শরীর-স্বাস্থ্যের আকস্মিক অবনতি। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসতে পারে। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদ, ব্যবসায় নতুন সুযোগ ... বিশদ
তবে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই—এবার ২৩ মে পর্যন্ত যাবতীয় উৎসবের বাতাবরণে কমবেশি একটা হাওয়া বইবেই—ভোট রাজনীতির হাওয়া। সেই হাওয়ায় নানান রঙের ওড়াউড়িও দেখা যাবে এবং সেটাই প্রত্যাশিত। কারণ, সামনেই ভোট মহাযুদ্ধ। দেশের শাসন ক্ষমতা দখলের লড়াই। এমন পরিস্থিতিতে চিরকালই দেখা গেছে যুযুধান পক্ষগুলির মন্ত্রীসান্ত্রী সেনাপতিরা এই উৎসব মঞ্চগুলোকে ব্যবহার করে মানুষের মন জয়ের একটা বাড়তি চেষ্টা করে থাকেন। এই চেষ্টায় এমনও দেখা গেছে যে, দেবতার মহিমায় ঘোর অবিশ্বাসী ‘নাস্তিক’ বামনেতা দুর্গাপুজোর মণ্ডপে কি জাগ্রত কালীমন্দিরে মাথা নোয়াচ্ছেন, পুজো দিচ্ছেন, কপালে আশীর্বাদের ফোঁটা-সিঁদুরও হাসিমুখে নিচ্ছেন! ভোটদেবতার সামনে আস্তিক-নাস্তিক ভেদাভেদ একাকার হয়ে গেছে তাঁদের আচারে আচরণে! বলা বাহুল্য, এসবের উদ্দেশ্য একটাই—জনসংযোগ ও জনমনোরঞ্জনে উৎসবমুখর জনমঞ্চটিকে ব্যবহার করে নেওয়া। যদি কিছু বাড়তি আসে ভোটবাক্সে। ভোট বছরে এমন দৃশ্য অতীতে দুর্লভ ছিল না, আজও নয়। এবার দোলেও দেখা গেল সেই পরিচিত দৃশ্য। শাসক-বিরোধী উভয় দলের প্রার্থী, নেতা-মন্ত্রী সকলেই যে যাঁর সাধ্যমতো হেসে গেয়ে নেচে মজা করে নিজেদের এলাকার মানুষজনের সঙ্গে আনন্দে মাতলেন। ভোটবাক্সে সমর্থনের আশায় স্ব-স্ব এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রীতির সম্পর্কগুলোকে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। এবং আসন্ন পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবেও যে এমন দৃশ্য দেখা যাবে তাতেও কারও খুব সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। তার ওপর পয়লা বৈশাখ আসবে ভোটপর্ব চলাকালে। ফলে বাংলার বর্ষবরণের অনুষ্ঠান মঞ্চে জনসংযোগে একই রকম উৎসাহ উদ্দীপনার ঢেউ দেখা দিলে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভোট বলে কথা। তাও আবার লোকসভা ভোট—দিল্লি দখলের মহাযুদ্ধ! সেই যুদ্ধ জিততে ছোট-বড় কোনও সুযোগ কোনও চেষ্টাই কি উপেক্ষা করা যায়!
