জ্ঞানীরা যাকে ব্রহ্ম বলে, যোগীরা তাঁকেই আত্মা বলে, আর ভক্তেরা তাঁকেই ভগবান বলে। একই ব্রাহ্মণ। যখন পূজা করে, তার নাম পূজারী; যখন রাঁধে তখন রাঁধুনি বামুন। যে জ্ঞানী, জ্ঞানযোগ ধরে আছে, সে নেতি নেতি এই বিচার করে। ব্রহ্ম এ নয়, ও নয়; জীব নয়, জগৎ নয়। এইরূপ বিচার করতে করতে যখন মন স্থির হয়। মনের লয় হয়, সমাধি হয়, তখন ব্রহ্মজ্ঞান। ব্রহ্মজ্ঞানীরা ঠিক ধারণা ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা; নামরূপ এ সব স্বপ্নবৎ; ব্রহ্ম কি যে, তা মুখে বলা যায় না; তিনি যে ব্যক্তি (Personal God) তাও বলার যো নাই। জ্ঞানীরা ঐরূপ বলে—যেমন বেদান্তবাদীরা। ভক্তেরা কিন্তু সব অবস্থাই লয়। জাগ্রত অবস্থাও সত্য বলে—জগৎকে স্বপ্নবৎ বলে না। ভক্তেরা বলে এই জগৎ ভগবানের ঐশ্বর্য। আকাশ নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য, পর্বত, সমুদ্র, জীব, জন্তু এসব ঈশ্বর করেছেন। তাঁরই ঐশ্বর্য। তিনি অন্তরে হৃদয়ে মধ্যে আবার বাহিরে। উত্তম ভক্ত বলে, তিনি নিজে এই চর্তুবিংশতি তত্ত্ব—জীব জগৎ হয়েছেন। ভক্তের সাধ সে চিনি খায়, চিনি হতে ভালবাসে না। ভক্তের ভাব কিরূপ জান? হে ভগবান তুমি প্রভু, আমি তোমার দাস, “তুমি মা আমি তোমার সন্তান,” আবার ‘তুমি আমার পিতা বা মাতা। ‘তুমি পূর্ণ আমি তোমার অংশ। ভক্ত এমন কথা বলতে ইচ্ছা করে না যে ‘আমি ব্রহ্ম’। যোগীও পরমাত্মাকে সাক্ষাৎকার করতে চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য—জীবাত্মা ও পরমাত্মার যোগ। যোগী বিষয় থেকে মন কুড়িয়ে লয় ও পরমাত্মাতে মন স্থির করতে চেষ্টা করে। তাই প্রথম অবস্থায় নির্জনে স্থির আসনে অনন্যমন হ’য়ে ধ্যান চিন্তা করে। কিন্তু একই বস্তু। নাম-ভেদমাত্র। যিনিই ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা, তিনিই ভগবান। ব্রহ্মজ্ঞানীর ব্রহ্ম, যোগীর পরমাত্মা, ভক্তের ভগবান।
ঈশ্বরের নামের ভারী মাহাত্ম্য
নিতাই কোন রকমে হরিনাম করিয়ে নিতেন। চৈতন্যদেব বলেছিলেন, ঈশ্বরের নামের ভারী মাহাত্ম্য। শীঘ্র ফল না হতে পারে কিন্তু কখনও না কখনও এর ফল হবেই হবে। যেমন কেউ বাড়ির কার্নিশের উপর বীজ রেখে গিয়েছিল; অনেক দিন পরে বাড়ি ভূমিসাৎ হয়ে গেল, তখনও সেই বীজ মাটিতে পড়ে গাছ হ’ল ও তার ফলও হ’ল।
ঈশ্বর—সাকার না নিরাকার
ব্রাহ্মভক্ত।। মহাশয়! ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে এত নানা মত কেন? কেউ বলে সাকার—কেউ বলে নিরাকার—আবার সাকারবাদীদের নিকট নানা রূপের কথা শুনতে পাই। এত গণ্ডগোল কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ।। যে ভক্ত যেরূপ দেখে, সে সেই রূপ মনে করে বাস্তবিক কোন গণ্ডগোল নাই। তাঁকে কোন রকমে যদি এক বার লাভ করতে পারা যায়, তা হ’লে তিনি সব বুঝিয়ে দেন। সে পাড়াতেই গেলে না—সব খবর পাবে কেমন করে? অর্থাৎ যে ব্যক্তি সদা-সর্বদা ঈশ্বর-চিন্তা করে সেই জানতে পারে তাঁর স্বরূপ কি? সে ব্যক্তিই জানে যে তিনি নানারূপে দেখা দেন। নানাভাবে দেখা দেন—তিনি সগুণ, আবার তিনি নির্গুণ। যে গাছতলায় থাকে সেই জানে বহুরূপীর নানা রঙ—আবার কখন কখন কোন রঙই থাকে না। অন্য লোকে কেবল তর্ক ঝগড়া করে কষ্ট পায়।
উদ্বোধনের ‘শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে ঈশ্বর’ থেকে