বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
যাকে পূজার আসনে বসিয়েছি, অন্তরের ভক্তি-অর্ঘ্য করেছি নিবেদন—হঠাৎ তাকে একদিন আবিষ্কার করেছি বাবুগঞ্জের হাটে— তার পসরায় আলোর দীপ নেই, প্রেমের ফুল নেই, নেই আনন্দের উজ্জ্বল শস্য,—সেখানে রয়েছে কয়েকটি পুতুল। এ সংসারে মৌমাছি বড় বিরল, বেশির ভাগ লোকই স্বভাবে মাছি— রক্ত-ঝরা নিন্দার ক্ষতে, রক্ত-মাংসের ঘ্রাণে, ঈর্ষার আস্তা-কুঁড়ে তারা বাস করে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে কত আলো, কত গান, কত আনন্দ ছড়িয়ে আছে—মৌমাছির মত রৌদ্রের পাড়ায়, ফুলের বনে, অক্লান্ত সবুজে ক’জন মধুপান করে গান গেয়ে বাঁচতে জানে!
কাউকে তো বঞ্চিত করতে চান না আমার দেবতা। একটি সোনার চাবি কাঠি দিয়ে খুলে দেন মনের দরজা,—অনন্ত আলোর দেশে, অবাধ আনন্দের রাজত্বে আত্মাকে দেন মুক্তি—মুক্তি পথের সন্ধান। কে এই আলোর আনন্দের ধারায় করে মুক্তিস্নান? কত কেঁদেছি, কত ঘুরেছি ঘরে ঘরে। একটি কুকুরের প্রয়োজন প্রায় প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে অপরিহার্য,—কিন্তু আমার দেবতার ঠাঁই হয়েছে ক’জনের গৃহে? লোকে কত ফালতু কথা শুনে, অকারণ কথার তাঁত বুনে—যিনি শুকনো ডালে ফুল ফুটান, যার পলকমন্ত্রে ফুলের বুকে রঙ ঝরে প্রজাপতির ডানায়, পাখির পালকে,—আর ফুল হয় ফল, রৌদ্র হয় গান, রাত্রি হয় স্বপ্নে নির্মাণ, দিনান্তের মাঠে সন্ধ্যামেঘে সোনা ঝরে; যিনি জীবনকে রাঙান বেদনার রঙে, বেদনাকে করেন মধুর, অমর দীপ জ্বালেন প্রাণের আলোয়—কে শুনতে চায় তাঁর কথা?
এক দস্যু যাঁর প্রসাদে হলেন মহাকবি বাল্মীকি, এক দরিদ্র, প্রায় নিরক্ষর পাগল পূজারী হলেন জগতপূজ্য রামকৃষ্ণদেব, অন্ধ সুরদাসের প্রাণের বীণা বেজে উঠলো গানে—এমনি কত অভাজন হয়েছেন ধন্য। তবু তাঁর ডাকে ক’জন সাড়া দেয়?
এক এক সময় মনটা বিষন্ন হয়ে উঠতো, এক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আমাকে আচ্ছন্ন অস্থির করে তুলতো। ছট্ফট্ করতাম দুঃসহ যন্ত্রণায়। এমনি মানসিক সংকট মুহূর্তে আমার যারা বন্ধু, চিরকালের সহচর— একে একে তোমরা আসতে লাগলে—আমার আশাকে, আমার প্রাণের দেবতাকে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
এখন তোমরাও যদি অলস মধ্যাহ্নের গানে ঝিমিয়ে পড়, মায়াভুবনে মুগ্ধ হয়ে ফের—একটি তৃণ খণ্ডের মত বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও, অলস মৌমাছির মত মননের মধু দিয়ে স্বপ্নের নীড় রচনায় ব্যস্ত থাক—রঙ করা পুতুলের মত মহৎ প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়, কে তবে মানুষের ঘরে আলো দেখাবে, মৃত্যুশোকে স্তব্ধ মানুষের হাতে তুলে দেবে অমৃতের ভাণ্ড? একটি ক্ষণভঙ্গুর শরীরকে সুখী করার যন্ত্রণা নিয়ে তোমরাও কি বেঁচে থাকবে?
একটি স্বপ্নের ভুবন রচনায় তোমাদের ভূমিকা উজ্জ্বল হোক তোমাদের ত্যাগে ও তপস্যায় তা মূর্তিলাভ করুক। নোনাধরা ইটের মত কেন ক্ষয় হবে তোমাদের জীবন—কেন হবে বিধাতার সৃষ্টির এই করুণ অপচয়? প্রদীপের শিখার মত পুড়ে পুড়ে তা নিঃশেষ হোক, আলো দিক মানুষের ঘরে ঘরে—জাগিয়ে রাখুক আনন্দের উৎসব।
পত্র-সাহিত্যে শ্রীপরমানন্দ (প্রথম খণ্ড) থেকে