শুধু রেগে গেলে চলবে কেন? একটু বুঝতেও তো হবে। মূর্তি ভাঙা তো একটা কার্য। প্রতিটি কার্যের পিছনে একটি কারণও থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মধ্যে অনেক অবদমিত অপ্রাপ্তি ও দীর্ঘকালের ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভের আবেগকে উড়িয়ে দিলে তো হবে না। একটু সহানুভূতির সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে হবে। মূর্তিভঙ্গকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে হবে। তাদের রাগটাও তো আজকের নয়। বহুকালের। সে রাগের কোনও চটজলদি সমাধানও নেই যে কোনও একটা কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করে রাগের উপশম ঘটিয়ে ফেললাম। রাগ নানাপ্রকার। যেমন ধরা যাক, কেন আন্দামানের সেলুলার জেলে বেড়াতে গেলে দেখতে হয় বন্দি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বিরাট তালিকায় সিংহভাগই একটি মাত্র রাজ্য আর জাতির বিপ্লবীদের নাম? বেশিরভাগ বাঙালি। আধুনিক সভ্যতার আলো কেন সর্বপ্রথম বঙ্গোপসাগরের কাছের রাজ্যেই ঢুকল? ভালো করে দেশের বাকি অংশে সমাজ চেতনা ঢোকার আগেই কেন শুধু একটিমাত্র রাজ্যের একজন ব্যক্তি সতীদাহ প্রথা নিবারণে আইন আনতে বাধ্য করলেন ব্রিটিশ সরকারকে? সেই ব্যক্তিকে গোটা দেশের বাকিদের তুলনায় ব্রিটিশরা কেন বেশি বেশি ভয় পাবে, সমীহ করবে? কেন রামমোহন রায় অন্য কোনও রাজ্যে জন্মগ্রহণ করলেন না? ১৮৩৩ সালে তাঁর অকালে জীবনাবসান হল, আর তার তিন বছরের মধ্যে আবার ১৮৩৬ সালে সেই হুগলিরই কামারপুকুরে আর একজন কালজয়ী সমাজসেবী, লোকশিক্ষকের জন্ম হয়ে গেল। কই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মও তো দেশের অন্য কোথাও হতে পারতো। হল না তো! অন্তত আর কিছু না হোক জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িটা কি উত্তর ভারতে হওয়া উচিত ছিল না? রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, কেশবচন্দ্র সেন, অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষচন্দ্র বসু, ক্ষুদিরাম বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ...। অন্তহীন নাম। তাবৎ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের ঠিকানা শুধুমাত্র একটিই রাজ্য! একটি দেশ, একটি সমাজ, একটি জাতির উৎকর্ষে পৌঁছনোর জন্য যা যা দরকার সব এই বাঙালি জাতির ভাগ্যে এসেছিল। এ কী অনাচার! এই নামগুলির মধ্যে একটি নাম নিজেদের মধ্যে পেলেই যে কোনও জাতি বা রাজ্য বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত। কিন্তু এঁরা সকলেই বেছে বেছে বাঙালিই হয়েছিলেন। এসব না হয় অধুনিক যুগে। তার আগে? বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় দার্শনিক তথা সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ শ্রীচৈতন্যদেব? তিনিও এখানেই! এসবের কোনও মানে হয়? একটা এত বড় দেশের একেবারে পূর্বপ্রান্তের একটা জাতি, যাঁদের শরীরে আর্যরক্ত পর্যন্ত নেই, সেই জাতির মধ্যেই লাগাতার কয়েকশ বছর ধরে তাবৎ মেধা, শিক্ষা, বিদ্যাচর্চা, দর্শন, ধর্ম, সমাজচেতনা, নির্ভীক স্বাধীনতাকামী মন, সঙ্গীত, সাহিত্য, সংস্কৃতির শীর্ষতম ডিএনএ আর জিনের জন্ম কেন হবে? এটায় রাগ হবে না? বিধাতার এই চরম পক্ষপাতে ক্ষোভ আসা কি একান্তই অবাস্তব? এত বড় একটা দেশের মধ্যে জোব চার্ণক আর জায়গা পেলেন না এটা বিশ্বাস করতে হবে? সেই ১৬৯০ সালে ভারতে আর একটিও শহর