শরীর-স্বাস্থ্যের আকস্মিক অবনতি। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসতে পারে। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদ, ব্যবসায় নতুন সুযোগ ... বিশদ
কিন্তু, কথা হল—দেশ বাঁচানোর লড়াই খেলার মাঠে মান রক্ষার লড়াই আর ভোট জয়ের লড়াইতে আক্রমণের তরিকা কি এক হতে পারে? দেশ রক্ষার লড়াইতে গোলাগুলি সেনা আধাসেনা অপরিহার্য। বাংলাদেশ কার্গিল যুদ্ধ বা সাম্প্রতিক সার্জিকাল স্ট্রাইকের সময় বাহিনী বা সরকারের তরফে ভারতীয় সেনার শক্তিক্ষমতা বাহাদুরির বিশেষ প্রচার করা হয়েছে এবং তাতে বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়তি দৃঢ়তা পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, ভাবুন, ক্রিকেট বিশ্বযুদ্ধের মহামঞ্চ থেকে বিরাট কোহলির মতো কেউ যদি ঘোষণা করে বসেন, এবার কাউকে মাঠে দাঁত ফোটাতে দেওয়া হবে না। সারা মাঠ ঘিরে রাখবে আমাদের মহাশক্তিমান সেনা আধাসেনা! আর বোলারদের বলব সব বল যেন ব্যাটসম্যানের মাথা লক্ষ্য করে যায়, উইকেট লক্ষ্য করে নয়। আমাদের জয়ের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের সবাইকে খাটিয়ায় করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে... ইত্যাদি ইত্যাদি—তাহলে কি কেউ স্বাভাবিক বলবেন!? না এমন একটি অবাস্তব অসম্ভবের কল্পনায় প্রাণখোলা হাসিতে লুটোপুটি খাবেন!? বলা বাহুল্য হেসে লুটোবেন। কারণ, কে না জানেন, খেলাযুদ্ধের মাঠে কোহলিরা তাঁদের অসামান্য দক্ষতা ও ক্রীড়া কৌশলের গুণেই সেরার শিরোপা, জনমন জিতে নেন। এবং পরবর্তী জয়ের লক্ষ্যে অপরিসীম অধ্যবসায়বলে সেই দক্ষতা ও কৌশলশক্তিকে তাঁরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেন। তাই মাঠের খেলাযুদ্ধে জয়ের জন্য তাঁদের অন্য কোনও শক্তির সহায়তা লাগে না।
ভোটযুদ্ধ কি ওই খেলাযুদ্ধের চেয়ে খুব দূরবর্তী? তাই কি? অনেকে হয়তো বলবেন, রাজনীতি খেলার চেয়ে হয়তো অনেক কঠিন জটিল এবং কৌশলী। অনেক সিরিয়াস। এই রাজনীতির মধ্য দিয়েই উঠে আসেন দেশ রাজ্যের পরিচালকেরা। ভোটযুদ্ধ সেই পরিচালকদের নির্বাচনের মাধ্যম। দেশজনতা এক্ষেত্রে শুধু দর্শক নয়—নির্বাচক। তাঁদের সমর্থন আনুকূল্য পাওয়ার লড়াই ভোটযুদ্ধ। সুতরাং, মাঠের এগারো জনের লড়াইয়ের চেয়ে তাঁদের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু, যাঁরা এ কথা বলেন তাঁরা কি অস্বীকার করতে পারেন—মাঠের ওই এগারো জন এবং মাঠের বাইরে বসে থাকা তাঁদের আরও তিন সতীর্থ অর্থাৎ চোদ্দো জনও কোনও নির্বাচক মণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত এবং দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে প্রথম এগারোয় নির্বাচিত হওয়াটাও কম বড় যুদ্ধ নয়! শুধু তাই নয়, এই নির্বাচনের পরও রেহাই নেই—পারফর্মেন্স ধরে রাখতে কঠোর অনুশাসনে বছরের পর বছর যে লড়াই—তাও কি সাধনার চেয়ে কম