গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
মানলীলা—শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা বোঝা কঠিন, তন্মধ্যে মানলীলা সর্বাপেক্ষা কঠিন। স্বপক্ষ ও বিপক্ষ—শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলী পরস্পর বিপক্ষ। যাহারা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন তাহাদিগকে পরস্পরের বিপক্ষ পক্ষ বলা হয়। বিপক্ষের দু’টি কাজ—ইষ্টহানি ও অনিষ্ট সাধন। শ্রীরাধার অপেক্ষায় শ্রীকৃষ্ণ কুঞ্জে বসিয়া আছেন। ইহা জানিতে পারিয়া চন্দ্রাবলীর সখী পদ্মা চন্দ্রাকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণের নিকটে আসিয়াছেন। সুবলের নিকট শ্রীরাধা এই বিবরণ শুনিয়া কী অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন বৃন্দা তাহা শ্রীকৃষ্ণকে বলিতেছেন—হে মুকুন্দ! সুবল শ্রীরাধারানীর নিকট গিয়া বলিলেন—“পদ্মা চন্দ্রাকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিয়াছেন।” সুবলের মুখে এই কথা শোনামাত্র শ্রীরাধা স্তব্ধতা প্রাপ্ত হইলেন। পরদিন প্রাতঃকাল পর্যন্ত শ্রীরাধার স্তব্ধতা বিরাজমান ছিল। ইহার নাম ইষ্টহানি। অনিষ্টকারীঃ শ্রীরাধার শাশুড়ী জটিলা চন্দ্রাবলীর সখী পদ্মাকে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” পদ্মা বলিলেন—“আমি গোবর্ধনের তটদেশ হইতে আসিয়াছি।” জটিলা বলিলেন—“আমার বধূকে কি দেখিয়াছ? পদ্মা বলিলেন—“হাঁ দেখিয়াছি। সূর্য মন্দিরের দুয়ারে সূর্য পূজার জন্যে বসিয়া আছে।” জটিলা বলিলেন—“অনেকক্ষণ গিয়াছে—এখনও ফিরিতেছে না কেন?” পদ্মা বলিলেন—“পথে শ্রীকৃষ্ণ যাইতে তাহাকে বাধা দিয়াছে। রাধা কেবল তোমার পথ চেয়ে আছে। দ্রুত চলিয়া যাও।” পদ্মা সখী এইভাবে শ্রীরাধার অনিষ্ট সাধন করিলেন।
কেহ বলিতে পারে—ব্রজে কৃষ্ণের সকলেই প্রিয়জন। সকলেই চাহে শ্রীকৃষ্ণের সুখ। তাঁহারা নিজের সুখ কিছুই চাহেন না। তারই মধ্য বিপক্ষতা কিরূপে সম্ভব? তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে ঈর্ষাদৃষ্টি কিরূপে সম্ভব? শ্রীরূপ গোস্বামী তাহার উত্তরে বলিতেছেন—শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান সকলেরই কাম্য ইহা ঠিক, তথাপি শ্রীকৃষ্ণই রসের বৈচিত্র্য সম্পাদনের জন্য গোপীসুন্দরীদের মধ্যে স্বপক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করিয়া থাকেন—শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধির জন্যেই বিপক্ষতাই সৃষ্টি করিয়া থাকেন। প্রেমের স্বাভাবিক গতি অত্যন্ত কুটিল। এই কুটিলতা শ্রীকৃষ্ণের সুখের জন্যই হয়। অসংখ্য ব্রজসুন্দরী শ্রীকৃষ্ণের সুখের জন্য, তাহাদের প্রত্যেকেই শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যের নিমিত্ত প্রবলবাসনা। নরলীলায় শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে একই সময়ে সকলের বাসনা পূরণ সম্ভব নয়। মধুর রসে একটি সঞ্চারী ভাব আছে—তাহার নাম ঈর্ষা। শ্রীকৃষ্ণ এই ঈর্ষারূপ সঞ্চারীভাবকে কোনও কোনও ব্রজসুন্দরীতে নিক্ষেপ করেন। ইহা দ্বারা তাহাদের পরস্পরের বিপক্ষরূপ সম্পাদন করেন। ইহাতে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিকূলতা করা হয় না। বরং আনুকূল্যই করা হয়। ঈর্ষার ফলে বিপক্ষ সখীদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণে অনুরাগ পরিপুষ্টতা লাভ করে। শ্রীকৃষ্ণ পরিতুষ্ট হন।
শ্রীকৃষ্ণের সহিত সংযোগ সময়ে (অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ যখন ব্রজে ছিলেন, তখন) শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলীর মধ্যে পরস্পর বিপক্ষ ভাব, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ঈর্ষাদি জন্মে কিন্তু বিয়োগ দশায় (অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ যখন মথুরায় চলিয়া গেলেন, তখন) তাঁহাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাদির পরিবর্তে স্নেহই পরিদৃষ্ট হয়। ইহাতেই জানা গেল—সংযোগকালের ঈর্ষাদ্বেষাদি কেবল বাহ্যবৃত্তিতেই উদিত হয়, অন্তর্বৃত্তিতে উদিত হয় না। অন্তঃস্থিত কৃষ্ণরতিকে ভেদ করিতে পারে না। বস্তুত ঈর্ষাদ্বেষাদি সঞ্চারিভাব সমূহও কৃষ্ণরতিরই বৃত্তি বিকাশ, কৃষ্ণরতির বিজাতীয় বস্তু নহে। এই বিষয়ে দুইটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। (১) শ্রীকৃষ্ণের মথুরা অবস্থানকালে দিব্যোন্মাদগ্রস্ত শ্রীরাধা একসময়ে গোবর্দ্ধনস্থিত স্ফটিক শিলায় প্রতিফলিত নিজ প্রতিবিম্ব দেখিয়া তাহাকে চন্দ্রাবলী মনে করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছিলেন—চন্দ্রাবলী, তুমি বহুবার শ্যামসুন্দরের অঙ্গস্পর্শ লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছ—তোমার দেহ মঙ্গলযুক্ত হইয়াছে। তোমার সেই মঙ্গলময় দেহ সৌভাগ্যবশতঃ আমার দৃষ্টিগোচর হইল। তুমি তোমার মঙ্গলময় শীর্ণ বাহু দ্বারা আমার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া আমাকে প্রাণদান কর। (২) শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের ভক্ত শ্রীরমেশচন্দ্র কঠোর ব্রহ্মচারী ছিলেন। তিনি মানলীলা কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছিলেন না। শ্রীশ্রীপ্রভু চম্পটিকে আদেশ করিলেন—তুমি রমেশকে মানলীলার মাধুর্য বুঝাইয়া দাও। তোমাকে কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গাকে দিয়া যেভাবে বুঝাইয়াছিলাম সেইভাবে বুঝাইয়া দাও। তোমরা দুইজনই উচ্চ ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিতরা প্রায়ই তার্কিক হয়। তর্কটা বুদ্ধির ফল। অনুভূতিটা বোধির ফল। তোমার একটু বোধি জন্মিয়াছে। রমেশের এখনও জন্মায়নি।
‘শ্রীমহানামব্রতপ্রবন্ধাবলী’ থেকে