শরীর-স্বাস্থ্যের আকস্মিক অবনতি। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসতে পারে। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদ, ব্যবসায় নতুন সুযোগ ... বিশদ
আর ক’দিন বাদেই এবারের সাত দফার ভোটগ্রহণপর্বের প্রথম দফা শুরু হয়ে যাবে। ভোটকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মাঠে নেমে পড়েছে। ভোটারদের মন টানতে দৃশ্য ও আপাত অদৃশ্য হরেকরকম কৌশলের তরবারিতে শান দেওয়া ও ব্যবহারের কাজ এখন পুরোমাত্রায় চলছে। ভোটের জন্য প্রচারের প্রসঙ্গ এলে আগ্রার ভঁপু চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে যায়। ভঁপুবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সেবার উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোট কভার করতে গিয়ে তখন ওই রাজ্যের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়াচ্ছি। এভাবেই একদিন আগ্রায় পৌঁছেছিলাম। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এক হোটেল মালিকই বললেন, ভঁপু চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ করুন। এখানকার ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট। ভালো ফাইট দেবেন। জেতার সম্ভাবনাও রয়েছে।
নামটি শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। ভঁপু চক্রবর্তী! চক্রবর্তী পদবি শুনে মনে হল বাঙালি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু ভঁপু? কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ঠিকানা খুঁজে হাজির হলাম তাঁর ডেরায়। আলাপ হল। হ্যাঁ, বাঙালিই বটে। পেশায় আইনজীবী। নেশায় ভোট-লড়িয়ে। প্রায় প্রতিটি ভোটেই প্রার্থী হন। তাঁর প্রচারের ধরনটি অদ্ভুত। সম্ভবত ওই কারণটিই তাঁকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। বললেন, অন্য নেতারা বলেন—নিজের ভোট নিজে দিন। আমার মন্ত্র— নিজের প্রচার নিজে করুন। বলা যায় ওয়ান ম্যান পার্টি। নিজেই প্রার্থী, নিজেই কর্মী, নিজেই প্রচারক। অনেকটা বাংলা সাংবাদিকতার কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব দাদাঠাকুর ওরফে শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের মতো। যিনি নিজেই সংবাদ সংগ্রহ করতেন, নিজের হাতেই তা প্রেসে ছাপাতেন। আবার, নিজেই ঘুরে ঘুরে সেই পত্রিকা বিক্রি করতেন। আগ্রার ভঁপুবাবুও একটা ফোল্ডিং মই কাঁধে নিজের জন্য ভোটপ্রচারে বেরিয়ে পড়েন। হাতে থাকে বিরাট একটা বিউগল। হিন্দিতে যা ভঁপু বলে পরিচিত। রাস্তার মোড়ে বা বাজারের মাঝে কাঁধের মই নামিয়ে তার উপর চড়ে খানিকক্ষণ তারস্বরে ভঁপুটি বাজাতে থাকেন। লোকজন জড়ো হয়ে যায়। তখন বক্তৃতা শুরু করেন। কেন তাঁকেই ভোট দেওয়া জরুরি তা ব্যাখ্যা করে তবেই মই থেকে নামেন। জড়ো হওয়া লোকজনের হাতে লিফলেট ধরিয়ে ফের কাঁধে তুলে নেন মইটি। হনহন করে হাঁটা দেন পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। পিতৃপ্রদত্ত নাম ভবতোষ হলেও প্রচারসঙ্গী ভঁপুর কারণেই গোটা আগ্রা শহর ও আশপাশের মানুষ তাঁকে ভঁপু চক্রবর্তী বলেই চিনতেন। আগের পুরভোটে জিতেছিলেন। তখন আগ্রা মিউনিসিপ্যালিটির কাউন্সিলার।
