আধ্যাত্মিক সাধনমার্গে ভক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আজ কিছু বলব। সবাই জানে, অধ্যাত্ম জগতে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি হ’ল আত্মিক প্রগতির জন্যে তিনটি স্বীকৃত সহায়ক। জ্ঞানী জ্ঞানচর্চার দ্বারা লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যান, শুধু একটু ব্যবধান থেকে যায়। কর্মীও কর্মসাধনার দ্বারা লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছে যান, তবু কিছুটা দূরত্ব তো থেকেই যায়। ভক্ত কিন্তু সরাসরি লক্ষ্যে পৌঁছে যান। জ্ঞানী জীবনভোর জ্ঞানচর্চার পর শেষ দিকটায় অনুতাপ করতে থাকে এই জন্যে যে সে সারা জীবন ধরে কেবল শুকনো জ্ঞানের কচ্‌কচি করে অযথা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে ও শেষ পর্যন্ত জীবনের লক্ষ্য থেকে দূরেই রয়ে গেছে। কর্মীও ওই একইরকম হা-হুতাশ করে মরে। ওরা ভাবে—সারাজীবন খেটেখুটে চরম সমাপ্তির লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছুলম বটে কিন্তু চরম প্রাপ্তি তো ঘটল না। ভক্তের মনে কোন অনুতাপ নেই। কারণ, ভক্তের মন তো সর্বদা আনন্দোচ্ছ্বল। তারা আনন্দে দিশাহারাও হয় না, আবার ব্যথা-বেদনায় আতুরও হয় না। অবি঩চ্ছিন্ন আনন্দানুভূতি ছাড়া তাদের মনে দ্বিতীয় আর কোন অনুভূতিই থাকে না, তাই তারা সুখে-দুঃখে অবিচল থাকে। কেবল ভক্তই এ রকম কথা বলতে পারে, জ্ঞানী বা কর্মনিপুণ ব্যষ্টি একথা বলতে পারে না। জ্ঞানী যতই সহজ-সরল হোক, তার মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অহংকার লুকিয়ে থাকে। জ্ঞানী ভাবে, সে সমাজের আর পাঁচ জনের মত নয়। সে ভেবে থাকে, সে যা জানে বাকী লোকেরা তা জানে না। যেখানে অহংবোধ লুকিয়ে আছে সেখানে এই ধরনের বোধ-বুদ্ধি থাকবেই। অহংকার পতনের মূল কারণ। তাই জ্ঞানীর পতনের সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর যেখানে পতনের সম্ভাবনা, সেখানে পথটা ভাল হতে পারে কিন্তু নিরাপদ নয়। আবার কর্মী যখন কোন কাজে সফল হয়েছে ভাবতে থাকে, তখন তার মনেও অহংকার জাগে। মুখে হয়তো বলেছে যে সে কিছুই করতে পারেনি কিন্তু মনের গোপনে এই আশা পোষণ করতে থাকে যে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় নিশ্চয় তার নাম ছাপা হবে। কুশলী কর্মীরাও কাজ করার পরে এ ধরনের মানসিক দৌর্বল্যের কবলে পড়ে। ভক্তের হারাবার কিছু নেই। যেহেতু তারা পরমপুরুষকে একান্ত আপনার বলে মানে, তাই তাদের লাভ ক্ষতির কোন ব্যাপারই নেই। কেবল ভক্তই বলতে পারে, পরমপুরুষ সবাইকার কাছে সমান। তিনি সুখই দিন আর দুঃখই দিন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না কারণ দুঃখ-সুখ সবই তো সেই একই নারায়ণের অভিব্যক্তি। জ্ঞানীদের কিন্তু এরকম কোন অনুভূতি নেই, তারা কিছুটা বহির্মুখী ভাব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে ভাবনা-চিন্তা করে। তাই তারা যখনই বিভিন্ন বিপরীতধর্মী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখনই সুখ-দুঃখ-নিন্দা-অপমান ইত্যাদি বিরুদ্ধধর্মী অনুভূতির দ্বারা পরামৃষ্ট হয়। 

শ্রীআনন্দমূর্ত্তির ‘আনন্দ বচনামৃতম’ থেকে