্রিয়তার দিকে। একদিক থেকে কমিশনের কাছে এও এক পরীক্ষা। ভোটদাতা সাধারণের বিচারে এই পরীক্ষায় কমিশন কতটা উত্তীর্ণ হয় সেটাও দেখার। লক্ষণীয়, ভোট গণনা অব্দি ইভিএমের সুরক্ষা নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই অনেকবার সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁর সন্দেহ, ভোটের পর স্ট্রংরুমে রাখা ইভিএমে কারচুপি হতে পারে। এই সংশয় নিঃসন্দেহে কমিশনের কর্তাদের চাপ কিছুটা হলেও বাড়াচ্ছে। এরপর নিশ্চয়ই রাজ্যের বিভিন্ন স্ট্রংরুমে রাখা ইভিএমগুলোর জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও কঠিন জোরালো হবে।
সে না হয় হল। কিন্তু আসল প্রশ্ন—আজ কলকাতা মহানগরী থেকে বারাসত বসিরহাট মথুরাপুরের মতো মফস্সল কি গ্রামবাংলায় ভোটযুদ্ধের হাল কী দাঁড়াবে? যুদ্ধটা রাজনৈতিক আবেগ উত্তেজনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সংঘাত সংঘর্ষের চূড়ান্ত অপ্রীতিকর রক্তক্ষয়ী পথ ধরবে? খুব নিশ্চিত করে শনিবার অব্দি কেউই বলতে পারেননি। তবে, মমতা প্রশাসন ও কমিশনের ওপর মানুষ এখনও যথেষ্ট আস্থাশীল। তাঁদের বিশ্বাস, এই দুইয়ের যৌথ উদ্যোগে বিগত ছয় দফার মতো আজও শান্তিতেই শেষ
হবে এবারের লোকসভা মহারণের অন্তিম দফা। উত্তেজনার ইন্ধন জোগানো নেতানেত্রী বা গণ্ডগোল পাকানোর ‘বহিরাগত’ পাণ্ডারা বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না। এরমধ্যেই সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে পুলিস বহিরাগতদের বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে, বেহিসেবি কাঁচা টাকা ধরতে যে সক্রিয়তা দেখিয়েছে তাতে মানুষের ওই বিশ্বাস আরও জোরদার হয়েছে। শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে মানুষ যাতে আজকের ভোটের উৎসবে শামিল হতে পারেন
তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে মমতা প্রশাসনও কোথাও কোনও খামতি রাখেনি—খবর তেমনি। এরপর ভোটদেবতার মর্জি। দিনের শেষে তাঁর
প্রসন্ন আশীর্বাদ কতটুকু মিলল, ভোটযুদ্ধের
ময়দানে শেষপর্যন্ত কতটা বজায় থাকল শান্তির বাতাবরণ, চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় কতটা সাফল্য পেল কমিশন—সব বলবে সময়। আমরা
অপেক্ষায় রইলাম।