বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
বিশেষ করে বিষয় যখন দেশের ক্ষমতা দখলের ভোট-মহারণ সঙ্গে বাংলায় জোড়া ফুলের ৪২-এ ৪২-এর ডাক, আর সে মহাসংগ্রামে দুই প্রধান প্রতিপক্ষের নাম মোদি-মমতা— তখন পায় কে! একেবারে রসিয়ে কষিয়ে গরমে নরমে যুক্তি অযুক্তি কুযুক্তির কড়া পাকে পাহাড় থেকে সাগর জঙ্গলমহল থেকে যাদবপুর যাকে বলে জল্পনা-কল্পনার একটা উৎসবই যেন শুরু হয়ে গেছে। এবং এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো দেশের বাকি রাজ্যগুলির চেয়ে এগিয়ে বাংলা সবার আগে সবচেয়ে মুখর সন্দেহ নেই। হবে নাই বা কেন? আজও এই পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে অন্যতম রাজনীতি সচেতন রাজ্য বলে, দেশ রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান বলে স্বীকৃত। সেখানে ভোট মহাযুদ্ধের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ পোলিটিক্যাল ইভেন্ট হয়ে যাবে আর পাবলিক চুপ করে বসে থাকবে—তাই কি হয়! তারওপর দেশের বিদায়ী শাসকের এবার বাড়তি নজর পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংখ্যার হিসেবে এই রাজ্যেই সর্বাধিক নির্বাচনী সভা করছেন—১৯টি, গড়ে প্রতি দফায় আড়াইখানারও বেশি! ফলে, সকলেই বুঝেছেন—এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য জাতীয় রাজনীতিতে যেমন তেমনি মোদিজির এই অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের জন্য দেশের ভোটযুদ্ধের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান বিশেষ মাত্রা পাচ্ছে। তার ওপর মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে বাঙালি হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে দেখার স্বপ্ন তো আছেই।
সব মিলিয়ে এবার দেশের ভোটের পাশাপাশি বাংলার ভোটও তাই জনতার আগ্রহ কৌতূহলের কেন্দ্রে। আর সেই সূত্রেই ২৩-এর অপেক্ষায় না থেকে বাংলার জনমন জল্পনা-কল্পনার জমজমাট উৎসবে পুরোপুরি মজে গেছে। কী হতে পারে তার একটা পাকাপোক্ত হিসেব এখন আমবাঙালির মুখে মুখে। এবং সাত দফার মহাযুক্ত যত অন্তিম পর্বের দিকে এগচ্ছে তত যেন রাজনৈতিক মহলের বড়-মেজ-ছোট কর্তা থেকে কর্মচারী মহাজনদের মধ্যেও এই কল্পনার উৎসবে শামিল হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তিন-পাঁচজনের জটলা হলেই হল—শুরু হয়ে যাচ্ছে যুক্তি প্রতিযুক্তির ধুন্ধুমার। আলাপ-আলোনার ঢেউ ছাপিয়ে উত্তেজনার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ফণী পাশ কাটিয়ে বাংলা বাঁচিয়ে উড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু যাওয়ার পথে যে কড়া তাপপ্রবাহ ছেড়ে গেছে তাতে এখন জেরবার বাংলার মানুষজন। ৪০ ডিগ্রি ছুঁতে চলেছে কলকাতা মহানগরী! ইতিমধ্যেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মতো জেলাগুলি আগুনঝরা রোদে ঝামলা পোড়া হচ্ছে। কালবৈশাখী দূরে থাক সামান্য মেঘের রেখাও নেই নির্মম নীলে! তাতেও কিছুমাত্র ভাবান্তর নেই বাঙালির। তাঁদের বিশ্বাস এবং তর্কের যুগলবন্দি অব্যাহত। প্রধান জল্পনায় অবশ্যই বিজেপি। কেন্দ্রে শক্তিক্ষয়, রাজ্যে শক্তিবৃদ্ধি ঘটবে মোদিজির বিজেপি’র নাকি নেত্রী মমতার দাবিমতো বাংলায় ৪২-এ ৪২ হবে, ঘাসফুলে ভরে যাবে আসমুদ্রহিমাচল—তাই নিয়ে সম্ভাবনার বিচিত্র জল্পনায় মুখর বঙ্গ।
