শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
ওই তিন রাজ্যে বিজেপি’র ভরাডুবিতে দেশের তাবৎ রাজনৈতিক ছবিটিই অন্য মাত্রা পেল। দিল্লির মসনদ থেকে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সহযোগীদের উৎখাত করতে বিরোধী দলগুলি রে রে করে মাঠে নামার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। ‘মোদি হটাও’ অভিযানে একদিকে যেমন নেতৃত্বের দাবিদার হয়ে উঠলেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনি দ্রুত একেবারে সামনের সারিতে চলে এলেন রাহুল গান্ধী। হ্যাঁ, সেই রাহুল গান্ধীর কথাই বলছি, যাঁকে বছর দেড়েক আগেও গেরুয়াশিবিরের নেতারা উঠতে বসতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেশবাসীকে বিনোদনের খোরাক দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সেই রাহুল গান্ধীই আজ প্রবল পরাক্রান্ত নরেন্দ্র মোদির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৪-র ভোটের মুখে দেওয়া বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পালন না করা থেকে শুরু করে গত পাঁচ বছরে মোদি সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের ব্যর্থতা ও তার সুবাদে কোটি কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্দশাকে তুলে ধরছিলেন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা। আচমকা নোটবাতিলের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তড়িঘড়ি জিএসটি কার্যকরের বিরুদ্ধেও তাই। তারপর নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়ার মতো লোকজনের দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালানোর ইস্যু থেকে শুরু করে ফ্রান্স থেকে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনাকে কেন্দ্র করে বিপুল অঙ্কের টাকার কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে সমানে সরব থেকে রাহুল দেশজুড়ে একরকম হইচই ফেলে দেন। রাফাল কেনার চুক্তিকে কেন্দ্র করে সংসদের ভিতরে ও বাইরে গোটা দেশজুড়ে প্রবল বিতর্ক যেভাবে পেকে উঠছিল তাতে মনে হচ্ছিল আসন্ন লোকসভা ভোটের ময়দানে রাফালই বোধহয় হবে বিরোধীদের তুরুপের তাস। কারণ, এখনও পর্যন্ত রাফাল নিয়ে সরকারপক্ষ তেমন কোনও জুতসই জবাব দিতে পারেনি যাতে বিরোধীদের তোলা অভিযোগগুলিকে জোরের সঙ্গে খণ্ডন করে দেওয়া সম্ভব। কেন আগের ইউপিএ আমলের হওয়া চুক্তি থেকে সরে গিয়ে মোদি সরকার তুলানায় বেশি দামে রাফাল যুদ্ধবিমান কিনতে চলেছে, কেন আগের চেয়ে অনেক কমসংখ্যক বিমান কেনা হচ্ছে, কেনইবা সরকারি সংস্থা হ্যালকে বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাহীন একটি বেসরকারি কোম্পানিকে রাফালের দেশীয় সহযোগী সংস্থা বানানো হচ্ছে, প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে অন্ধকারে রেখে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রক কেন রাফাল কেনা নিয়ে অতিরিক্ত তৎপরতা দেখিয়েছিল—এসব প্রশ্নের কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব এখনও মেলেনি।