তার ওপর আবার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো এ রাজ্যে ৪২-এ ৪২ করার ডাক দিয়েছেন! মমতা যে ফাঁপা কথা বলেন না সেটা সিপিএম কংগ্রেস, এমনকী বিজেপিও আজ ভালোমতো বুঝে গেছে। রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এ রাজ্যের মমতাবিরোধী শিবিরের কাছে আসন্ন ভোটযুদ্ধে মমতার ৪২-এ ৪২ ঠেকানোটা একটা বাড়তি চ্যালেঞ্জ ও চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই চাপের জন্যই সিপিএম কংগ্রেসের হাত ধরে ভোটে লড়ার জন্য এই শেষ সময়েও এমন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ৪২ আসনে বামফ্রন্ট হিসেবে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণায় এমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। সিপিএম তথা বামফ্রন্ট অবশ্য কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার এই উদ্যোগকে আবার ‘জোট’ বলতে নারাজ—বলছে ‘সমঝোতা’! তো, সে জোটই হোক কি সমঝোতা—এখনও পাকাপোক্ত হয়নি কিছুই। দুপক্ষের বেশ কয়েক দিনের মানঅভিমান, অভিযোগ আলোচনার পর দিনের শেষে বাম-কং একযোগে লড়াইয়ের সম্ভাবনা শনিবারও অব্দি দূরস্ত! কংগ্রেস হাইকমান্ডও বাংলায় বাম-কং সমঝোতার ছেঁড়া তার জোড়া দিতে তেমন উৎসাহী বলে মনে হচ্ছে না। অথচ, জোট নিয়ে দ্বিধা জড়তা কাটিয়ে ৪২ আসনে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে দুই পক্ষই অন্তত শুক্রবার রাত অব্দি ব্যর্থ। প্রচার অবশ্য দুপক্ষই শুরু করে দিয়েছে। কলকাতায় জেলায় গ্রামে সর্বত্র বাম কংগ্রেস দেওয়াল লেখা থেকে পথেঘাটে প্রচার চালাতে শুরু করেছে। তাদের ঘোষিত এবং ‘সম্ভাব্য’ প্রার্থীরাও জনসংযোগ করছেন, কিন্তু, সবটাই যেন কেমন ছাড়া ছাড়া, ‘সমঝোতা’ নিয়ে দোলাচলে খানিকটা যেন সুরহারা। বিশেষ করে চারপাশে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী ও দলীয় কর্মীদের হইহই জোরালো প্রচার সভাসমিতি বক্তৃতা জনসংযোগের প্রেক্ষাপটে বাম-কং প্রচারের খামতিটা যুদ্ধের আগেই যেন একটা তফাৎ তৈরি করে দিচ্ছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যে যথেষ্ট নয় সে কথা রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞজনেদের অনেকেই এখন স্বীকার করছেন।
অন্যদিকে, আসন্ন লোকসভা যুদ্ধে ২০/২২টা আসন জিতে পরবর্তী রাজ্য বিধানসভা ভোটে যারা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে সেই বিজেপির ঘরের দশাটা কী? তাদেরও তো পূর্ণাঙ্গ প্রার্থীতালিকা এখনও বেরল না! যাও বা কিছু আসনে বেরল তা নিয়ে তো অনেক জায়গাতেই রীতিমতো গণ্ডগোল বেধে গেছে! উত্তরবঙ্গ দলের অফিসে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ঠিক যেন আশি/নব্বই দশকের কংগ্রেস শিবির! সেই অশান্তি। কারণ ভিন্ন হলেও অশান্তির চেহারাটা মোটামুটি এক। আসলে, দিল্লির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এপর্যন্ত যাঁদের নাম এ রাজ্যের বিভিন্ন আসনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সদ্য ‘দলত্যাগী’! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শিবির থেকে আসা নেতাদের প্রার্থী করা নিয়েই দলীয় নেতাকর্মী স্তরে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। তার ওপর প্রত্যাশামতো প্রার্থী না মেলার ক্ষোভও রয়েছে! সারা বছর কাজের জায়গা থেকে সরিয়ে অন্যত্র প্রার্থী করা নিয়েও রাজ্যের পদ্মদলে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সেই অসন্তোষের কারণে দলীয় উচ্চপদ থেকে পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে! তবে, এইসব ক্ষোভ অভিমান অসন্তোষ চাপা দিয়ে বিজেপির নেতা প্রার্থীদের অধিকাংশই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে তৎপর হয়েছেন। প্রচারও করছেন। বলছেন, দলের সিদ্ধান্ত শিরোধার্য। কিন্তু, তাতেও যেন সর্বত্র পুরোপুরি ছন্দ পাচ্ছে না প্রচার। তথ্যভিজ্ঞরা মনে করছেন, এই ছন্দ না পাওয়ার কারণ বিজেপির নিচু ও মাঝতলার কর্মী-সমর্থক মহলের একাংশের অভিমান। যেসব ক্ষেত্রে তাঁরা ‘বহিরাগত’ বা ‘দলত্যাগী’ প্রার্থী পেয়েছেন সেখানেই এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আসন্ন ভোটযুদ্ধের মুখে প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তুমুল প্রচারে রাজ্যে তোলপাড় তুলেছে তখন প্রার্থী বাছাই নিয়ে ঘরোয়া ঝামেলা রাজ্য বিজেপি শিবিরকে যে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। কীভাবে এই ক্ষোভ প্রশমিত করে গেরুয়া বাহিনীকে সম্পূর্ণত লড়াইয়ের ময়দানে নামানো যায় তার জন্য দিনরাত এক করেছেন রাজ্য নেতৃত্ব। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, সিপিএম কংগ্রেসের চেয়েও উঁচু গলায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ কিছুদিন আগেই সরাসরি মমতারাজ উৎখাতের ডাক দিয়ে যা জানিয়েছিলেন তার সার কথা ছিল, লোকসভা যুদ্ধে ঘোষণা মতো আসন জিতে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা করবে গেরুয়াবাহিনী! আর সেই সূচনা হবে আগামী ডিসেম্বরই! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে এহেন শপথ কার্যকর করা যে সহজ কাজ না সেটা দিলীপবাবু কেন তাঁর দলের কনিষ্ঠতম নেতাকর্মীও জানেন। জানেন মমতার উন্নয়নের আলোয় আলোকিত বিশ্ববাংলার প্রতিটি মানুষ। জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে যিনি আজ কেবল অগ্রগণ্যই নন, রীতিমতো আলোচ্য ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশজনতার গভীর আবেগ ও কৌতূহলের কেন্দ্রে, যাঁকে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে দেখতে চাইছে আসমুদ্রহিমাচল ভারতের একটা বড় অংশ—তাঁকে তাঁর রাজ্যে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করা দূরে থাক একটা শক্তপোক্ত লড়াই দেওয়াও যে রীতিমতো প্রস্তুতির ব্যাপার তা কে না বোঝেন। কিন্তু, গেরুয়া শিবিরের ঘরোয়া ঝঞ্ঝাটে সেই প্রস্তুতি যে কিছুটা হলেও হোঁচট খাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রার্থী বাছাই, প্রার্থীতালিকা প্রকাশ থেকে শুরু করে প্রচার জনসংযোগ—সব মিলিয়ে সব ক্ষেত্রেই মমতার তৃণমূলের তুলনায় মমতা-বিরোধী শিবির বেশ খানিকটা পিছিয়েই শুরু করেছে তা বলা যায়। এবং সমঝোতা নিয়ে টানাপোড়েন আর ঘরোয়া কোঁদলে দুই শিবিরের দূরত্ব বাড়ছে বই কমছে না! অথচ, ভোটের আর মাত্র সপ্তা দুয়েক বাকি! অবস্থা পরিস্থিতি দেখে পথেঘাটে লোকে বলছে, প্রার্থী বাছতেই যদি এমন হিমশিম দশা হয় তবে মমতাকে রুখবেন কীভাবে! মহাযুদ্ধ তো এসে গেল! এহেন পরিস্থিতি সামলে রাজ্যের মমতা-বিরোধীরা কত দ্রুত ছন্দে ফেরেন এবং লোকসভা মহাযুদ্ধের ময়দানে ৪২-এ ৪২ রুখতে কতটা কী করে উঠতে পারেন—বলতে কী, এখন সেটাই দেখার।