কিছু? রাজনীতির ভোটযুদ্ধে জিতলে তো পাঁচ বছর নিশ্চিন্ত—চাইলে নির্বিকল্প সমাধিতেও চলে যাওয়া যায়! কতজনই তো এমন সুনামে নামী হয়েছেন অতীত বর্তমানে। ভবিষ্যতেও হবেন। সেদিক থেকে কি প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্র বা খেলার মাঠেই লড়াইটাকে অপেক্ষাকৃত কঠিন লাগে না? কিন্তু, এত কঠিন লড়াইয়ের ক্ষেত্র থেকেও তো এমন কুবচন প্রতিপক্ষের প্রতি এমন কুবচন শোনা যায় না! গোটাটাই ব্যক্তিগত বা দলগত দক্ষতা যোগ্যতার ভিত্তিতে চলে, লড়াই দেয়।
তাহলে রাজনীতির যুদ্ধে কেন এত আকথা কুকথা, কেন এত হুমকি বিষোদ্গার! তাহলে কি এই লড়াইয়ের ময়দানে কি আজ দক্ষতা যোগ্যতায় টান পড়িয়াছে? সেই ফাঁক ভরাতে কাদা-পাঁক জঞ্জালের ব্যবহার বাড়ছে! জানি না, তবে মঙ্গলবার বসিরহাটের নির্বাচনী জনসভায় বিজেপি প্রার্থীর ধারালো মন্তব্যগুলো শোনার পর একাধিকের মুখে শোনা গেল—এখনও তো ক্ষমতায় আসেনি, তাতেই এই! বলছেন কী! নির্বাচনের দিন বুথ দখল করতে এলে তাদের পা নয় বুক লক্ষ্য করে গুলি করতে বলবেন সিআরপিকে! ...যাবে দৌড়ে আর ফিরবে খাটিয়াতে!... রাস্তা দিয়ে মহিলারা ডাব কাটার দা নিয়ে বের হবেন আর দু-চারটেকে একদম সাবাড় করে দিয়ে আসবেন। পুলিসকে থানার বাইরে বের করতে দেবেন না!... সারা নির্বাচন ক্ষেত্র জুড়ে বিএসএফ সিআরপি থাকবে... কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে বেচালদের চাল ঠান্ডা করে দেবে!—এর মধ্যে কোনটা পলিটিকাল কথা! সবই তো হুমকি! কেন? এসব দেখার জন্য নির্বাচন কমিশন আছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্য পুলিস সরকার প্রশাসন আছে। একজন প্রার্থীকে এসব বলতে হবে কেন? বলবেনই বা কেন? তৃণমূলের অনুব্রত মণ্ডল চড়াম চড়াম, গুড়বাতাসা, নকুলদানা বলেছেন বলে? সে তো কলকাতার এক গেরুয়া প্রার্থীও বলেছেন, মিহিদানা। কিন্তু, এমন সরাসরি গুলি করে মারার হুমকি তো তাতে নেই! ভোট ময়দানে উত্তেজনা ছড়াতে আরও কত কিছুই তো বলা যেত—এমন উলঙ্গ চোখরাঙানির দরকারটা কী ছিল?
জনতার এই জিজ্ঞাসা অস্বাভাবিক নয়। সাময়িক উত্তেজনার বশেই হোক কি অন্য কোনও কারণে— জেপি প্রার্থীর ওই মন্তব্যগুলিকে কিছুতেই সমীচীন বলা যাবে না। তৃণমূলের ক্ষুব্ধ মহাসচিব ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, এভাবে রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই বদল করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আধা সামরিক বাহিনীকে উস্কে দিয়ে নির্বাচন দখল করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ওইসব মন্তব্যের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর শাস্তির দাবি জানাতে যাবেন তাঁরা। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, এমন কুকথার জন্য তৃণমূল নেতৃত্ব তো তাদের অত বড় সেলিব্রিটি সংসদ সদস্যকেও রেয়াত করেনি, তাঁরা অন্যের অনুরূপ কাণ্ড মানবেন কেন?