ফলে, মুখে যাই বলুন না কেন, রাফাল ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদিরা বেশ ব্যাকফুটেই ছিলেন। অনেকেই রাফালকাণ্ডের সঙ্গে তিরিশ বছর আগের বোফর্স কামানকাণ্ডের সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। রাজীব গান্ধীর আমলে বোফর্স কামান কেনায় ৬৪ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ এনে ১৯৮৯-র লোকসভা ভোটের মুখে বিরোধীরা হইচই বাধিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যাপারটি এমন উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল যাতে ওই ভোটে কংগ্রেস দলের ভরাডুবি ঘটে। যদিও তারপর এতবছরেও বোফর্স ঘুষকাণ্ড প্রমাণিত হয়নি। এমনকী সেইসময় অভিযোগ তোলা প্রধান দলগুলির মধ্যে অন্যতম বিজেপি ভিন্ন দুটি দফায় দশবছর দেশ শাসন করল। তা সত্ত্বেও। এদিকে, বোফর্সে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা ঘুষের অভিযোগ থাকলেও রাফালে ‘নরেন্দ্র মোদির বন্ধু’ শিল্পপতিকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে সরব হয়েছেন রাহুল।
এই পরিস্থিতিতে আচমকাই হাজির হয়ে গেল পুলওয়ামাকাণ্ড। এক আত্মঘাতী কাশ্মীরি জঙ্গির আচমকা হানায় দেশের ৪৯জন বীর আধাসেনা জওয়ানের প্রাণ চলে গেল। এমন ঘটনায় গোটা দেশ শোকে মর্মাহত তো বটেই, পাশাপাশি সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার। এই ইস্যুতে দেশের মানুষ একজোট। বিষয়টি নিয়ে কোনও রাজনীতি না করার অঙ্গীকার করেছিল বিভিন্ন দল। কংগ্রেস, তৃণমূলের মতো দলগুলির নেতা-নেত্রীরা প্রকাশ্যেই তা ঘোষণা করেছিলেন। ওই লড়াইয়ে তাঁরা সরকারের পাশের থাকারও আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও নিজের আবেগঘন অনুভূতির কথা প্রকাশ করার পাশাপাশি ঘোষণা করেছিলেন, হামলাকারী ও তাদের মদতদাতারা এমন কড়া শাস্তি পাবে যাতে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। সরকার ওই মর্মান্তিক ঘটনার জেরে জাতীয় শোক ঘোষণা না করলেও বিরোধীরা সৌজন্যের খাতিরেই দিনকয়েক তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি একরকম বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে, রাজনীতির লোকজনও কোনও পরিস্থিতিতেই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে থাকতে পারেন না। পুলওয়ামাকাণ্ডেও তাই হল। পুলওয়ামা নিয়ে রাজনীতি করব না করব না বলেও ৭২ ঘণ্টা কাটার আগেই নেতারা সংযম হারিয়ে ফেললেন। এক্ষেত্রে খেলা শুরুর বাঁশিটি বাজিয়ে দিল গেরুয়াশিবিরের লোকজনই। একদিকে, পুলওয়ামাকে কেন্দ্র করে একদল লোক দেশপ্রেমের নামে ধর ধর মার মার করে মাঠে নেমে পড়ল। সংবিধান প্রতিটি ভারতীয় নাগরিককে মতামত প্রকাশের মৌলিক অধিকার দিয়েছে। কেউ ওই অধিকারের অপব্যবহার করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য আইন আদালত রয়েছে। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা না করে কিছু লোক স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক সেজে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে চাইল। দেশজুড়ে একটা আবেগের স্রোত বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাত থেকে বিজেপি’র এক নেতা নিদান দিলেন, এই আবেগকে ভোটের বাক্সে টেনে নিয়ে যেতে হবে। দলের সর্বভারতীয় সভাপতিও বিভিন্ন সভা সমাবেশে এমন সব মন্তব্য করলেন যাতে স্পষ্ট, পুলওয়ামা নিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে আগ্রহী। ব্যস। খুলে গেল প্যান্ডোরার বাক্স। নীরবতা ভাঙলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে রাহুল গান্ধী এবং বিরোধীপক্ষের আরও অনেকেই। বোঝাই যাচ্ছে রাফাল-টাফালকে পিছনে ফেলে এবার ভোটে পুলওয়ামা কাণ্ডই হতে চলেছে প্রধান ইস্যু। শাসকদল বিজেপি’ই এব্যাপারে পথ দেখাল। সম্ভবত নোটবাতিল থেকে জিএসটি, অসহিষ্ণুতা থেকে নাগরিকপঞ্জি এবং সর্বোপরি রাফাল ইস্যুতে কোণঠাসা বিজেপি এবার পুলওয়ামাকাণ্ডকে ধরেই ভোটের লড়াইয়ে বাজিমাত করার চেষ্টা করবে।