ছিল না যে বেছে বেছে এই তিনটি গ্রাম নিয়ে তৈরি একটা জনপদে এসে নৌকা ভিড়িয়ে নগর নির্মাণ করে আধুনিক পৃথিবীর আলো নিয়ে আসতে হবে এই একটি রাজ্যেই প্রথম? কেন? কেন শুধু এই রাজ্যের লোকগুলোই ইংরেজি শিখে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার তাবৎ উচ্চপদে কর্ম পেলেন? নাগপুর থেকে বিলাসপুর রেলের অফিসার কর্মী কারা হয়ে গিয়েছিল? কেন এই শহরের এলগিন রোডের এক যুবক আইসিএস পরীক্ষায় হেলায় চতুর্থ স্থান পেয়ে চরম উৎকর্ষের পেশায় উত্তীর্ণ হয়েও নির্লিপ্তভাবে সেই চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার সাহস দেখাবেন? বাকিরা ছাড়বে কি আগে তো আইসিএসে ফোর্থ হতে হবে? আর সেই যুবকই সমস্ত রকম নিরাপত্তার বলয় ছেড়ে অজানা সংগ্রামের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নিজস্ব এক সেনা বাহিনী গড়ে ব্রিটিশের প্রাণে ভয় ধরিয়ে চিররহস্যের আড়ালে চলে গিয়ে গোটা দেশের কাছে এক সর্বকালীন হিরো হয়ে রইলেন। অন্যরা যেখানে একটা পায় না, সেখানে কেন একটা জাতি থেকেই একাধিকবার নোবেল পাবে? তাও আবার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সেগমেন্টে! সাহিত্যেও পাবে একই জাতি নোবেল! আবার অর্থনীতিতেও পাবে? এটা আবার কেমন বিচার? আবার দেখুন মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কী দোষ করেছে, যে এই রাজ্যের টালিগঞ্জ পাড়ার কোনও এক ভদ্রলোককে লাইভ টাইম অ্যাচিভমেন্টের অস্কার পুরস্কার দেওয়া হবে? দেশের আর কোথায় সিনেমা হয় না নাকি? একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় গান দুটো করা হল। খুব ভালো কথা। কিন্তু এটা কি ঠিক হল যে বাকি সব রাজ্যের সব কবি সাহিত্যিকের গানকে ছেড়ে একটি ভাষারই দুই সাহিত্যিকের দু’টি গান বেছে নেওয়া হবে? জাতীয় সঙ্গীতও বাঙালির রচনা! আবার জাতীয় গানও বাঙালির রচনা? এটা দেখে যদি ক্ষোভ হয় সেটা কি একান্তই অপরাধ হবে? গোটা দেশকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র একটা রাজ্যেই কেন নবজাগরণ হল? নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, আধুনিক শিক্ষার প্রচলন কে করলেন? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁকে কি তাহলে ভারতীয় সভ্যতার বিরোধী আখ্যা দিয়ে পশ্চিমি সভ্যতার কাছে সমর্পণকারী হিসেবে তকমা দেওয়া যাবে? তাও তো সম্ভব নয়। সেটাই তো মহা মুশকিল। কারণ এই ব্রাহ্মণ সন্তান তো সংস্কৃত শাস্ত্রে সাংঘাতিক বিশেষজ্ঞ। আবার সেই তিনিই পশ্চিমি শিক্ষাকে সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন। এরকম এক উদার পথপ্রদর্শক গোটা দেশের মধ্যে বাঙালিই পেয়েছে।
নবজাগরণের ঐতিহ্য এই জাতিকে যে জিনিসটি প্রদান করেছিল সেগুলি নিছক শিল্পলগ্নি নয় যে ইচ্ছে করলেই রাজ্যে জমি দিয়ে নিয়ে আসা যায়। সেগুলি এমন এক বস্তু যা টাকা দিয়েও কেনা যায় না। ভোটে জিতেও আয়ত্ত করা যায় না। সংস্কৃতি, চেতনা, তীক্ষ্ণ জীবনদর্শন আর চরম উৎকর্ষের চিন্তাশীলতা। একটা নিয়ম হল, যে সম্পদ সহজে আহরণ করা যায় না সেটি যাঁদের আছে তাঁদের প্রতি গোপন বিদ্বেষ তৈরি হয়। স্বাভাবিক। যা আমার করায়ত্ত হবে না সেটিকে ধ্বংস করতে পারলে মনের আরাম হয়, ক্ষোভের উপশম হয়। বিদ্যাসাগরকে আঘাত করার কারণ হল তিনি মানবজীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি আলো জ্বালার দিশারী। সেটি হল শিক্ষা। কেন তাঁকে অপছন্দ একটি বিশেষ অংশের? তার কারণটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারিত্রপূজা নামক প্রবন্ধাবলীর অন্যতম ‘বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক রচনায় পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘দয়া প্রভৃতি গুণ অনেকের মধ্যে সচরাচর দেখা যায়, কিন্তু চারিত্রবল আমাদের দেশে সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয় না। যারা সবলচরিত্র, যাদের চারিত্রবল কেবলমাত্র ধর্মবুদ্ধিগত নয় কিন্তু মানসিক বুদ্ধিগত, সেই প্রবলেরা অতীতের বিধিনিষেধে অবরুদ্ধ হয়ে নিঃশব্দে নিস্তেজ হয়ে থাকেন না। ... যাঁরা অতীতের জড় বাধা লঙ্ঘন করে দেশের চিত্তকে ভবিষ্যতের পরম সার্থকতার দিকে বহন করে নিয়ে যাবার সারথির স্বরূপ, বিদ্যাসাগরমহাশয়, সেই মহারথীগণের একজন অগ্রগণ্য ছিলেন ...।’’ রবীন্দ্রনাথ বারংবার একাধিক রচনায় বিদ্যাসাগরের সবথেকে বড় যে গুণের প্রতি নিজের মুগ্ধতা ব্যক্ত করেছেন সেটি হল সমাজের উন্নতির জন্য বিদ্যসাগরের নির্ভীকতা আর আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সামাজিক ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে, চ্যালেঞ্জ করে তাঁর বিদ্রোহ। আত্মচেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি আর জীবনদর্শন। এই চারটি উপলব্ধি যদি কোনও জাতির ধ্বংস করা যায়, তাহলে আর তার নিজস্বতা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
বাঙালিকে হীনবল করার সবথেকে সহজ পন্থা হল বাঙালিত্বকেই হরণ করে নেওয়া। একবার কাজটি সম্পন্ন করা হলে শুধু নামের পাশে বাঙালি বাঙালি দেখতে পদবিটি থাকে। কিন্তু, মননে আর সে বাঙালি থাকে না। তাই বিদ্যাসাগরের মূর্তি কোন দল ভেঙেছে অথবা মূর্তিভঙ্গকারীদের পদবি কী সেটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভিতর থেকে ভাঙা হয়েছে না কি বাইরে থেকে এসে ভাঙা হল, এসব রাজনৈতিক তরজাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাৎপর্যপূর্ণ হল যে বা যারা ভেঙেছে তারা আদতে বাঙালি জাতির শত্রু। বাংলার ইতিহাসের শত্রু। চেতনার শত্রু। কারণ এই মনীষীদের প্রদান করা উৎকর্ষ আমাদের নেই, তাই এঁদের ধ্বংস করো। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি চেতনার জন্মদাতাকেই ভুলুণ্ঠিত করার যে কাজটি সমাধা হল সেটি নিছক প্রতীকী। আসলে ওটাই লক্ষ্য। একটা লিটমাস টেস্ট বলা যেতে পারে। এভাবে যাচাই করে দেখে নেওয়া সম্ভব সত্যিই এই জাতির কতটা আত্মসম্মান আর বাকি আছে। যদি দেখা যায় কই ,কিছু ইতিউতি প্রতিবাদ মিছিল, ধিক্কার সভা কিংবা গণস্বাক্ষর জাতীয় নরম নরম নিন্দামন্দ ছাড়া মোটামুটি বাঙালির সিংহভাগই নির্লিপ্তই রয়েছে, বরং অনেকে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও করছে, তাহলে বুঝতে হবে বাঙালিত্ব হরণের অপারেশন যথেষ্ট সফলভাবে হচ্ছে। ধর্মীয়ভাবে, সংস্কৃতিগতভাবে, আচরণগতভাবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা বিদ্যাসাগর মেলা, রবীন্দ্রজয়ন্তী, কল্পতরু উৎসবদের আমাদের জীবনযাপনের জন্য দরকারি মনে করছি? না কি করছি না! যদি প্রয়োজনীয় মনে না করি, তাহলে বাহ্যিক ক্ষতি কিছুই নেই। টাকা রোজগার কম হবে না, নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস চলবে, বেঁচে থাকব সুস্বাস্থ্য আর আইপিএল নিয়ে। শুধু দু’টি জিনিস চিরতরে থাকবে না। আইডেন্টিটি আর স্বাজাত্যবোধের আত্মসম্মান! সিদ্ধান্ত আমাদের!