কিন্তু, সে না হয় হল! সিপিএমের প্রবীণ নেতাও কী বললেন—পশ্চিমবঙ্গ অতীতে কখনও এ ধরনের ভাষা শোনেনি! সে কী! তাহলে অনিল বসু, রেজ্জাক মোল্লা, বৃন্দা কারাত থেকে বিমান বসুর মতো বর্ষীয়ানরা বাম জমানার শেষলগ্নে যা সব বলেছিলেন সে সব কিছুই কি চিরতরে ‘ডিলিট’ হয়ে গেল!! আজকের মুখ্যমন্ত্রী সেদিনের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে’ কোথায় যেন নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এক সিপিএম নেতা, মমতার অমন অনন্য জননেত্রী ভাবমূর্তিকে উপেক্ষা করে তাঁর সম্পর্কে ‘ভাতার’ ইত্যাদি অতি নীচ নোংরা মন্তব্য কে যেন করেছিলেন—সব সব ‘ডিলিট’! ও হরি! জনমন বিস্মৃতিপ্রবণ ঠিকই—তবে কি সাহেব ওতে এখনও অ্যালঝাইমার্স ধরেনি! প্লিজ, খোঁড়াখুঁড়ি করতে সাবধান—কঙ্কাল সব না বেরিয়ে পড়ে! একটা দুটো তো নয়—অজস্র অনেক। সব না হলেও এখনও অনেক কিছুই মনে আছে রাজ্যবাসী মানুষজনের। সুতরাং সবিস্ময়ে পশ্চিমবঙ্গ এমন ভাষা আগে শোনেনি বলার আগে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা আবশ্যক—বলছেন রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞরা।
বলছেন এই কারণেই যে, আজ বিজেপি’র প্রার্থী সায়ন্তন বসুর মুখ দিয়ে যা বেরিয়েছে তা নতুন নয়। বাম জমানায় সিপিএম নেতা-নেত্রীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালিমালিপ্ত করতে যে কদর্য কুকথার রাজনীতি আমদানি করেছিলেন অনুব্রত, সায়ন্তনের মুখে তারই অনুবর্তন চলছে। তবে, আশার কথা একটাই, সিপিএম জমানার চেয়ে এই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক ও প্রবক্তার সংখ্যা পরবর্তীতে অনেকটাই কমে গেছে। কারণ, এই কুকথার রাজনীতি যে সাধারণ মানুষ পছন্দ করেন না এবং এসবের শেষ ফল শেষ পর্যন্ত যে বিশেষ ভালো হয় না সেটা সিপিএমের মহাপতনের পর মোটের ওপর বঙ্গের সব রাজনৈতিক শক্তিই বুঝে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা তো এমন কুকথার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তবু কুকথার মুখে পুরোপুরি আগল টানা যাচ্ছে না—আকার ইঙ্গিত ব্যঞ্জনা ছেড়ে একেবারে সরাসরি রাজনৈতিক ভোটযুদ্ধের ময়দানে ঢুকে পড়ছে প্রাণঘাতী হুমকি! বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির পক্ষে এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
মনোবিদেরা কী বলবেন জানি না, তবে আমাদের মনে হয়—এইসব কুকথার মধ্যে কেবল প্রতিপক্ষকে আক্রমণের বাসনাই কাজ করে না, করে মৌখিক আস্ফালনে দুর্বলতা ঢাকার একটা প্রচ্ছন্ন প্রবণতাও। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহাশক্তিমান ও প্রায় অজেয় হন তাহলে এই প্রবণতা চাগাড় দেয় বেশি। কিন্তু তাতে কি পাশে পাওয়া যায় মানুষকে! নাকি মানুষ সেই মাত্রাজ্ঞানহীন বহ্বাড়ম্বরকে অশনি সংকেত ভেবে আরও বেশি করে সরে যায় দায়বদ্ধ রাজনীতি এবং সর্বাত্মক উন্নয়নের দিকে? একটু ভাবুন।