ভোটপ্রচারের কথা বলতে গিয়ে ওই রাজ্যেরই আরও কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ছে। একবার একদিন সকালে আলিগড়ের রাস্তায় একটা হাতি দেখলাম। আপন মনে ঘুরে বেড়ানো ধূসররঙা ঐরাবতের বিস্তৃত পেটজুড়ে সাদা অক্ষরে এক ভোটপ্রার্থীর নাম লেখা। সঙ্গে আবেদন ‘এই চিহ্নে ভোট দিন’। বলা বাহুল্য, প্রার্থীর দলের নাম বহুজন সমাজ পার্টি। নির্বাচনী প্রতীক হাতি। সেবার এটাওয়া কেন্দ্রে প্রার্থী ছিলেন মুলায়ন সিং যাদব। তাঁর এলাকায় গিয়ে চোখে পড়ল সবুজ-লাল প্যাকেটে গুটখার ছড়াছড়ি। চা বা পানের দোকানগুলিতে তো বটেই, ছোটখাটো মাঝারি প্রায় সমস্ত মনোহারি, মুদিখানা দোকানেই মাত্র এক টাকায় ওই হঠাৎ আমদানি গুটখার রাশি রাশি প্যাকেট ঝুলছে। খালি হওয়ার পর ফেলে দেওয়া হাজার হাজার প্যাকেট রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। যেদিকেই তাকাই সবুজ-লালের ছড়াছড়ি। বাজারের অন্য গুটখার দাম তখন দু’টাকা। অর্ধেক দামে নতুন আমদানি গুটখায় প্রচুর মানুষ মজেছেন। তাও শুনলাম, দোকানদারদের নাকি আগাম দামও মেটাতে হয়নি। কে বা কারা অযাচিতভাবেই হাজার হাজার ‘হর-লাল’ সাপ্লাই করে যাচ্ছে। বিক্রি করার পরও দাম মিটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও আদায় করা হয়নি। ফলে দোকানদার মনের আনন্দে অন্য সব ব্রান্ডের গুটখা সরিয়ে রেখে কেবল ‘হর-লাল’ বেচাতেই জোর দিয়েছেন।
স্থানীয় এক প্রবীণ সাংবাদিকই ব্যাপারটা খোলসা করে দিলেন। বললেন, জানেন তো মুলায়মের দলের ঝান্ডার রং সবুজ-লাল! ভোটারদের মনে সুকৌশলে সমাজবাদী পার্টির বিষয়টি গেঁথে দেওয়া আর কী! একবার ভোটের মুখে আগ্রা ফোর্টের সামনে এক ভাগ্যগণককে দেখেছিলাম। টিকিধারী গণক। সামনে খাঁচায় একটা টিয়াপাখি। ভোটের ফলও নাকি আগাম বলে দিচ্ছিলেন ওই ভবিষ্যৎবক্তা। না না। ভুল হল। বলছিল সেই টিয়াপাখিটা। সামনে রাখা কাগজের একগুচ্ছ খাম। খামের মধ্যে ভাগ্যফল লেখা। খাঁচার দরজা খুলে দিলে পাখি ঠোঁটে একটা করে খাম তুলে আনছে। তাতেই নাকি লেখা ভোটের আগাম ফলাফল। বিভিন্ন দলের উৎসাহী নেতা-কর্মীদের অনেকেই মাত্র এক টাকায় দলের ভাগ্য জানতে ওখানে ভিড় করছিলেন। ব্যাপারটা দেখে আমি খুব মজা পেয়েছিলাম।
একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন অবসরগ্রহণের পর ১৯৯৯ সালে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। গুজরাতের গান্ধীনগর কেন্দ্রে। কংগ্রেসের টিকিটে। বিপরীতে বিজেপি’র লালকৃষ্ণ আদবানি। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আগের ক’টা বছর সেশন দেশজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁর নিত্যনূতন হুঙ্কারে, হরেকরকম ফরমানে ভোটের মুখে রাজনৈতিক দলগুলির থরহরিকম্প অবস্থা। বিরক্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তো একবার বলেই ফেললেন, লোকটা ‘মেগালোম্যানিয়াক’। তা সেই টি এন সেশনকে একদিন দেখলাম নিজের জন্য ভোটপ্রার্থনায় বেরিয়ে গান্ধীনগরের একটি হরিজনপল্লিতে খালি পায়ে হাঁটছেন। পরনে দুধসাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কপালে সিঁদুরের টিপ। খালি পা। খালি পায়ে কেন? কারণ কী? শুনলাম, ওই মহল্লার লোকজন নাকি কোন এক সংস্কারের বশে জুতো পরেন না। তাই তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে রাশভারী সেশন সাহেবও ওই এলাকায় খালি পায়েই দরজায় দরজায় দাঁড়াচ্ছেন। এটাও তো ভোটারদের প্রভাবিত করারই চেষ্টা। কারণ, প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিজেও যে তখন নেহাতই একজন ভোটপ্রার্থী! বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবকে আবার দেখতাম একেকটি ভোটে একেকরকমের প্রচারকৌশলের সাহায্য নিতে। বক্ততায় নানান চটকদার বুলি আওড়ানোয় একসময় দেশে লালুপ্রসাদের জুড়ি মেলা ভার ছিল। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় যেমন বর্ণময়, বক্তৃতাতেও তাই। একবার পাটনার একটি প্রধান সড়কের নাম করে বললেন, এই সড়কটির অবস্থা এখন অমুক অভিনেতার গালের মতো এবড়ো খেবড়ো। আমাদের ভোট দিয়ে জেতান। দেখবেন, এই সড়ক অমুক অভিনেত্রীর গালের মতো মসৃণ হয়ে যাবে।
যে দুই অভিনেতা অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ করেছিলেন লালু, তাঁরা দুজনেই হিন্দি সিনেমায় একসময় দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। একজন তো এখন বিদায়ী সাংসদ। এবারও ভোটপ্রার্থী। একবার ভোটের প্রচারে লালুপ্রসাদের দল একঝাঁক সুন্দরী যুবতীকে একই ধরনের পোশাক পরিয়ে একটি নৌকার সওয়ারি করে দিয়েছিল। নৌকায় ভরে দেওয়া হয়েছিল কলসি কলসি সরবত। নৌকার বিভিন্ন অংশে নানা আকারের হ্যারিকেন টাঙানো। হ্যারিকেন হল লালুপ্রসাদের দলের নির্বাচনী প্রতীক। নৌকা ভিড়ছিল গঙ্গার তীরবর্তী বিভিন্ন গঞ্জের ঘাটে ঘাটে। উপস্থিত জনতার মধ্যে বিলি করা হচ্ছিল সেই সরবত। সুন্দরীদের হাত থেকে সরবতের গ্লাস নিতে সে কী হুড়োহুড়ি! কে সরবত খাওয়াচ্ছে? লালুজির দল। ব্যাস। দারুণ কায়দায় ভোটের প্রচার হয়ে গেল। আর একবার লোকসভা ভোটের মুখে লালুপ্রসাদের নির্বাচনী প্রচারসভার খবর করতে আরায় গিয়েছিলাম। পাটনা থেকে ওই এলাকাটা ঘণ্টা দুয়েকের পথ। সভায় বিপুল ভিড়। আকাশে লালুপ্রসাদের হেলিকপ্টার দেখা যেতেই নীচে জনতার উন্মাদনা। আ গয়া। আ গয়া। সভাস্থলের পাশেই হেলিপ্যাড। রুপোলি চুলের নেতা হেলিকপ্টার থেকে নামলেন। চোখে সানগ্লাস, হাতে হ্যারিকেন। জনতা উচ্ছ্বসিত।