কিন্তু এ পথটিও যে ওই দলের পক্ষে পুরাপুরি নিষ্কণ্টক হবে না তার আভাসও এখন থেকেই মিলছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার যে আওয়াজ তা তোলা হয়েছে তার বাস্তবায়নের দায় থাকছেই। এরই পাশাপাশি পুলওয়ামা কাণ্ড নিয়ে বিরোধীরা যেসব প্রশ্ন ইতিমধ্যেই তুলেছেন সেগুলিরও জবাব দিতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছেন, গোয়েন্দাদের আগাম বার্তা সত্ত্বেও সরকার কেন সতর্ক হল না? কেন রীতি ভেঙে ওইদিন ৭২টি গাড়ি দীর্ঘ কনভয়ে প্রায় দু’হাজার জওয়ানকে একসঙ্গে পাঠানো হল? কেন ওই একইসময় ওই পথে সাধারণ যানবাহনের চলাচল অব্যাহত রাখা হল? এরপর রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস আরও মারাত্মক যে প্রশ্নগুলি তুলেছে সেগুলিরও জুৎসই জবাব আশা করবেন দেশের আপামর মানুষ। কংগ্রেসের সুরেই তাঁরাও জানতে চাইবেন, পুলওয়ামায় যখন জওয়ানরা ভয়ঙ্কর মারণ-হামলার শিকার হলেন, সেই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি সত্যিই নৈনিতালের জিম করবেট পার্কে ফিল্মের শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন? হামলার খবর তিনি ঠিক কখন পেলেন? খবর পেয়েই শ্যুটিং বন্ধ করে দিয়েছিলেন কি? ঘটনার দু’-আড়াই ঘণ্টার মধ্যেও পুলওয়ামা নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য শোনা গেল না কেন? অথচ ঘণ্টা দুই বাদে তিনি মোবাইল ফোন মারফত একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। সেই বক্তৃতার মধ্যে পুলওয়ামার উল্লেখ নেই কেন? তাহলে কি ওরকম একটা মারাত্মক ঘটনার খবর প্রাধানমন্ত্রীকে জানানোই হয়নি? এর কারণ কী? না কি, জানানো হলেও তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি? যাঁরা নিজেদের দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী বলে শোরগোল তুলতে সিদ্ধহস্ত, দেশের জন্য আত্মবলি দেওয়া জওয়ানদের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটি সত্যিই কী রকম? আরও প্রশ্ন উঠতে পারে, ইদানীংকালে এই সরকারের আমলেই কাশ্মীরে অশান্তি সবচেয়ে বেশি হল কেন? কেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জওয়ানকে প্রাণ দিতে হল? এর পিছনে ব্যর্থতা কার বা কাদের?
এই প্রশ্নগুলির সরাসরি জবাব দিতেই হবে। নইলে পুলওয়ামা ইস্যুই মোদিজিদের জন্য ব্যুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য এর আগে ওঠা বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেওয়ার দায় দেখাননি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। রাফাল নিয়ে যৌথ সংসদীয় তদন্ত কমিটি গড়া হবে না কেন—এই প্রশ্নে তাঁর জবাব ছিল, আমি গরিবের ছেলে বলে আমার সাফল্য ওদের সহ্য হচ্ছে না। আবার, পুলওয়ামাকাণ্ডের সময় ও তার পরও বেশ কয়েকঘণ্টা মোদিজি শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন কিনা প্রশ্ন উঠলে তাঁর এক মন্ত্রী জবাব দিলেন, কংগ্রেসের মুখে ইমরান খানের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কী প্রশ্নের কী জবাব! এতে সাধারণ মানুষের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়া অযৌক্তিক হবে না—কর্তারা বাস্তবকে পাশ কাটাতে চাইছেন। ভোটের বাজারে এতে কি সহজে চিঁড়ে ভিজবে!