পথেঘাটে অফিস কাছারিতে দোকানে বাজারে মায় সেলুনে অব্দি এখন জল্পনার ভিড়। নানান প্রশ্ন আর উত্তরে সরগরম জনতা। তাঁদের কথা চালাচালিতে ছয় দফা শেষে যেটা উঠে আসছে তাতে এ রাজ্যে অন্তত বিজেপি’র আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, আম পাবলিকের বোধ বিশ্বাসে এ রাজ্যে বিজেপি’র সিট প্রাপ্তির অঙ্ক ৭/৮ থেকে ১৭/১৮ ওঠানামা করছে। অবশ্য, পদ্মদলের প্রধান সেনাপতি অমিত শাহজি অনেক আগেই ২৩ আসনের দাবি রেখে গিয়েছেন, এখনও রাখছেন। এখন ঠারেঠোরে আরও বেশির দিকেই তাঁর ইঙ্গিত! এই ইঙ্গিত বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা জানে ২৩ মে। কিন্তু জনতার দাবি—এতটা না হলেও এবার এ রাজ্যে বিজেপি বেশ ভালো ভোট টানবে এবং বেশ কিছু আসন ছিনিয়ে নেবে। সংখ্যাটা কত তা তো আগেই বলেছি।
কেন এমন ধারণা পাবলিকের? কারণ, তাঁরা মনে করছেন—সিপিএমের সমর্থক কর্মীদের একটা বড় অংশ এবার বিজেপি’র দিকে ভোট করবে। কারণ, তাঁরা নাকি ভাবছেন সামনে মমতা থাকলে পার্টির পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ মুশকিল। মমতার নজিরবিহীন ভাবমূর্তি, উন্নয়ন এবং সর্বোপরি তাঁর অবিসংবাদী প্রভাব অতিক্রম করে বামেদের পক্ষে রাজ্যের ক্ষমতা দখল কখনওই সহজ হবে না। মমতা প্রতিপক্ষ হলেই নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর নেতাই কেশপুর জঙ্গলমহল সব উঠে আসে, আসবে। উঠে আসবে ২১ জুলাইয়ের সেই রক্তাক্ত কলকাতা, পার্টির ডান্ডায় মাথা ফেটে মরণাপন্ন মমতার ছবি! পাশাপাশি আজকের বিশ্ববাংলা পশ্চিমবঙ্গ ও তার সর্বাত্মক উন্নয়নের দৃষ্টান্তগুলিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ধ্বজা হয়ে রাজ্যবাসীর সামনে এসে দাঁড়াবে, দাঁড়াচ্ছে। রাজ্যের বাম শিবিরে এইসব কঠিন বাধা অতিক্রম করার মতো জোরালো নেতৃত্ব থাকলেও তাঁদের অধিকাংশই আজ বয়সের ভারে অনেকটাই স্তিমিত। বিমান বসু সূর্যকান্ত মিশ্রের মতো প্রবীণ নেতাকে তাই উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ছুটে বেড়াতে হয়। কিন্তু, নন্দিনী মুখোপাধ্যায় কনীনিকা ঘোষ, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা শতরূপের মতো সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাঁদের জায়গা নেওয়ার মতো যোগ্য উত্তরসূরির দেখা নেই আজও। কবে দেখা মিলবে তাও অজানা।এই পরিস্থিতিতে ‘দক্ষিণপন্থী’ গেরুয়া শিবিরকে যদি ভবিষ্যতে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করা যায় তবে একটা ভালো সুযোগ থাকবে। দক্ষিণ-বামে লড়াই হলে মাইনাস পয়েন্টের বিচারটা হয়তো জনতার আদালতে পাল্টে যাবে। কারণ, বাংলা সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে অনেক সহিষ্ণু ও ধর্মীয় সংহতিতে অনেক বেশি উৎসাহী। সেক্ষেত্রে পদ্মশিবিরের চেয়ে তখন তাঁদের কাছে বামেরা মূল্য পাবে বেশি। তার ওপর ইউপি ত্রিপুরার মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির পরিস্থিতি তুলে ধরে জনতার সহানুভূতি আদায়েও বাড়তি সুবিধা মিলতে পারে। সেইদিক বিচারেই নাকি এবার বামের ভোটে রামের ঝুলি ভরবে! এটা জনতার জল্পনা। একটু কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। অর্জুন সিং, লকেট চ্যাটার্জিদের মতো অনেকের ভাগ্যই নাকি এই জল্পনায় জড়িত! এই