ওড়িশার জননায়ক তথা জনতা দল নেতা মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়ক ১৯৯৫-র বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হারিয়েছেন। বছর দুই বাদে মারাও গিয়েছেন। বাবার শূন্যস্থান পূরণ করতে রাজনীতির ময়দানে পা ফেলেছেন পুত্র নবীন পট্টনায়ক। বাবার নামে গড়েছেন নতুন পার্টি—বিজু জনতা দল। ২০০০ সালের বিধানসভা ভোটে ওই দল লড়ছে ‘শঙ্খ’ প্রতীক নিয়ে। ভোটের মুখে একদিন দলের এক নেতাকে পুরীর মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। কয়েকদিন আগেই আলাপ হয়েছিল। বললাম জগন্নাথদেব দর্শন করলেন, কী চাইলেন? ভদ্রলোক স্মিত হেসে বললেন, এখন চাওয়ার তো শুধু একটাই। দেবতাকে বললাম, শঙ্খ চেনাও প্রভু। সেটা কী? আমার প্রশ্নে ফের হাসলেন নেতা। বললেন, খুব সমস্যা হচ্ছে আমাদের। বিজুবাবুকে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ শ্রদ্ধা করেন। তাঁর নামেই আমরা নতুন দলের জন্য ভোট চাইছি। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, বিজুবাবু জনতা দলের নেতা ছিলেন। তাঁর প্রতীক ছিল চক্র। নবীনবাবু নতুন দলের প্রতীক নিয়েছেন শঙ্খ। বিজুবাবুর দলকে সমর্থন করতে চাইলে যে এবার চক্র নয়, শঙ্খ চিহ্নে ছাপ মারতে হবে বহু ভোটারকে তা বোঝানোই মুশকিল হচ্ছে। তাই প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে বললাম, ওদের শঙ্খ চেনাও প্রভু।
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন দু’বার কভার করেছিলাম। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে। ২০০১ এর ভোটের মুখে ঢাকার রাস্তায় আওয়ামি লিগের একটি প্রচার শোভাযাত্রায় চোখ আটকে গেল। শোভাযাত্রার বিভিন্ন অংশে গণ্ডা গণ্ডা ‘হাসিনা’। সাত আট দশ বছরের বালিকাদের নেত্রী শেখ হাসিনার স্টাইলে শাড়ি আর চশমা পরিয়ে শোভাযাত্রায় শামিল করা হয়েছে। ভোটপ্রচারের চমৎকার আইডিয়া। তখনও আমাদের দেশে মিছিলে নেতানেত্রীর মুখোশপরা সমর্থক দেখা যেত না। ইদানীং দেখা যায়। সবকিছুর পিছনেই ভোট টানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার কৌশল। এখন তো আবার সোশ্যাল মিডিয়া সবার উপরে নিজের স্থান করে নিয়েছে। এবার ভোটের প্রচারে অন্যান্য প্রচলিত মাধ্যমের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
গুরুত্বের বিচারের তুলসীপাতার ছোটবড় হয় না। আকারে বড় বা ছোট সব তুলসীপাতারই সমান মূল্য। ভোটের বেলায়ও তাই। ধনী-দরিদ্র, অট্টালিকার বাসিন্দা থেকে কুঁড়েঘরের বান্দা, নিরক্ষর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী অথবা চাপরাশি থেকে চেয়ারম্যান—সবারই একটি করেই ভোট। জিততে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি ভোট টানতে হবে। আর জিততে পারলেই সিকান্দার। তাই ভোট টানতে এতরকমের ছলাকলা, কায়দা কৌশল। নাটুকেপনা। হাতজোড় থেকে পদস্পর্শের ধূম। শাস্ত্রে বলেছে, প্রেমে আর রণে কোনও কৌশলই ফ্যালনা নেই। সবই যথার্থ। কৌশলের ভাবনায় ভোটের আগের ক’দিন নেতা-নেত্রী, প্রার্থী- শুভার্থীদের চোখে ঘুম নেই। দিনরাত একটাই ভাবনা। একটাই চাওয়া। ভোট চাই। ভোট।