জল্পনায় শামিল হয়ে শেষ লোকসভা ভোটের প্রায় ৩০ শতাংশ বাম ভোটের (২০১৬ বিধানসভায় যা নেমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি) একটা অংশ যদি পদ্মদলের বাক্সে পড়ে তবে বেশ কিছু আসনে যে তৃণমূল চাপে পড়বে তাতে সন্দেহ কী? আর একটি অভিমতও ঘুরছে—যাঁদের জেতার সম্ভাবনা কম তাঁদের দিয়ে ভোট ‘নষ্ট’ করতেও এবার নাকি অনীহা অনেকের। নোটার চেয়ে এবার জয়ের সম্ভাবনাযুক্ত পক্ষে প্রতিপক্ষেই আগ্রহ বেশি জনগণেশের! এই মানসিকতার হদিশও মিলছে। লোকে বলছেন এমন কথা। এতে লাভের ভাঁড়ার সেই তৃণমূল বিজেপিতেই ভাগাভাগি হচ্ছে—জনতার মতে এ রাজ্যে লড়াইটা ওই দুই দলেই। বাকিরা সামান্য দু-একটি আসন ছাড়া ভোট মহাযুদ্ধের ময়দানে বাজনদার মাত্র। সারা দেশে আসন সংখ্যার নিরিখে বিজেপি কতটা শক্তি হারাবে তা সময় বলবে, তবে এ রাজ্যে তৃণমূল বিরোধীদের মধ্যে ‘জয়ের সম্ভাবনাযুক্ত’ প্রার্থীতালিকায় তাদের অগ্রাধিকার যে সর্বাধিক মান্যতা পাবে তা রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলছেন। এক্ষেত্রেও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের মতো এক-আধজন ব্যতিক্রম হতে পারেন—এই যা। সব মিলিয়ে রাজ্যের আমজনতার এই জল্পনা-কল্পনা বুঝিয়ে দিচ্ছে—এবার ২৩ মে বিজেপির পক্ষে ভালো দিন হতে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো এক ধাপ চড়িয়ে ২০০৯ সালের ভোটফল টেনে আনছেন। বোঝাই যাচ্ছে এতক্ষণ যাদের মন্তব্য হিসেব-নিকেশ নিয়ে কথা হল—তারা সকলেই মন মানসিকতায় মমতা বিরোধী শিবিরের প্রতিনিধি। তাতে যে বর্তমান শাসকদলের কেউ নেই—এমন অবশ্য হলফ করে বলা যায় না। ধান্দাবাজ সবসময় ছিল আজও আছে—তৃণমূলেও আছে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় এরা ‘গদ্দার’। তথ্যভিজ্ঞদের মতে, এই ‘গদ্দার’দের ভূমিকাও এবারের ভোটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। কিন্তু, এইসব জল্পনায় শেষপর্যন্ত বাংলার ভোটদেবতা শেষ অব্দি কতটা বিচলিত হবেন, তাঁর প্রসন্নতা কার প্রতি অধিক বর্ষিত হবে—সত্যি বলতে কী কেউ জানে না। তবে, বিজেপি যে দেশের অন্যত্র শক্তিক্ষয়ের ক্ষত পশ্চিমবঙ্গ সমেত পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে ভরিয়ে নিতে চাইছে সেটা পরিষ্কার। সে জন্যই এবার মোদিজি অমিতজির এত সভা বাংলায়, পদ্মদলের পাখির চোখ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ। তবে, মজাটা হল এই যে দেশে বিজেপি’র সামগ্রিক শক্তি হারানোর অনেক অঙ্ক পাওয়া যাচ্ছে বটে কিন্তু বাংলার ভোটে শক্তিবৃদ্ধির তেমন নিশ্চিত অঙ্ক এখনও মিলছে না। মোদিজি অমিত শাহ থেকে আম পাবলিক—সকলের সব হিসেবনিকেশ ৮/১০ থেকে ২২/২৩ যেন সেই একজনের সামনে এসে কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে ফেলছে খেই! বলা বাহুল্য, তিনি মমতা! তাঁর সামনে তাই যেন যাবতীয় জল্পনা-কল্পনার স্রোত প্রতিস্রোত উহ্য করে ৪২-এ ৪২-ও অসম্ভবের সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লোকেই বলছে, হতেই পারে। নামে ৪২ ক্যান্ডিডেট কিন্তু প্রার্থী তো একজনই—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুতরাং, হতেই পারে। দেখুন কল্পনার বাহাদুরি না বাস্তবের রসায়ন—বাংলার ভোট-রাজনীতির মহারণাঙ্গনে ২৩ মে শেষে বিজয় শঙ্খ কে বাজায়। দেখা যাক।